সুপ্রভাত বাংলাদেশ রিপোর্ট ।।
৬০৭ বর্গমাইল আয়তনের দেশের বৃহত্তম সাজেক ইউনিয়নের অধিকাংশ মানুষই বসবাস করেন দারিদ্র্যসীমার নিচে, আর জীবিকা হিসেবে একমাত্র অবলম্বন জুম চাষ দুর্গম পাহাড়ি গ্রামগুলোতে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যমও হাঁটাপথ। প্রতি বছরের বর্ষা মৌসুমের আগ থেকেই এসব এলাকায় স্থানীয় খাদ্যের সংকট বাড়তে থাকে। আর যদি জুমের ফলন প্রত্যাশিত না হয় তাহলে তো দুঃখের কোন সীমা থাকে না।
বেটলিং, লংকর, নিউ লংকর, থলছড়া, জপ্প্যিতাং, উদোলছড়ি, সাজেক ছড়া.. .. .. আরো কতো সুন্দর নাম। এগুলো সাজেকের সীমান্তবর্তী দুর্গম গ্রাম। যেখানে পৌঁছতে রুইলুই পর্যটন স্পট থেকে পায়ে হাঁটা পথে দেড় থেকে দুই দিন লেগে যায় স্থানীয়দের। এমন অভাবের দিনে মাচলং বাজার থেকে ৪৫ টাকায় কেনা এক কেজি চাল বেটলিং পৌঁছাতে খরচ পড়ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা। সেই চাল দরিদ্র মানুষের ঘরে পৌঁছাচ্ছে ১১০ থেকে ১৩০ টাকায়। এই অবিশ্বাস্য ঘটনা গত কয়েক মাস ধরেই বিদ্যমান আছে সাজেকে ইউনিয়নের বেশিরভাগ গ্রামেই। একেতো মানুষের হাতে টাকা নেই, তার ওপর খাদ্যের এমন ব্যয়বহুল সরবরাহ ব্যবস্থায় সাজেকবাসীর জীবনকে করে তুলছে অতিষ্ঠ। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, হেডম্যান ও কার্বারীদের মতে, সাজেক ইউনিয়নের ৪০ থেকে ৪৫টি গ্রামে এই অবস্থা বিরাজ করছে।
কজতলী পাড়ার কার্বারী কালাচাঁন ত্রিপুরা জানান, মূলত সাজেক ইউনিয়নের অধিকাংশ মানুষই বনজ সম্পদ আহরণ ও জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল। অনেক আগেই বনজ সম্পদ শেষ হয়ে গেছে। তাতে পানির উৎসও কমে যাচ্ছে ক্রমশ। জুমে ফলনও হয় না আগের মতো। ফলে জীবন নির্বাহের কঠিন এক সংগ্রামের দ্বারপ্রান্তে দুর্গম এলাকার বাসিন্দারা।
ইউপি সদস্য দেবজ্যোতি চাকমা বলেন, দেশ স্বাধীনের সাড়ে পাঁচ দশক পরও সাজেকে মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হয়নি। বিদ্যুৎ- যোগাযোগ এবং স্যানিটেশনের মতো প্রয়োজনীয় বিষয়াদি এলাকাবাসীর কাছে এখনো স্বপ্নের মতো।
বাঘাইহাট বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সংবাদকর্মী মো. জুয়েল জানান, সাজেকে তিনটি বাজারেই এখন ক্রেতা শূন্যতা বিরাজ করছে। কারণ দুর্গম এলাকার মানুষরা বেশ কয়েক বছর ধরেই জুমে ভালো ফলন পাচ্ছেন না। অপরদিকে যোগাযোগ দুর্গমতার কারণে উৎপাদিত যৎসামান্য পণ্যও হাটে-বাজারে আনতে পারছেন না। ফলে পণ্য বিণিময়ের যে প্রথা ছিল সেটিও অচল হয়ে পড়ায় সীমাহীন অর্থ সংকটে পড়েছেন দুর্গম এলাকার প্রান্তিক মানুষরা।
মাচলং বাজারের ব্যবসায়ী মো. ইমরান জানান, যেখানে প্রতি সপ্তাহে শুধু তাঁর দোকান থেকেই ৩০ বস্তা চাল বিক্রি হতো, সেখানে এখন ব্যবসা-বাণিজ্যে রীতিমতো ভাটা পড়েছে।
অরুণ কান্তি চাকমা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘আলো’র নির্বাহী পরিচালক। একই সাথে তিনি সাজেকের রুইলুইয়ে বেসরকারি পর্যায়ে প্রথম রিসোর্ট নির্মাতাও। তিনি দীর্ঘদিন ধরে সাজেকে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে দাবি করেন, সাময়িক কোন রেশনিং দিয়ে এই সমস্যার সমাধান মিলবে না। কারণ, বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসবাসরত প্রান্তিক মানুষদের জীবন-সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নয়ন কৌশল ছাড়া রাতারাতি কোন পরিবর্তন কল্পনা করা যাবে না।
