সাজেকে সংরক্ষিত বনের তিন-চতুর্থাংশ ধ্বংস হয়েছে: সচিব চাকমা

0
63

নিজস্ব প্রতিবেদক, সিএইচটি নিউজ
মঙ্গলবার, ৯ মে ২০২৩

সাজেক ইউনিয়নের কালূ লুনথিয়াঙ পাড়া এলাকায় মৌনের পাহাড়ে জুমে আগুন দেওয়া হয়েছে।

রাঙামাটি জেলার সাজেকে সংরক্ষিত বনের তিন-চতুর্থাংশ ধ্বংস হয়েছে বলে মনে করেন ইউপিডিএফ নেতা সচিব চাকমা।

সম্প্রতি সাজেকের বিস্তীর্ণ এলাকা ঘুরে এসে তিনি সিএইচটি নিউজের কাছে এ মন্তব্য করেন।

তিনি বলেন, ‘চাকমা, রিয়াং ও ত্রিপুরারা মিলে জুম চাষ করে কাচলং থুম, কালু থুম এবং ভূয়োছড়ি, কজতলি, চিল্যাতলির বন ধ্বংস করেছে। কাচলং, গঙ্গারাম, মিইনীর বনও একইভাবে শেষ হয়েছে।’

তিনি বলেন, যদিও ইউপিডিএফের পক্ষ থেকে বন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার স্বার্থে জুম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়, তারপরও নানা কারণে বন উজার হয়ে যাচ্ছে।

বন ও পরিবেশ রক্ষায় ইউপিডিএফের মতো অন্য কোন দল, এমনকি সরকারী বনবিভাগও আন্তরিক নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।

ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত, ইউপিডিএফের ওপর সরকারের দমনপীড়নের কারণে বন রক্ষার দিকটার প্রতি নিবিড়ভাবে দৃষ্টি দেয়া সম্ভব হয় না বলে তিনি অকপটে স্বীকার করেন।

‘জেএসএসের আক্রমণ মোকাবিলা করতে পার্টিকে সকল শক্তি ব্যয় করতে হয়, ব্যস্ত থাকতে হয়। এই সুযোগে লোকজন জুম চাষ করে বন ধ্বংস করে ফেলে,’ আক্ষেপ করে বলেন সচিব চাকমা।

মাচলঙে পাহাড়ে জুম পোড়ানোর আগুনে পুড়ে গেছে আশে-পাশের বন-জঙ্গল।

তিনি বলেন, ‘অনেক সময় জেএসএস সস্তা জনপ্রিয়তা লাভের জন্য এবং ইউপিডিএফের বিরুদ্ধে লোকজনকে ক্ষেপিয়ে তোলার জন্য তাদেরকে জুম চাষে উৎসাহিত করে, এমনকি কোন কোন জায়গায় তাদেরকে নিজ গ্রাম থেকে তুলে নিয়ে জুম চাষ করার জন্য সংরক্ষিত বনে নিয়ে যায়। পরে জুমের ফসলের একটি অংশ তাদের কাছ থেকে চাঁদা হিসেবে নিয়ে নেয়। বন ও পরিবেশের প্রতি জেএসএসের সামান্যতম দরদ নেই। ‘

এক সময় গহীন বনের আজ কী করুণ অবস্থা হয়েছে তার বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘বন না থাকার কারণে মোন এলাকায় এখন হরিণ, সাম্বার হরিণ, বানর, শুকর, বন মোরগ আর দেখা যায় না। পাখির ডাকও তেমন শোনা যায় না। হাতি, বাঘ, ভালুক তো বহু আগেই উধাও হয়ে গেছে।’

তিনি স্বীকার করেন পার্টির সবাই বন রক্ষার গুরুত্ব সমানভাবে উপলব্ধি করে না, গুরুত্বও দেয় না। একইভাবে গ্রামবাসীরাও খুবই অসচেতন বলে তিনি মন্তব্য করেন।

তিনি বলেন, ‘এ বছর জুমের আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য গ্রামে গ্রামে মিটিং করা হয়েছে, চিঠি দেয়া হয়েছে, এমনকি পোস্টারিংও করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও জুমের আগুনে পুড়ে যায়নি মোন এলাকায় এমন কোন জায়গা খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।’

সোরোন্দরা বা ফুলঝাড়ু চাষের কারণেও সাজেকের প্রাকৃতিক পরিবেশ খারাপ হয়েছে বলে ইউপিডিএফ নেতা জানান।

