মেজর কর্তৃক ‘কেরপূজা’ ভণ্ডুল, ধর্মীয় অবমাননার আরেক রূপ

0
11

commentaryমন্তব্য প্রতিবেদন ।।
সাম্প্রতিক কালে ধর্মীয় অবমাননার ধুয়ো তুলে একশ্রেণীর ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর হিন্দু সম্প্রদায়ের বসতবাড়িতে হামলা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট আর ধর্মীয় উপসনালয় তছনছ-মূর্তি ভেঙে দেয়ার ঘটনা নিয়ে এখনও প্রতিবাদ নিন্দা ধিক্কার থামে নি। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রামে এ ধরনের হামলা চলছে বছরের পর বছর। অন্য কোন ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর দ্বারা নয়, এখানে হামলা-লুটপাট সংঘটিত হচ্ছে খোদ রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা রক্ষার ধুয়ো তুলে একশ্রেণীর সেনা কর্মকর্তা পার্বত্য চট্টগ্রামে খেয়াল খুশি চরিতার্থ করে চলেছে, সেনা লেবাসে এরা আসলে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত–যার খবর দেশবাসী খুব কমই জানে।

গত ২০ নভেম্বর ২০১৬ বিকাল চারটায় মাটিরাঙ্গার কাপপাড়া নামক এক ত্রিপুরা গ্রামে ঢুকে সেনা জওয়ানরা ‘কেরপূজা’র উদ্দেশ্যে রক্ষিত চাল মাটিতে ঢেলে ফেলে দিয়ে পূজার অর্ঘ্য ভণ্ডুল করে দেয়। পাড়াটিতে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা হচ্ছে ৩০। নিরাপত্তার উছিলায় তল্লাশির নামে সেনা জওয়ানরা পাড়ার ১৪ পরিবারের চাল ঢেলে মাটিতে ফেলে দেয়। পূজার উদ্দেশ্যে অর্ঘ্য হিসেবে বিশেষ পাত্রে চাল সংরক্ষণ করতে হয়। গ্রামবাসীর অনেক অনুনয় বিনয় সত্তে¡ও সেনা জওয়ানরা তাতে কর্ণপাত করে নি, তল্লাশির নামে একে একে ১৪ পরিবারের বাড়িতে ঢুকে চাল ঢেলে ফেলে দেয়। এখানে উল্লেখ্য যে, পাড়ার অধিবাসীদের অমঙ্গল ও বিপদ থেকে রক্ষার্থে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে ‘কেরপূজা’ অনুষ্ঠিত হয়। প্রথা অনুযায়ী এ সময় গ্রামের লোক অন্য এলাকায় যেতে পারে না, আর বাইরের কোন লোক বা বহিরাগতও উক্ত পাড়ায় ঢুকতে পারে না। ‘কেরপূজা’র অর্ঘ্য হিসেবে রক্ষিত চালে হাত দেয়া শাস্ত্র বিরুদ্ধ এবং তাতে অমঙ্গল হয়।

ঘটনার দিন মাটিরাঙ্গার ব্যাঙমারা সেনা ক্যাম্প থেকে মেজর রাহাতের নেতৃত্বে এক দল জওয়ান তল্লাশি চালানোর নামে কাপপাড়ায় গিয়ে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের ‘কেরপূজা’ ভেস্তে দেয়। তল্লাশি শেষে ক্যাম্পে ফিরে যাবার সময় সেনা জওয়ানরা ঘটনা প্রচার না করতে গ্রামবাসীকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে যায়। খবর জানাজানি হলে অসুবিধে হবে, ক্যাম্পে বড় অঙ্কের জরিমানা দিতে হবে বলে কঠোরভাবে শাসায়। এতে পাড়াবাসী দারুণ মনক্ষুন্ন হয়েছেন। তল্লাশি চালানোর নামে এভাবে একে একে ১৪ পরিবারের চাল মাটিতে ঢেলে ফেলে পরীক্ষার কোন দরকার ছিল না। বহু কষ্টে সংরক্ষিত চাল সেনা জওয়ানরা নষ্ট করে দিল, আবার হুমকিও দিয়ে গেল বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পাড়ার এক লোক মন্তব্য করেছেন। তিনি আক্ষেপ করে এও বলেছেন ‘ক্ষতিপূরণ তো তাদেরই দেয়ার কথা। অথচ জরিমানার ভয় দেখিয়েছে, আমরা তো কোন অপরাধ করি নি।’

কাপপাড়ার ঘটনার বিবরণ শুনে মাটিরাঙ্গার স্থানীয় পিসিপি’র এক নেতা সিএইচটি নিউজ.কম’কে ফোনে জানিয়েছেন,‘যারা রক্ষক তারাই ভক্ষক। দুর্বলদের ওপর নানাভাবে অত্যাচার চলছে।’ পিসিপি নেতা আরো প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘সেনা ক্যাম্প থেকে জরিমানার ভয় দেখায়, তার মানে কী? তারা নিজেরা ধর্মীয় অবমাননা করে অপরাধ করেছে, তার কোন অনুশোচনা নেই। আবার জরিমানার হুমকি। একেই বলে চোরের মা’র বড় গলা। জরিমানা আসলে সেনারাও চাঁদাবাজিতে যুক্ত সেটাই বোঝা যাচ্ছে।’ কাপপাড়ার ‘কেরপূজা’ অবমাননার ঘটনাটি কোন সংবাদ মাধ্যমেও প্রকাশ পায় নি। উক্ত ঘটনায় ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। এলাকার অন্য সম্প্রদায়ও উক্ত ঘটনা নিজেদের ওপর আঘাত হিসেবে বিবেচনা করছে। ভবিষ্যতে আরো অন্য কোন পাড়ায়ও এমন ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে বলে লোকজন আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।

মাটিরাঙ্গার কাপপাড়ায় ‘কেরপূজা’ সেনা জওয়ান কর্তৃক ভণ্ডুল করে দেয়ার ঘটনা মোটেও সাধারণ তুচ্ছ ব্যাপার নয়। কক্সবাজারের রামু-কক্সবাজারসহ সারাদেশে ব্রাহ্মনবাড়িয়ার নাসিরনগর ও অন্যান্য জায়গায় হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান সম্প্রদায়ের ওপর হামলাকারীদের সরকার জঙ্গী ও ধর্মান্ধ বলে আখ্যায়িত করেছে। কতক ক্ষেত্রে হামলাকারীদের সাজাও হচ্ছে। কাপপাড়ায় ‘কেরপূজা’ অবমাননাকারী মেজর পদমর্যাদার সেনা কর্মকর্তাও আসলে একই গোয়ালে গরু। সরকার অন্যত্র মন্দির-কিয়্যঙ-এ হামলাকারীদের জঙ্গী সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করলেও, পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্মীয় উপসনালয়ে হামলাকারী কল্পনা’কে অপহরণকারী সেনা কর্মকর্তাদের ব্যাপারে মুখ খোলে না। বরং মৌনতা অবলম্বন করে অপরাধ সংঘটনে প্রশ্রয় দেয়, তার পরিণতি ভাল হবে না।#
——————–

সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.