লামায় ম্রো-ত্রিপুরা ও রাবার কোম্পানির ভূমি জটিলতা সংশ্লিষ্ট এলাকা পরিদর্শন সংসদীয় কমিটির

0

বান্দরবান প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
বৃহস্পতিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৩

কথা বলছেন পরিদর্শন টিমের প্রধান চট্টগ্রাম-৬ আসনের সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী।

বান্দরবান লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নে ৪০০ একর ভূমি নিয়ে ম্রো-ত্রিপুরা জনগোষ্ঠির সাথে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কোম্পানির জটিলতা সংশ্লিষ্ট এলাকা পরিদর্শন করেছে জাতীয় সংসদের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ২নং সাব-কমিটির একটি প্রতিনিধি দল।

গতকাল বুধবার (২৬ এপ্রিল ২০২৩) সকাল ১১টায় চট্টগ্রাম-৬ আসনের এমপি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের সংসদীয় কমিটির প্রতিনিধি দল সরই ইউনিয়নের রেংয়েন ম্রো কারবারি পাড়ায় পৌঁছান। দলের অন্য দুই সদস্য হলেন রাঙামাটি আসনের এমপি দীপংকর তালুকদার ও তিন পার্বত্য জেলার সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি বাসন্তী চাকমা। তবে সাব-কমিটির আরেক সদস্য খাগড়াছড়ি আসনের সাংসদ কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা উপস্থিত ছিলেন না।

সংসদীয় কমিটির সাথে এ সময় বান্দরবান জেলা পরিষদের সদস্য সিংয়ং ম্রো, জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তীবরীজি, পুলিশ সুপার তরিকুল ইসলাম পিপিএম, লামা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. মোস্তফা জামাল, থানচি উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান খামলাই ম্রো, রাংলাই ম্রো, গজালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাথোয়াইচিং মারমা ও সরই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইদ্রিস প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

অপরদিকে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কর্তৃক ভূক্তভোগী কার্বারী রেংয়েন ম্রো, রেংইয়ুঙ ম্রো, রিংরং ম্রো, ইমচ্যং ম্রো, দুইথং ম্রো, সংলেহ ম্রো, ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রংধজন ত্রিপুরাসহ ক্ষতিগ্রস্ত ও এলাকার নারী পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধসহ উপস্থিত ছিলেন।

এ সময় পরিদর্শন টিমের আহ্বায়ক এমপি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর নিকট লামা সরই ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটি ও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসী একটি স্বারকলিপি পেশ করেন। এতে তারা ম্রো এবং ত্রিপুরাদের বংশপরম্পরায় ভোগ দখলীয় ৪০০ একর জুম ভূমি বেদখলের ষড়যন্ত্র বন্ধ করা এবং লাংকম ম্রোকে নিঃশর্ত মুক্তি ও দায়েরকৃত সকল ষড়যন্ত্রমূলক মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান।

তার আগে সকাল ১০টা হতে ভুক্তভোগীরা “লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের অন্যায়, উৎপীড়ন ও ভূমি দস্যুতা থেকে আমাদের রক্ষা করুন” আবেদনে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ২ নং সাব-কমিটির সদস্যবৃন্দকে স্বাগতম’ ব্যানার নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে সংসদীয় পরিদর্শন দলের জন্য অপেক্ষা করেন। এ সময় তারা প্ল্যাকার্ডে ‘৪০০ একর জমি বেদখলের ষড়যন্ত্র বন্ধ কর; লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের লিজ বাতিল কর; রাবার বাগান করে পরিবেশ ধ্বংস বন্ধ কর; জুম, বাগান-বাগিচা ও ঘরবাড়ি ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ চাই; রাবার বাগানের নামে ভূমি বেদখল বন্ধ কর; বন ধ্বংসকারী লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের শাস্তি চাই; ৪০০ একর জমি আমাদের, এ জমি কেড়ে নিতে দেব না; কোম্পানির দায়ের করা হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা তুলে নাও; অবিলম্বে লাংকম ম্রোকে মুক্তি দাও; হামলাকারী লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের শাস্তি চাই’ ইত্যাদি দাবি-দাওয়া তুলে ধরেন।

সংসদীয় সাব-কমিটির পরিদর্শন টিম ম্রো, ত্রিপুরা, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের লোকজন, সংশ্লিষ্ট হেডম্যান, কারবারি ও জনপ্রতিনিধিদের কথা শুনেন। এ সময় কমিটির আহ্বায়ক এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী জনপ্রতিনিধিদের তথ্যের ভিত্তিতে বলেন, “যেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রামে সম্পাদিত চুক্তির পর থেকে এখানে ভূমি বন্দোবস্তি বন্ধ রয়েছে, সেহেতু সংসদীয় স্থায়ী কমিটির মাধ্যমে প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে ৩৬টি ম্রো-ত্রিপুরা পরিবারকে ২০৬ একর ভূমি বন্দোবস্তি দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে।”

