খাগড়াছড়ি : ‘শিক্ষাঙ্গনে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হোন’ এই আহ্বানে সকল জাতিসত্তার মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালুসহ শিক্ষা সংক্রান্ত ৫ দফা পূর্ণবাস্তবায়নের দাবিতে খাগড়াছড়িতে ছাত্র সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ(পিসিপি) খাগড়াছড়ি জেলা শাখা।
আজ শনিবার (১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮) সকাল সাড়ে ১০টায় খাগড়াছড়ি সদরের স্বনির্ভরে শহীদ অমর বিকাশ সড়কে ছাত্র সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ৬ শতাধিক ছাত্র-ছাত্রী অংশগ্রহণ করেন।
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সভাপতি তপন চাকমার সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক অমল ত্রিপুরার সঞ্চালনায় সমাবেশে বক্তব্য রাখেন, পিসিপি’র সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ও বর্তমানে ইউপিডিএফএর সংগঠক মিল্টন চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের খাগড়াছড়ি জেলা সভাপতি দ্বিতীয়া চাকমা, পিসিপি খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজ শাখার সদস্য জেসিম চাকমা। এছাড়া মঞ্চে আরো উপস্থিত ছিলেন গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম খাগড়াছড়ি জেলা সাধারণ সম্পাদক অতুল চাকমা।
সমাবেশে ইউপিডিএফ সংগঠক মিল্টন চাকমা বলেন ১ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এসএসসি পরিক্ষার সব প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। সরকার জাতির নেতৃত্বকে দূর্বল ও ধ্বংস করার জন্য প্রশ্ন ফাঁসসহ নানা ধরনের ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে।
সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে উপনিবেশিক শাসন জারি রেখেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইউপিডিএফকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করার জন্য সেই ৯৮ সাল থেকে ইউপিডিএফ সদস্যদের উপর নির্যাতন-নিপীড়ন, খুন-গুম চালিয়ে যাচ্ছে শাসকশ্রেণী। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই- নির্যাতন-নিপীড়ন, খুন-গুম করে পার্বত্য চট্টগ্রামের ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে দমন করা যাবে না। গ্রেপ্তার করে, নিপীড়ন-নির্যাতন চালিয়ে, খুন করে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের আন্দোলনকে দমন করা যায়নি। পিসিপি’র আন্দোলনের বীজ থেকে জন্ম নেওয়া ইউপিডিএফকেও দমন করা যাবে না।
তিনি আজ সকালে হরিনাথ পাড়ায় সেনাসৃষ্ট নব্য মুখোশবাহিনীর কর্তৃক ইউপিডিএফ সদস্যকে গুলি করে হত্যার তীব্র নিন্দা জানান। তিনি বলেন, চাকমা রানী ইয়েন ইয়েনের উপর হামলার ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য ইউপিডিএফ সদস্যকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তিনি রাণী ইয়েন ইয়েন এর উপর হামলাকারী সেনা-পুলিশ সদস্যদের শাস্তির দাবি করেন।
ইউপিডিএফ নেতা আরো বলেন, ‘চুক্তির মধ্যে দিয়ে জুম্ম জনগণের অধিকার অর্জিত হয়নি’ এই কথা আমরা ১৯ বছর আগেও বলেছিলাম, এখনো বলছি। তাই পূর্ণস্বায়ত্তশাসন আন্দোলন-দাবির স্বপক্ষে সমর্থন ও অধিকার আদায়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণস্বায়ত্তশাসন আদায়ের আন্দোলনে যোগ্য হয়ে উঠার জন্য ছাত্র সমাজের প্রতি আহ্বান জানান।
দ্বিতীয়া চাকমা বলেন, একটি ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ষড়যন্ত্রকারী চক্রটি পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন ইস্যু সৃষ্টি করছে। রাণী ইয়েন ইয়েন উপর হামলা করে, রাষ্ট্র তার আসল চেহারা উম্মোচন করেছে। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কাছে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের সম্মানের কোনো দাম নেই। তিনি বিলাইছড়িতে সেনাকর্তৃক ধর্ষণের শিকার মারমা নারীদের রাঙামাটি হাসপাতাল থেকে অপহরণকারী ও রাণী ইয়েন ইয়েন এর উপর হামলাকারীদের শাস্তির দাবি জানান।
তপন চাকমা বলেন, ফেব্রুয়ারি মাস ভাষার মাস, ফেব্রুয়ারি আমাদের মাতৃভাষার চেতনাকে জাগ্রত করে। পিসিপি’র দীর্ঘ আন্দোলনের ফলে সরকার ৬টি জাতিসত্তার মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষার কার্যক্রম চালু করেছে। ৬টি মাতৃভাষায় শিক্ষাকার্যক্রম চালু করা হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাকি জাতিসত্তাগুলোর মাতৃভাষার শিক্ষাকার্যক্রম এখনো চালু হয়নি। যা চালু হয়েছে তাও সরকারের তদারকি ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ না দেওয়ার কারণে অচল অবস্থায় রয়েছে।
তিনি বলেন, মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের জন্য পিসিপি’র আন্দোলনে শহীদ মিঠুন চাকমা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। সরকার এখনো পর্যন্ত মিঠুন চাকমা হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি। এই সন্ত্রাসীরা আজ আবার হরিনাথ পাড়ায় ইউপিডিএফ সদস্য বিনয় চাকমাকে গুলি করে হত্যা করেছে। তিনি বলেন, এই সরকার, এই রাষ্ট্র জুম্ম জনগণের পক্ষে নয়। তাই আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়ন-নির্যাতনের অবসান ঘটাতে হবে।
তিনি বিলাইছড়িতে সেনা কর্তৃক ধর্ষণের শিকার দুই মারমা নারীর ছবি ফেসবুকে প্রকাশ করায় রাঙামাটি এসপি’র তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি বলেন একজন আইনের লোক হয়েও এসপি কা-জ্ঞানহীন ও আইনপরিপন্থি কাজ করেছেন। তাকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দিতে হবে।
সমাবেশ থেকে তিনি সকল জাতিসত্তার মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা চালু, শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ও পিসিপি’র শিক্ষা সংক্রান্ত ৫দফা পূর্ণবাস্তবায়নের দাবি জানান।
সমাবেশ শেষে দুপুর সমাবেশ স্থল থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি রেড স্কোয়ার-উপজেলা-খাগড়াছড়ি কলেজ গেইট-চেঙ্গি স্কোয়ার ঘুরে পূনরায় সমাবেশ স্থলে এসে শেষ হয়।
উল্লেখ্য, পিসিপি’র শিক্ষা সংক্রান্ত ৫ দপা দাবি হচ্ছে- পার্বত্য চট্টগ্রামে সকল জাতিসত্তার মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা লাভের অধিকার নিশ্চিত করা; জাতিসত্তার প্রতি অবমাননাকর যেকোন বক্তব্য পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেয়া; পাহাড়ি জাতিসত্তার সঠিক ও সংগ্রামী রাজনৈতিক ইতিহাস সম্ভলিত পুস্তক পার্বত্য চট্টগ্রামের স্কুল ও কলেজের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভূক্ত করা; বাংলাদেশের সকল জাতিসত্তার সংক্ষিপ্ত সঠিক তথ্য সম্ভবলিত পরিচিতিমূলক পুস্তক বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভূক্ত করা ও পার্বত্য কোটা বাতিল করে পাহাড়ি কোটা চালু করা।
—————–
সিএইচটিনিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্রউল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।