সাজেক ভূমি রক্ষা কমিটি ও সাজেক নারী সমাজের সম্মেলন অনুষ্ঠিত

0
55

সিএইচটিনিউজ.কম
Sajek conference, 8.10.2014সাজেক(রাঙামাটি): “সাজেক বাঁচাও! বন-পরিবেশ ও বাস্তুভিটা রক্ষার্থে জীবন বাজি রেখে লড়াইয়ে প্রস্তুত হও!” এই আহ্বান সম্বলিত শ্লোগানকে সামনে রেখে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেকের উজো বাজারস্থ প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে আজ ০৮ অক্টোবর বুধবার সকালে এক বিশাল সমাবেশের মাধ্যমে সাজেক ভূমি রক্ষা কমিটি ও সাজেক নারী সমাজের যৌথ সম্মেলন সফলভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। উক্ত সম্মেলনে জ্ঞানেন্দু চাকমাকে সভাপতি ও বিনয় কান্তি চাকমাকে সাধারণ সম্পাদক করে ১৭ সদস্যের সাজেক ভূমি রক্ষা কমিটি এবং নিরূপা চাকমাকে সভাপতি ও জ্যোৎস্নারানী চাকমাকে সাধারণ সম্পাদক করে ২১ সদস্যের সাজেক নারী সমাজের নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে।

সম্মেলন উপলক্ষে আয়োজিত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন জ্ঞানেন্দু চাকমা। এতে আরো বক্তব্য রাখেন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ)-এর কেন্দ্রীয় সদস্য দেবদন্ত ত্রিপুরা, পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের সভাপতি ও আট সংগঠনের কনভেনিং কমিটির আহ্বায়ক সোনালী চাকমা, সাজেক নারী সমাজের সভাপতি নিরূপা চাকমা, সাজেক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অতুলাল চাকমা, গণতান্ত্রিক যুবফোরামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক জিকো ত্রিপুরা, ঘিলাছড়ি নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি শান্তি প্রভা চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সহ সাধারণ সম্পাদক শিখা চাকমা ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সদস্য অংকন চাকমা। এছাড়া ইউপিডিএফ সংগঠক জুয়েল চাকমাও এতে উপস্থিত ছিলেন।

সম্মেলনে শোক প্রস্তাব পাঠ করেন সুদৃষ্টি চাকমা। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন ডা: প্রদীপ কুমার চাকমা।

সম্মেলনে ৭ দফা দাবিনামা সম্বলিত রাজনৈতিক প্রস্তাবনা পেশ করা হয় এবং সভায় উপস্থিত প্রায় ৫০০ এর অধিক জনগণ স্বতস্ফূর্তভাবে হাত উচু করে উক্ত রাজনৈতিক প্রস্তাবনার প্রতি সমর্থন প্রদান করেন।

সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের একাংশ
সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের একাংশ

রাজনৈতিক প্রস্তাবনায় উত্থাপিত দাবিগুলো হলো: ১. সাজেকে বসবাসরত জুম্ম জনগণকে তাদের বাপ-দাদার ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা বন্ধ করতে হবে; ২. সাজেকবাসীকে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-যাতায়াত-যোগাযোগের সুবিধাসহ সকল ধরণের নাগরিক অধিকার দিতে হবে; ৩. সেটলার কর্তৃক সেনা সহায়তায় জবরদখলকৃত আমাদের জায়গাজমি ফেরত দিতে হবে; ৪. ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান-বুদ্ধমূর্তি নির্মাণের সকল বাধা তুলে নিতে হবে; ৫. বিজিবি’র ৫৪ নং ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার স্থাপনের মাধ্যমে উজো বাজার ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে জুম্ম জনগণকে উচ্ছেদের প্রচেষ্টা বন্ধ করতে হবে; ৬. পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের নামে রুইলুই ও কমলাক পাহাড় থেকে ত্রিপুরা-লুসাই-পাংখো জাতিসত্তার জনগণকে তাদের বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ চলবে না ও ৭. উজো বাজার এলাকায় দিনেরাতে অবস্থান করা পুলিশী প্রহরা সরিয়ে নিয়ে তাদের নিজস্ব ফাড়িতে ফিরিয়ে নিতে হবে।

