রাঙামাটিতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার দাবিতে মানববন্ধন করেছে ভুক্তভোগীরা

0

রাঙামাটি প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
বুধবার, ১৮ জানুয়ারি ২০২৩

মানববন্ধনে দাঁড়িয়েছেন দীঘিনালার বাবুছড়ায় বিজিবি কর্তৃক উচ্ছেদ হওয়া ২১ পরিবারের সদস্যরা

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদসহ অন্য সদস্যদের রাঙামাটি সফর ও কমিশনের গণশুনানি উপলক্ষে রাঙামাটি সদরের সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের সামনে মানববন্ধন করেছেন রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির বিভিন্ন এলাকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হওয়া ভুক্তভোগী জনগণ।

আজ বুধবার (১৮ জানুয়ারি ২০২৩) সকাল ১০টা থেকে দুপুর পর্যন্ত এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। অপরদিকে সকাল ১১টায় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট হলরুমে শুরু হয় কমিশনের গণশুনানি অনুষ্ঠান।

মানববন্ধনে ভূমি বেদখল প্রচেষ্টার শিকার দজর পাড়া এলাকাবাসী।

মানববন্ধনে অংশ্রগ্রহণ করেন খাগড়াছড়িরে দীঘিনালার বিজিবি ক্যাম্প স্থাপনে ক্ষতিগ্রস্ত ২১ পরিবার, ২০১৮ সালে খাগড়াছড়ি সদরের স্বনির্ভর বাজারে হত্যাকাণ্ডে নিহতদের পরিবার ও স্বজনরা, রাষ্টীয় সংস্থা কর্তৃক গুম হওয়া ইউপিডিএফ নেতা মাইকেল চাকমার পরিবার, মহালছড়ির বিভিন্ন এলাকার ভূমি বেদখলের ক্ষতিগ্রস্ত ভুক্তভোগীরা, খাগড়াছড়ি বলপিয়া আদামের সেটেলার কর্তৃক গণধর্ষণের শিকার হওয়া প্রতিবন্ধী ভিকটিমের মা এবং রাঙামাটির নান্যাচরের বগাছড়িতে ২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর সেটেলার হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার, দজর পাড়ার ভূমি বেদখলের শিকার হওয়া ভূমির মালিকসহ রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মদদপুষ্ট ঠ্যাঙারে বাহিনী কর্তৃক বিভিন্ন হয়রানির শিকার হওয়া ভুক্তভোগীরা।

মানববন্ধনে অংশ নিয়েছেন খাগড়াছড়ির স্বনির্ভরে হত্যাকাাণ্ডে নিহতদের পরিবার ও স্বজনরা।

মানববন্ধনে অংশ্রগ্রহণকারীরা পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার ও মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করা, বেদখলকৃত ভূমি ফেরত ও ভূমি বেদখল বন্ধসহ বিভিন্ন দাবি সম্বলিত ব্যানার ও পোস্টার প্রদর্শন করেন।

বগাছড়ি এলাকাবাসীর ব্যানারে লেখা ছিল “১৬ ডিসেম্বর ২০১৪ বগাছড়ি অগ্নিকাণ্ডের বিচার কর, মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ কর ও বিচার কর”

মাইসছড়ি ভূমি রক্ষা কমিটির ব্যানারে লেখা ছিল “সেটলার বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনক পুনর্বাসন কর, পাহাড়িদের প্রথাগত ভূমি অধিকারের স্বীকৃতি ও বেদখলকৃত ভূমি ফেরত দাও”।

মানববন্ধনে মাইসছড়ি ভূমি রক্ষা কমিটির ব্যানারে সেখানকার ভূমি বেদখলের শিকার এলাকাবাসী।

দীঘিনালা বিজিবি কর্তৃক উচ্ছেদ হওয়া ২১ পরিবারের ব্যানারে লেখা ছিল “নামে নিরাপত্তা ও উন্নয়ন, আসল উদ্দেশ্য পাহাড়ি উচ্ছেদ; নিরাপত্তা ও সেনা ক্যাম্প স্থাপনের নামে পাহাড়িদের ভূমি বেদখলের ষড়যন্ত্র বন্ধ কর”।

