বাংলা আউটলুকের টকশোতে আলোচকদের অভিমত
সেনাবাহিনী দিয়ে পাহাড়ের সমস্যা সমাধান হবে না, রাজনৈতিকভাবে এর সমাধান করতে হবে

সিএইচটি নিউজ ডেস্ক
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
‘পাহাড়ের দ্বন্দ্ব ও সমতলের রাজনীতি’ শিরোনামে গত ১৪ এপ্রিল ২০২৪, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় ‘বাংলা আউটলুক’ এক অনলাইন টকশো’র আয়োজন করে। টকশোটি বাংলা আউটলুকের ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। দিলশানা পারুল এর সঞ্চালনায় টকশোতে অংশগ্রহণ করেন সাবেক কূটনীতিক সাকিব আলী, বাংলাদেশ ডিফেন্স জার্নাল এর সম্পাদক আবু রুশদ ও বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি অঙ্কন চাকমা।
উক্ত টকশোতে আলোচকরা পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিসহ দেশের ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির উপর নানা আলোকপাত করেছেন। এতে তারা একমত হন যে, পাহাড়ের সমস্যা হচ্ছে রাজনৈতিক সমস্যা। সেনাবাহিনীর চোখ দিয়ে না দেখে রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এ সমস্যার সমাধান করতে হবে।
টকশোতে উত্থাপিত আলোচনা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে উত্থাপিত আলোচনার অংশগুলো সংক্ষিপ্ত আকারে এখানে তুলে ধরা হলো:
———————
সাকিব আলী, সাবেক কূটনীতিক:

কাপ্তাই বাঁধই পার্বত্য চট্টগ্রামে সমস্যার শুরু বলে মনে করেন সাবেক কূটনীতিক সাকিব আলী। তিনি বলেন বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে সমস্যা তা শুরু হয়েছে কাপ্তাই বাঁধের মধ্য দিয়ে। এর ফলে চাকমা ও অন্যান্য জাতিসত্তাগুলোর উর্বর জমিগুলো নিয়ে নেওয়া হয়। পাকিস্তান সরকার আমলে তা সংস্কার করা হয়েছে। এটি এক ধরনের ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া এবং অন্যের কথা না শোনা। বিশেষ করে প্রান্তিক বলে যাদের মনে করা হচ্ছে তাদের কথা আরো না শোনা। সুতরাং প্রান্তিকদের কথা না শোনে চাপিয়ে দিয়ে তারা তাদের নিজেদের অবস্থা ভালো করেছে এবং যার জন্য তাদেরকে কোন জবাবহিতার মধ্যে যেতে হয়নি। সেখান থেকে মূলত সমস্যা শুরু হয়েছে। অপরদিকে ভারতেও উত্তর পূর্ব দিকে পাহাড়ি এলাকায়, যেখানে পাহাড়ি মানুষ রয়েছে সেখানেও খনিজ সম্পদ আহরণ, বন উজার করা হয়েছে, বাগান করা হয়েছে। সেখানেও কিন্ত সেখানকার মানুষের লাভ হয়নি, লাভ হয়েছে সমতলের মানুষগুলোর। কাপ্তাই বাঁধ করা হয়েছে কিন্তু বিদ্যুৎ পেয়েছে সমতলের মানুষ। আর সেটার জন্য মূল্য দিতে হয়েছে পাহাড়ে মানুষদের।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বলতে নেই। পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার, ভারত, চীনেও এই সংকট রয়েছে। সেখানেও সাধারণ মানুষের ওপর দমন-পীড়ন চলছে। তার মধ্যে মিয়ানমার বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। সেখানে জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে আরাকান আর্মির লড়াই চলছে। সামনে দিনে আরকান আর্মি ও বাংলাদেশ আর্মির সাথে মুখোমুখি হলে সমস্যাটা আরো জটিল হবে।
বান্দরবানে ব্যাংক ডাকাতি বিষয়ে পর্যালোচনা করে শাকিব আলী বলেন, পাহাড়ে পাহাড়িদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঝামেলা লাগিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়তো আছে। বান্দরবানে দেড় ঘন্টার মত ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা চলতে থাকলেও সেনাবাহিনী, র্যাব কেউ আসেনি। পরবর্তীতে সেনাবাহিনী বললো এই ঘটনায় সমাধানের জন্য তারা এ্যাকশনে যাবে, তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনুমোদন করে। সুতরাং আমি মনে করি বা আমাদের দেশে অনেকে বলছে এদেশের সরকার মানুষের মনোযোগ ঘুরানোর জন্য, দৃষ্টি এড়ানোর জন্য তা করেছিল।