তিনি এই সমস্যার সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে এলাকার মানুষদের স্থায়িত্বশীল ও প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে সম্পৃক্ত করার পরামর্শ দেন।
তিনি বলেন, এসব এলাকায় কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা গেলে ভালো। তাছাড়া বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ অবকাঠামোও জরুরি।
সাজেক ইউপি চেয়ারম্যান নেলসন চাকমা নয়ন বলেন, গত দুয়েকমাস হতে সাজেকের প্রায় ৫০টি গ্রামের ২ হাজারের অধিক পরিবারের মধ্যে তীব্র খাদ্য সংকট চলছে। এবিষয়ে উপজেলা পরিষদের মাসিক সমন্বয় সভায় বারবার বিষয়টি তুলেছি এবং ইউএনও বরাবরে খাদ্যসংকট মোকাবেলায় গত দু্ইমাস আগে ৬শ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য বরাদ্দ চেয়ে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছিলাম। এখন পর্যন্ত কোন সাড়া মিলেনি।
পরিস্থিতি সামাল দিতে এরিমধ্যে বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা নিজস্ব অর্থায়নে গত শনিবার (২২ এপ্রিল) খাদ্য সংকটের শিকার ১৬ গ্রামের ৪১০ পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল দেয়া হয়েছে। কিন’ তাতেও অবস্থার খুব বেশী পরিবর্তন ঘটেনি। সরকারিভাবে স্থায়িত্বশীল কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটানো গেলে ধীরে ধীরে অবস্থার উন্নতি হবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তাজুল ইসলাম বলেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা দুর্গম এলাকার খাদ্য সংকটের বিষয়ে আমাকে জানিয়েছেন। এবিষয়ে আমি জেলা প্রশাসক স্যারকে জানিয়েছি। ইতিমধ্যে জরুরি ভিত্তিতে উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের নিজস্ব চাঁদা তুলে চার মেট্রিক টনেরও বেশি চাল দেওয়া হয়েছে।
বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বড় ঋষি চাকমা বলেন, সাজেকের খাদ্যাভাব সর্ম্পকে আমাকে সাজেকের চেয়ারম্যান জানিয়েছেন এবং এ বিষয়ে আমি জেলা প্রশাসন ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়েও চিঠি দিয়েছি। আশা করছি দ্রুত সরকারি সাহায্য এসে পৌঁছাবে আপনাদের খাদ্যাভাব কিছুটা হলেও লাঘব হবে।
বড়ঋষি চাকমা দাবি করেন, দুর্গম এলাকার জুম চাষিদের আগের তুলনায় ফসলের ফলন অর্ধে কমে এসেছে। জুমের ফলন কম ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া ওই সব এলাকায় এখন ৮০ টাকা ধরেও চাল পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু সাজেক ইউনিয়ন নয়, বিভিন্ন ইউনিয়নে দুর্গম এলাকা বসবাসরতদের চরম খাদ্য সংকট চলছে বলে স’ানীয় জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সূত্রে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
————-
সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।