প্রস্তাবনায় বলা হয়, ২০০৬ সাল থেকে রাঙামাটির সাজেকের বিস্তীর্ণ পাহাড়ভূমি দখলে নেয়ার জন্য তৎকালীন শাসকশ্রেণী নানা ধরণের ষড়যন্ত্র করতে থাকে। প্রায় ২৬ হাজার সেটলার পরিবারকে সাজেকে বসতিস্থাপনের সুযোগ করে দিয়ে সাজেক সেটলারদের দ্বারা জবরদখলের পরিকল্পনা করা হয়। উক্ত পরিকল্পনার কথা জানাজানি হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সংগঠন ইউপিডিএফ আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তোলে। ২০০৭-২০০৮ সালের দিকে সেটলাররা সেনা সহায়তায় সাজেকের বিভিন্ন এলাকা জোর করে দখলে নিতে থাকে। তৎকালীন সময়ে জনগণ তেমন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। ২০০৮ সালের ০১ মার্চ সাজেক ভূমি রক্ষা কমিটি ও ২০০৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর সাজেক নারী সমাজ গঠন করা হয়। তারপর থেকেই এই দুই সংগঠন সাজেকে ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে তীব্র সংগ্রাম ও প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে থাকে। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ‘ভূমিই জীবন-ভূমিই মরণ’ এই চেতনা বুকে ধারণ করে ভূমিরক্ষার লড়াইয়ে শহীদ হন বুদ্ধপুদি চাকমা, লক্ষীবিজয় চাকমা ও লাদুমুনি চাকমা। এভাবে লড়াই সংগ্রামের মাধ্যমে সাজেকের জনগণ ভূমি জবরদখলদারদের হটিয়ে দিতে সমর্থ হয়।

sajek conference rallyপ্রস্তাবনায় আরো বলা হয়, এখনো ভূমি বেদখলের নানা ষড়যন্ত্র চলছে। আমাদেরকে নিজেদের মতো করে বসবাসের অধিকার দেয়া হচ্ছে না। উজো বাজারে একটি বুদ্ধমূর্তি নির্মাণের জন্য জনগণ উদ্যোগ নিলে প্রশাসন কোনো যুক্তি ও কারণ ছাড়াই গত ২১-২২ জুলাই,২০১৪ ইং পুলিশবাহিনী দিয়ে তা নির্মাণ করতে বাধা দেয়া হয়েছে। কারণ হিসেবে রিজার্ভ ফরেস্টের এলাকায় কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা যায় না বলা হলে জনগণ যুক্তি দেখায় যে, বাঘাইহহাট-মাজালঙ সহ রিজার্ভ ফরেস্টের অন্তর্ভূক্ত এলাকায় ধর্মীয় স্থাপনা যদি নির্মাণ করা যেতে পারে তবে কেন উজো বাজার গঙ্গারামদোর এলাকায় ছোট একটি বুদ্ধর্মতি নির্মাণ করা যাবে না? প্রশাসন যুক্তির সাথে পেরে না উঠলেও এখনো শক্তি ও প্রশাসনিক ক্ষমতার জোর দেখিয়ে বুদ্ধমূর্তি নির্মাণ করতে দিচ্ছে না, এছাড়া জনগণের মতামতের তোয়াক্কা না করে এখনো উজো বাজারে পুলিশী প্রহরা রাখা হয়েছে। বেশ কয়েকমাস আগে সাজেকের রেতকাবা-বাইবা ছড়া এলাকায় ইট বিছানো পথ নির্মাণ করতে গেলেও তা নির্মাণে বাধা দেয়া হয়েছে।

এতে বলা হয়, বিগত ৮০’র দশক থেকে আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে সেনা-সেটলারদের দমনপীড়ন ও ভূমি বেদখলের শিকার হয়ে বাস্তুভিটা হারিয়ে আজ সাজেকের মতো দুর্গম এক অঞ্চলে বসবাস করতে বাধ্য হয়েছি। সরকার প্রশাসন যদি আমাদের বাপদাদার ভিটেমাটি ফিরিয়ে না দিয়ে উল্টো বর্তমানে আশ্রয় নেয়া জায়গা থেকেও উচ্ছেদ করে তবে আমরা কোথায় যাবো?

প্রস্তাবনায় বলা হয়, এভাবে চলতে থাকলে আমাদের সামনে প্রতিরোধ প্রতিবাদ লড়াই ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। ভূমিই আমাদের অস্তিত্ব, ভূমি আমাদের জীবন-আমাদের প্রাণ- সেই ভূমি রক্ষার জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এতে সকল সকল ধরণের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

সমাবেশ শেষে একটি র‌্যালি উজোর বাজার এলাকা প্রদক্ষিণ করে। এছাড়া বিকালে প্রতিরোধ সাংস্কৃতিক স্কোয়ার্ড ও জুম্ম ফিল্ম এসোসিয়েশনের যৌথ পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
———

সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.