সেটেলার উপনিবেশ-শাসিত পাহাড়ে গুইমারায় তিন মারমা যুবকের খুনীদের বিচার হবে কি?

মন্তব্য প্রতিবেদন
আজ খাগড়াছড়ির গুইমারায় সেনা-সেটেলার হামলায় শহীদ আখ্র মারমা, আথুইপ্রু মারমা ও থৈচিং মারমা স্মরণে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন অনুষ্ঠিত হবে। শহীদ স্মৃতি সংরক্ষণ সংসদ নামে সদ্য গঠিত শহীদ পরিবারদের একটি সংগঠনের আহ্বানে সারা পার্বত্য চট্টগ্রামে এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে এই কর্মসূচি পালিত হচ্ছে।
এক মারমা কিশোরীকে ধর্ষণের প্রতিবাদে গত ২৮ সেপ্টেম্বর আহূত শান্তিপূর্ণ সড়ক অবরোধ পালনকালে সেনাবাহিনীর সদস্যরা নির্বিচার গুলি চালালে ওই তিন যুবক প্রাণ হারান। তবে জানা যায়, আখ্র মারমা ঘটনাস্থলে তৎক্ষণাৎ মারা যাননি। তার পায়ে গুলি বিদ্ধ হলে সেনা সদস্যরা তাকে নিয়ে যায় এবং চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে না পাঠিয়ে তার ওপর অকথ্য শারীরিক নিযাতন চালায়। ফলে সেনা হেফাজতে অতিরিক্তি রক্তক্ষরণ ও নিযাতনের কারণে তিনি মারা যান।
গুইমারায় মারমা-অধ্যুষিত রামেসু বাজারে সেনা-সেটেলার হামলার পর এক মাস কেটে গেল। কিন্তু হামলাকারী-লুটপাটকারী ও খুনীদের কাউকে এখনও গ্রেফতার করা হয়নি। পুলিশ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির নামে মামলা দায়ের করে তাদের দায়িত্ব খালাস করেছে। অপরাধীরা চিহ্নিত হওয়া সত্বেও তাদেরকে তারা গ্রেফতার করছে না।
অন্যদিকে হামলায় জড়িত সেনা সদস্য ও সেটেলাররা নিজেদের অপরাধ ঢাকার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছে এবং হামলার দায় অন্যের ঘাড়ে চাপাতে চাইছে। তারা ইউপিডিএফের বিরুদ্ধে ব্যাপক অপপ্রচার ও বিষোদ্গার শুরু করেছে। তাদের মিথ্যাচারের বিস্তার দেখলে অবাক হতে হয়। সরকার-প্রশাসন-রাষ্ট্রযন্ত্র-মিডিয়া সবই খুনী সেনা সদস্য ও সেটেলারদের পক্ষে। সুতরাং নিশ্চিতভাবে বলায় যায়, আগের হামলাগুলোর মতো গুইমারা হামলারও বিচার হবে না, অপরাধীদেরও শাস্তি হবে না।
আসলে পৃথিবীর সকল উপনিবেশিক শাসনের চরিত্র একই। এখানে শাসিতরা কোন ন্যায়বিচার পায় না। বিপরীতে শাসক জাতির সদস্যরা জঘন্য অপরাধ করেও পার পেয়ে যায়। ভারতের কংগ্রেস দলের অন্যতম প্রধান নেতা ও জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার-সেক্রেটারী জেনারেল শশী থারুর তার লেখা An Era of Darkness, The British Empire in India বইয়ে ভারতে বৃটিশ উপবিবেশিক শাসনে রুল অব ল বা আইনের শাসনের আসল রূপের বর্ণনা দেন। তার দেয়া বর্ণনার সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান আইনের শাসনের কোন তফাৎ দেখা যায় না। বরং প্রত্যক্ষ সেনা দখলদারিত্বের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের আইনের শাসন বৃটিশ শাসনের চাইতে শতগুণে নিকৃষ্ট।