স্বনির্ভর হত্যাকাাণ্ডে নিহতদের পরিবার ও স্বজনদের ব্যানারে লেখা ছিল “১৮ আগস্ট ২০১৮ স্বনির্ভর হত্যাকাণ্ডের বিচার কর, মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ কর, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাও”।

মানববন্ধনে নান্যাচর উপজেলার বগাছড়িতে সেটলার হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসী

এছাড়া প্রদর্শিত পোস্টার-প্ল্যাকার্ডে “খাগড়াছড়ির স্বনির্ভর গণহত্যার বিচার কর; দীঘিনালার বিজিবি ক্যাম্প স্থাপনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারে ভূমি ফেরত ও ক্ষতিপুরণ দাও; সেটেলার কর্তৃক বেদখলকৃত ভূমি ফেরত দাও; রাষ্টীয় বাহিনী কর্তৃক গুম হওয়া ইউপিডিএফ নেতা মাইকেল চাকমাকে ফেরত দাও; ইউপিডিএফ নেতা মিঠুন চাকমা হত্যায় জড়িতদের গ্রেফতার কর; রাষ্টীয় বাহিনী কর্তৃক সৃষ্ট ঠ্যাঙারে বাহিনী ভেঙ্গে দাও; বগাছড়িতে সেটেলার কর্তৃক ১৬ ডিসেম্বর ২০১৪ সালের পাহাড়ি গ্রামে অগ্নিসংযোগকারীদের বিচার কর; সেনা-র‌্যাবগ নয়, পূর্ণস্বায়ত্বশাসন চাই, পাহাড়িদের প্রথাগত ভূমি অধিকারের স্বীকৃতি দাও, সেটেলারদের সম্মানজনকভাবে সমতলে পূনর্বাসন কর; ভারত প্রত্যাগত শরনার্থীদের ভূমি ফেরত দাও; ছাত্রনেতা রমেল হত্যার বিচার কর; জেলগেট থেকে গ্রেফতার বন্ধ কর; এপি ব্যাটেলিয়ন ক্যাম্প স্থাপন বন্ধ কর” ইত্যাদি দাবি সম্বলিতে শ্লোগান লেখা ছিল।

পুলিশ সদস্যদের মানববন্ধনের ছবি তুলতে দেখা যাচ্ছে। 

মানববন্ধনে মহালছড়ি থেকে অংশ নেওয়া মোহন চাকমা সাংবাদিকদের বলেন, সেটলার বাঙালিরা আমাদের জায়গা কেড়ে নিয়ে উচ্ছেদ করছে, মারপিট করে বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের জায়গা-জমি ফেরত চাইতে আজকে আমরা এখানে এসেছি।

সাজেক এলাকা থেকে অংশ নেওয়া এক গ্রামবাসী বলেন, সীমান্ত সড়ক নির্মাণ করে আমাদের ঘরবাড়ি, দোকান উচ্ছেদ করা হয়েছে, বাগান কেটে দেওয়া হয়েছে কিন্তু আমরা ক্ষতিপূরণ পাইনি। বর্তমানে সেখানে আর্মি, বিজিবি ও বনবিভাগ থেকে বাড়িঘর করা যাবে না বলে সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। কেন আমরা আমাদের জায়গায় বাড়িঘর নির্মাণ করতে পারবো না? কেন আমরা ক্ষতিপূরণ পাবো না?

বয়স্ক ব্যক্তিবর্গও মানববন্ধনে অংশ নিয়ে পোস্টার হাতে দাঁড়িয়েছেন।

তিনি আরো বলেন, সাজেকের শিজক ছড়ায় সরকার রাবার ড্যাম করার পরিকল্পনা নিচ্ছে। সেখানে যদি রাবার ড্যাম করা হয় তাহলে আমরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হবো। কাপ্তাই বাঁধের মতো আমাদের ঘরবাড়ি, বাগান-বাগিচা, জায়গা-জমি সব পানিতে তলিয়ে যাবে, আমাদের সেখান থেকে উদ্বাস্তু হতে হবে।