তিনি আরো বলেন, কেএনএফ’র এটা আসলে বড় কিছুই না, অর্থনৈতিকভাবে দেখলেও কিছুই না। কারণ আমাদের অর্থনৈতিকভাবে ব্যাংকে ঋণ খেলাপিতে যারা আছে তারা এদের চেয়ে আরো বড় ডাকাত।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে তিনি বলেন, রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের জন্য পার্শবর্তী দেশগুলো কেউ চায় না। বাংলাদেশ তাদের স্বার্থ রক্ষা করছে। ফলে রোহিঙ্গাদের শিক্ষা, কর্মসংস্থানসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি করে না দিয়ে তাদেরকে আর্মস গ্রুপ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, অপরাধ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যার মাধ্যমে তারা যাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এর দায় বাংলাদেশ সরকার এড়াতে পারে না।
পাহাড়ে সেনাবাহিনী প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পাহাড়ে সেনাবাহিনী থাকার মানে হচ্ছে তাদের কোন জবাবদিহিতা করতে হয় না। এটাই সবচেয়ে খারাপ। পাহাড়কে সেনাবাহিনীর চোখ দিয়ে দেখা মোটেই ঠিক না। পাহাড়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ পাহাড়িরা, সেখানে পাহাড়িদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।
তিনি আরো বলেন, আমরা একটি খারাপ পলিসি বা দর্শনের মধ্যে রয়েছি। এর থেকে গত ৫৩ বছরেও কেউ বের হইনি। পাহাড় সম্পর্কে জিয়াউর রহমানে দৃষ্টিভঙ্গি ভালো ছিল না, রেকর্ড ভালো না।
তিনি বলেন, জনগণের কল্যাণের জন্য যে রাজনীতি করতে হয় সে রাজনীতি আমরা কখনো করি নাই। তার জন্য আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমরা আসলে ক্ষমতায় থাকতে চাই।
আবু রুশদ, সম্পাদক, বাংলাদেশ ডিফেন্স জার্নাল:

বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর পাহাড়িদের বাঙালি হয়ে যাওয়ার যে পরামর্শ শেখ মুজিবুর রহমান দিয়েছিলেন সেখান থেকেই পাহাড়ে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন বাংলাশে ডিফেন্স জানার্লেল সম্পাদক আবু রুশদ। তিনি বলেন, ১৯৭৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানের রাঙামাটি সফরে গিয়ে পাহাড়িদের বাঙালি হয়ে যাওয়ার পরামর্শ ও মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সংসদে প্রতিবাদ জানানোর বিষয়ে বইয়ের রেফারেন্স দিয়ে বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর শুরু থেকে পাহাড়ে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, কাউকে জোর করে বাঙালি জাতি হিসেবে চাপিয়ে দিতে পারে না। জোর করে বাঙালি বানানোর চেষ্টা থেকেই সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, এটি কিন্তু বড় বিষয়। তার পরবর্তীতে দীর্ঘ ২৪ বছর সশস্ত্র লড়াই হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, একটি দেশে বড় যারা তাদেরকে সহনশীল হতে হয়, আমরা তা হতে পারেনি। পাহাড়ে সমস্যাটি আর্থ—সামাজিক, রাজনৈতিক। এই সমস্যা জাতিসত্তার সমস্যা, এই সমস্যাগুলো সামরিকভাবে সমাধান করা পৃথিবীতে কোন দেশের পক্ষে তা সম্ভব না। তিনি ইন্দোনেশিয়ার ইস্ট তিমুর ও দক্ষিণ সুদানে সেনাবাহিনী কর্তৃক জাতিসত্তাদের ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং পরবর্তীতে সেসব দেশে স্বাধীনতার কথা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, রাজনৈতিবিদ, সরকারের কাজ হলো রাজনৈতিক সমস্যাগুলো সমাধান করা। ১৯৯৭ সালে পিসিজেএসএর সাথে ‘শান্তি চুক্তি’ করেছেন এটি আপনাকে মানতে হবে। সেটি লঙ্ঘন করা যাবে না।
তিনি আরো বলেন, বান্দরবানে ব্যাংক ডাকাতি ঘটনায় ওভার রিয়েক্ট দেখানো হয়েছে। সে ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাচ্চা, স্ত্রী, মা, বাবাদের ধরে আনা হচ্ছে। এটিকে আরো বোস্ট করা হচ্ছে যে আমরা ধরে এনেছি। একজন যুবক কুকি সে ঘটনা করতে পারে কিন্তু তার জন্য বাচ্চা, স্ত্রী, মা, বাবাদের ধরে আনা ঠিক নয়। এটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের মধ্যে পরে, তা করা যাবে না।
মিয়ানমারে জান্তা বিরোধী গণতান্ত্রিক লড়াই চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মিয়ানমারে জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক শক্তির সশস্ত্র লড়াই চলছে। তাদের ছোঁড়া মর্টারসেল বাংলাদেশ সীমান্তে এসে পড়ছে। আমরা খেয়াল করছি না, আমরা আছি যে সমস্ত কিছু আরো একদিকে কিভাবে সামরিক শক্তি দিয়ে দমন করবো সেদিকে। আমাদের সমারিক—নিরাপত্তা বিষয়টা টার্গেট হওয়া দরকার সীমান্তে, আমাদের দেশে যারা ‘আদিবাসী’ আছে তাদের বিরুদ্ধে না, তাদের ব্যাপারে না। তবে তাদের মধ্যে যদি কিছু বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার মত থাকে তাহলে এটিকে খটিয়ে দেখতে হবে।