শশী থারুর তার উপরোক্ত বইয়ের এক জায়গায় লিখেছেন, লেফটেন্যান্ট থম্পসন ও নিভ নামে দুই বৃটিশ বাঙ্গালোরে এক ভারতীয় বালককে গুলি করে হত্যা করলে ভারতীয় গ্রামবাসীরা জোর করে নিভের বন্দুকটি কেড়ে নেয়। এই ঘটনায় সাদা চামড়ার মানুষটির বন্দুকটি অবৈধ ব্যবহারের অপরাধে গ্রামবাসীদের মধ্যে দুই জনকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়। অন্যদিকে খুনীদের কোন সাজা হয়নি। মামলাটিও করা হয়েছিল ‘ইউরোপিয়ানদের বিরুদ্ধে নেটিভদের’ হামলা হিসেবে।
একই গ্রন্থে শশী থারুর আরও একটি মজার ঘটনা উল্লেখ করেন। ১৯০২ সালে শিয়ালকোটে নবম ল্যান্সার-এর তিন জন সৈন্য এক ভারতীয়কে শারীরিক নিযাতন চালিয়ে খুন করে। কারণ ওই ভারতীয় রাতে তাদের জন্য মেয়ে সরবরাহ করতে অস্বীকার করেছিলেন। এ ঘটনায় কর্তৃপক্ষ কোন তদন্ত করেনি, বরং নিহত ব্যক্তিকে মাতাল বলে চালিয়ে দিয়ে অপরাধীদের রক্ষার চেষ্টা করেছিল। এই ঘটনা তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড কার্জন ও ভারতে বসবাসরত বিপুল সংখ্যক বৃটিশকেও ক্ষু্দ্ধ করে তুলেছিল। কিন্তু তা সত্বেও লর্ড কার্জন damned nigger -এর খুনীদের শাস্তি বাড়াতে সক্ষম হননি।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি শাসদের মধ্যে এই বৃটিশ উপনিবেশিক মাইন্ডসেট শতভাগ বর্তমান। সে কারণে সেনা দখলদারিত্ব ও সেটেলার উপনিবেশ কবলিত পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের জন্য ন্যায়বিচার আশা করা দুরাশা মাত্র। এখানে সেনাবাহিনীর সদস্য ও সেটেলাররা খুন, গণহত্যা, ধর্ষণ, অন্যের সম্পত্তি জবরদখল, লুণ্ঠন ইত্যাদি জঘন্যতম অপরাধ করলেও আদালেতে তাদের কোন শাস্তি হয় না। এমনকি তাদের কেশাগ্রও স্পর্শ করা হয় না। অন্যদিকে পাহাড়ি ভিকটিমরা হয় নিগৃহীত। তাদেরকেই সন্ত্রাসী, অপরাধী হিসেবে চিত্রিত করা হয়। এমনকি অপরাধের বিচার চাওয়াকে ধৃষ্টতা হিসেবে দেখা হয়। তাদের ঘরবাড়িতে তল্লাশী করা হয়, হয়রানি করা হয়, মারধর করা হয়, বিনা অপরাধে আটক করে জেলে পাঠানো হয়।
যতদিন পাহাড়ে সেনা দখলদারিত্ব ও সেটেলার উপবিবেশের অবসান না হবে,ততদিন এই অবস্থার পরিবর্তন আশা করা যায় না। একমাত্র নিরলস সংগ্রামের মাধ্যমেই এই পরিবর্তন সম্ভব হতে পারে। মনে রাখা দরকার অন্যায় কখনই চিরস্থায়ী হয় না। সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ভারতে বৃটিশ শাসনের অবসান হয়েছে। একইভাবে সংগ্রামের মাধ্যমেই পার্বত্য চট্টগ্রামেও একদিন সেনা দখলদারিত্ব ও সেটেলার উপনিবেশের অবসান হবে।
(৩০ অক্টোবর ২০২৫)
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।