এদিকে কমিশনের আয়োজিত গণশুনানিতে অংশ নিয়ে খাগড়াছড়ির বলপিয়ে আদামে গণধর্ষণের শিকার প্রতিবন্ধী নারীর মা পুষ্প রাণি চাকমা ২ বছরেও তার মেয়ের ধর্ষণ ঘটনার ন্যায়বিচার না পাওয়ার অভিযোগ করেন।

গণশুনানিতে অংশ নিয়ে কাউখালী উপজেলার ফটিকছড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ঊষাতন চাকমা বলেন, কাউখালী উপজেলায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ছত্রছায়ায় কিছু দুর্বৃত্ত আমাদেরকে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে হুমকি-ধমকি, চাঁদা দাবিসহ নানা হয়রানি করে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। গত ডিসেম্বর মাসের ২০ তারিখে একেবারে উপজেলা প্রশাসন অফিসের পিছন থেকে একজন নিরীহ লোককে ধরে নিয়ে ৩ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। তাকে ধরে নিয়ে একেবারে আর্মি ক্যাম্প ও থানার পাশে নিয়ে আটকে রাখা হয়। পরে ডিজিএফআইয়ের লোকজনের সাহায্যে সন্ত্রাসীরা তাকে নান্যাচরে নিয়ে যায়। পরে তাকে সেখান থেকে ৩ লক্ষ টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে ছেড়ে দেয়।

তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে মানবাধিকার চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ্যে করে বলেন, আজকে এখানে বক্তব্য দেয়ার কারণে হয়তো কিছুদিন আগে শুনতে পাবেন যে, উষাতন চাকমা নামে এক চেয়ারম্যানকে ইউপিডিএফ কিংবা জেএসএস সন্ত্রাসী বানিয়ে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। ফলে আমরা স্বস্তিতে জনসেবার কাজও করতে পারছি না।

অপর এক ব্যক্তি গণশুনানিতে অংশ নিয়ে ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থীদের পুনর্বাসন ও তাদের ঋণ মওকুফের বিষয়ে সরকার ২৫ বছরেও কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি আরো বলেন, এখানে আর্মির উপস্থিতিতে, পুলিশের উপস্থিতিতে ঘর পুড়ে দেওয়া হয়। তাহলে এখানে মানবাধিকার কোথায়? ইসলামী করণের মাধ্যমে এ অঞ্চলকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন।

গণশুনানিতে রাঙামাটির কাউখালী এলাকাবাসীর পক্ষে ফটিকছড়ি ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিগণ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানকে একটি লিখিত অভিযোগ দেন। এতে তারা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নাম ভাঙ্গিয়ে ‘গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ’ নামধারী একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠির সদস্য মার্টিন চাকমা নামের এক সন্ত্রাসী উপজেলার জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী ও সাধারণ লোকজনকে হুমকি-ধমকি, অপহরণ, চাঁদা দাবিসহ বিভিন্ন অপকর্ম করে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন এবং এর থেকে প্রতিকার পাওয়ার আবেদন জানান।

গণশুনানিতে বক্তব্য রাখছেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ।

রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মিজানুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত গণশুনানিতে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ।

তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন অভিযোগ সম্পর্কে শুনলাম। অনেকে অনেক অভিযোগ করেছেন। পুষ্প রাণি চাকমা যে ঘটনাটির কথা তুলে ধরেছেন তাতে আমাদের মনেও যথেষ্ট কষ্ট লেগেছে। তিনি উত্থাপিত সকল বিষয় বিশ্লেষণ করে দেখবেন বলে জানান।

শুনানীতে আরো উপস্থিত ছিলেন, কমিশন সচিব (যুগ্ম সচিব) নারয়ণ চন্দ্র সরকার, সার্বক্ষণিক সদস্য মো. সেলিম রেজা. সদস্য কাওসার আহমেদ, মো. আমিনুল ইসলাম, রাঙামাটি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অংসুই প্রু চৌধুরী ও রাঙামাটি পুলিশ সুপার মীর আবু তৌহিদ প্রমুখ।

* মানববন্ধনের ভিডিও:


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।


সিএইচটি নিউজের ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More