‘এ এলাকা এখন বসবাসের অযোগ্য হয়েছে। গ্রামগুলো পুরো ন্যাড়া হয়ে গেছে; গাছ, বাঁশ পুড়ে গেছে, গাছ বাঁশের কোন ছায়া নেই। এমনকি মাচলং, গঙ্গারাম, মিইনীসহ নদী, ঝিরি, ঝর্ণার পানিও শুকিয়ে গেছে। আর কিছু কিছু এলাকায় যেখানে সামান্য পানি রয়েছে তাও ভীষণ গরম থাকে।’

সাজেক ইউনয়নের কমলাপি এলাকায় পাহাড়ে জুম পোড়ানো হয়েছে।

সচিব চাকমা বলেন, সাজেকে যারা বসবাস করছে তারা বহু বছর আগে সেনাবাহিনীর অপারেশন, গণহত্যার কারণে বিভিন্ন এলাকা থেকে উদ্বাস্তু হওয়া লোকজন। এক সময় তাদের অনেকের জমিজমা ছিল, ধান্য জমি ছিল, কিন্তু সেসব এখন বাঙালি সেটেলারদের দখলে। ফলে বাঁচার জন্য তাদেরও জুম চাষ ছাড়া উপায় নেই।

তবে কয়েকটি পরিবারের অন্যত্র জমিজমা থাকার পরও গহীন বনে জুম চাষ করে বন ধ্বংস করছে, যা কোনভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।

‘এ কারণে গঙ্গারামের থুমে থলছড়া ও উগোলছড়ি এই দুই এলাকায় বসবাসরত লোকজনকে তাদের আদি গ্রামে ফিরিয়ে আনা হবে। এ জন্য তাদের সাথে কথা হয়েছে, তাদেরকে বোঝানো হয়েছে এবং ফিরে যেতে তারা রাজী হয়েছে,’ তিনি বলেন।

‘এই দুই এলাকার জুমচাষীরা মুলত দীঘিনালা ও বাঘাইছড়ি থেকে সেখানে গেছেন। আদি গ্রামে তাদের চাষের জন্য প্রচুর ধান্য জমি রয়েছে। রবিশষ্য ফলানোর জমিও আছে। কিন্তু তারপরও তারা সেখানে গিয়ে জুম চাষ করে বন ধ্বংস করছে। এটা মেনে নেয়া যায় না।’

তিনি বলেন, ‘সাজেক অঞ্চলে জুম চাষ বৃদ্ধির অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো রাস্তার আশেপাশে জুম্মদেরকে বসতি করতে ও পুরাতন ঘর মেরামত করতে না দেয়া। এর ফলে তারা আরও ভেতর এলাকায় গিয়ে জুম চাষ করতে বাধ্য হচ্ছে।’

পার্বত্য চট্টগ্রামে বন রক্ষা বিষয়ে সরকারের পলিসিকে উদ্ভট ও উল্টো আখ্যা দিয়ে সচিব চাকমা বলেন, ‘যেখানে সরকারের উচিত বন ও পরিবেশ রক্ষার জন্য রাস্তা ও বাজারের পাশে নিয়ে এসে পাহাড়িদের বসতি দেয়া, সেখানে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা রাস্তার আশেপাশের এলাকা থেকে তাদেরকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। এটা খুবই দুঃখজনক।’

তিনি মন্তব্য করে বলেন সরকার একদিকে বন ও পরিবেশ রক্ষার কথা বলে, অথচ এমন কাজ করে যাতে বন ও পরিবেশ ধ্বংস হয়।

ইউপিডিএফ নেতা বলেন, ‘এ বছর এ অঞ্চলে জেএসএসের (সন্তু গ্রুপ) আক্রমণের কারণে বন রক্ষার কাজে সময় দেয়া পার্টির পক্ষে সম্ভব হয়নি। ফলে এর সুযোগে লোকজন সব বাঁশ কেটে শেষ করে ফেলেছে। গবমারা চুক, পুরিখোলা চুকের (সাজেক মোন) বিস্তুীর্ণ এলাকা জুমের আগুনে ছাই করে দিয়েছে।’

অন্যদিকে জেএসএসের সন্তু গ্রুপ জুম চাষ নিয়ে লোকজনকে পার্টির বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে বিভিন্ন অপপ্রচার চালাচ্ছে বলে তিনি জানান।

ইউপিডিএফ নেতা বলেন, বন ও পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব সবার। জেএসএসেরও দায়িত্ব রয়েছে। কেবল একা ইউপিডিএফের পক্ষে সাজেক কিংবা অন্যত্র বন রক্ষা করা সম্ভব নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।

এজন্য তিনি বন ও পরিবেশ রক্ষায় ইউপিডিএফকে সহযোগিতা দেয়ার জন্য জেএসএসের প্রতি আহ্বান জানান।

ভিডিও চিত্র:


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।


সিএইচটি নিউজের ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.