তিনি “বিষয়টি দ্রুত সময়ে মিমাংসা করা দরকার, অন্যথায় সময় যত গড়াবে সবাই তত ক্ষতিগ্রস্ত হবে” বলেও মন্তব্য করেন।

তবে ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটি ও এলাকার ম্রো-ত্রিপুরা পাড়াবাসীরা উক্ত ৪০০ একর ভূমি তাদেরই প্রাপ্য বলে দাবি করেছেন।

সংসদীয় পরিদর্শন টিমের উদ্দেশ্যে রেংয়েন পাড়া প্রধান রেংয়েন কারবারি বলেন, এই ৪০০ জুম ভূমি হচ্ছে আমাদের প্রাণ। এই ভূমিতে আমাদের জন্ম। যুগ যুগ ধরে আমরা এখানে বসবাস করে আসছি। কিন্তু বিধি বাম আমরা আজ নিজভূমে পরবাসী। লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লোকেরা আমাদের ঘরবাড়ি ও বিহারে অগ্নিসংযোগ ও হামলা, লুটপাট চালিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা ক্ষতি সাধন করেছে এবং ঝিরিতে বিষ ঢেলে দিয়ে মানুষ হত্যার চেষ্টা করেছে। সবসময় পাড়াবাসীদের হুমকি-ধমকি ও ভয়-ভীতি দেখানো হচ্ছে। আমরা কোন সঠিক বিচার পাচ্ছি না।

ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক রংধজন ত্রিপুরা বলেন, আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী ও বান্দরবানের এমপি’র ভূমিকা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। সরইয়ে ম্রো এবং ত্রিপুরাদের দুর্দিনের সময় তিনি নীরব ভূমিকা পালন করছেন।

তিনি আরও বলেন, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ ত্রিপুরা ও ম্রোদের নামে ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা দিয়ে ভূমি থেকে উচ্ছেদের পাঁয়তারা করছে। সেই মিথ্যা মামলায় লাংকম পাড়ার প্রধান ও ভূমি রক্ষা কমিটির নেতা লাংকম ম্রোকে বিনা অপরাধে কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে।

ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির নেতা রিংরং ম্রো বলেন, আমরা সব সময় একধরনের অনিশ্চিত জীবন ও আতঙ্কের মধ্যে দিন পার করছি। আমরাতো এ দেশের নাগরিক। স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারি না। লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ পরিকল্পিত মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাদের হয়রানি করে যাচ্ছে। এর থেকে আমরা মুক্তি চাই।

উল্লেখ্য, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের কোম্পানি কর্তৃক ২০২২ সালের ৯ এপ্রিল থেকে লামা সরই ইউনিয়নে বসবাসরত ম্রো ও ত্রিপুরাদের ভোগদখলীয় ৪০০ একর জুমভূমি জোরপূর্বক বেদখলের প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। ইতোমধ্যে কোম্পানির লেলিয়ে দেয়া দুর্বৃত্ত কর্তৃক জুমভূমিতে আগুন দিয়ে বাগান-বাগিচা, খেত ও প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করে দেয়া, ভূমি রক্ষায় আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি, পাড়াবাসীদের নির্মিত বৌদ্ধ বিহার ভাঙচুর, পানির উৎস ঝিরিতে বিষপ্রয়োগ, বাগান কেটে দেয়া, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ-ভাঙচুরসহ নানা অত্যাচার সংঘটিত করা হয়েছে। এছাড়া কোম্পানির দায়েরকৃত মিথ্যা মামলায় ইতোমধ্যে ভূমি রক্ষা আন্দোলনের নেতা মথি ত্রিপুরা ও লাংকম পাড়ার কার্বারি লাংকম ম্রোকে আটক করে জেল হাজতে প্রেরণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে মথি ত্রিপুরা জামিনে মুক্তি পেলেও লাংকম ম্রো এখনো কারাগারে বন্দি অবস্থায় রয়েছেন।

গত ১ জানুয়ারি দিবাগত মধ্য রাতে রাবার কোম্পানির লেলিয়ে দেয়া দুর্বৃত্ত কর্তৃক ম্রো পাড়াবাসীদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ-ভাঙচুরের ঘটনা ঘটলে পরবর্তীতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন দু’দফায় উক্ত এলাকা পরির্দশন করে পাড়াবাসীদের আশ্বস্ত করেছিলেন। তার আগে গত বছর বান্দরবান জেলা পরিষদ কর্তৃক গঠিত কমিটি উক্ত এলাকা পরিদর্শন করে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের জমি লিজ বাতিলের সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু ম্রো ও ত্রিপুরা পাড়াবাসীরা এখনো এর কোন প্রতিকার পাননি বরং প্রতিনিয়ত হুমকি-ধমকিসহ নানা হয়রানির শিকার হচ্ছেন।


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।


সিএইচটি নিউজের ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More