তিনি কেএনএফ বিষয়ে বলেন, কেএনএফের কিছু দাবি দাওয়া ছিল। তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছেও তাদের দাবি—দাওয়া স্মারকলিপি আকারে দিয়েছেন। কিন্তু তাদের দাবি বিষয়ে আমরা কেউ খেয়াল করিনি। একসময় ২০১৫ সালে ২৪ পদাধিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল শাব্বির ‘কুকি চীন ন্যাশনাল ডেভেলভমেন্ট অরগানাইজেশন’ কেন্দ্রীয় কার্যালয় উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন। তার মানেই হচ্ছে সরকার বা সেনা দপ্তরে অনুমোদন নিয়ে তারা সেখানে গিয়েছিলেন। হয়তো বমদের অভিযোগ শোনার জন্য সেখানে গিয়েছিলেন তারা। কিন্তু এই পর্যায়ের এসে এটি এই অবস্থা হয়েছে কেন? হয়তো ভিতরে কিছু ঢুকেছে। তাদের দুই পক্ষেরও দোষ থাকতে পারে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে আমরা সকলে ভালোভাবে থাকতে চাই। একটা জাতি সবসময় ভালো থাকবে কখন, যখন সে দেশের বড় জাতির মানুষেরা যদি অন্য জাতির মানুষদেরকে স্নেহের দৃষ্টিতে দেখেন। বাংলাদেশ বহু জাতির দেশ। বাইরে কিছু শক্তির পার্বত্য চট্টগ্রাম কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। সে কারণে নানা সমস্যা দেখা দেয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী প্রত্যাহারে বিষয়ে কথা উঠছে। সকল সেনাবাহিনী এক নয়, এটাকে ঢালাওভাবে সমালোচনা করাটা ঠিক নয় বলে তিনি মনে করেন।
তিনি ২০২৪ সালে ৭ই জানুয়ারি নির্বাচন বিষয়ে বলেন, এ নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ কতটুকু ভোট দিয়েছে আমরা দেখেছি, কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েকটি এলাকায় শুন্য পার্সেন্ট ভোট পড়েছে, এটাকে বাড়াতেও আর পারেননি। এটা কেন করেছে? এটা রাজনৈতিক কারণে হয়েছে। সেখানে আসলে আস্থার জায়গাটা চলে গিয়েছে।
তিনি বলেন, রাজনীতিই দেশকে নিয়ন্ত্রণ করে। সামরিককায়ন দেশকে নিয়ন্ত্রণ করে না। সেনাবাহিনী, পুলিশবাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা একটা দেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। যদি করতে পারতো তাহলে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভেঙে যেতো না। রাজনীতি যদি থাকতো, তাহলে পাকিস্তান টিকে থাকতো। রাজনীতি দিয়ে সমস্ত কিছু করতে হয়। বাংলাদেশে যদি গণতন্ত্র থাকতো, গণতন্ত্রের চর্চাটা যদি ঠিক মত থাকতো, সুশাসন যদি থাকতো তাহলে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যাগুলো সমাধানের জায়গায় আসতে পারতো। দেশের গণতন্ত্র থাকতো তাহলে মানুষের কথা বলার জায়গাটা সৃষ্টি হতো। এক চেটিয়াভাবে এক নায়কতন্ত্র শাসন চলছে। তাই সেনা—প্রশাসন যা করছে, যা বলছে তাই হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ চলছে প্রশাসনের মাধ্যমে, বাংলাদেশ এখন রাজনীতিবিদরা চালাচ্ছে না। প্রত্যেকটি জিনিস চালাচ্ছে প্রাশসন। সবকিছুই পুলিশ বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো করছে। দেশের রাজনীতিকে নষ্ট করা হচ্ছে। একটা দেশের রাজনীতি নষ্ট হয়ে যায় তখন সে রকমই হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সমস্যাটি ৪০% সামরিক সমস্যা, বাকী ৬০ ভাগ রাজনৈতিক ও আর্থ—সামাজিক সমস্যা। আমরা যদি পাহাড়ের সমস্যাকে প্রশাসন দিয়ে সমাধান করতে চাই, তাহলে সমস্যাটা আরো বাড়বে। সমস্যা সমাধান হবে না। তিনি পাহাড়ে সমস্যাগুলো মানবিক দৃষ্টিতে দেখে সমাধান করার জন্য উভয় পক্ষকে আহ্বান জানান।
অঙ্কন চাকমা, সভাপতি, বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ:

সেনাবাহিনীর চোখ দিয়ে পাহাড়কে দেখার কারণে সেখানে মূল সমস্যাকে আড়াল করা হচ্ছে বলে মনে করেন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি অঙ্কন চাকমা।
তিনি বলেন, প্রশাসন, রাষ্ট্রীয় যন্ত্র থেকে শুরু করে যারা নীতি নির্ধারণী আছেন এবং মেইনস্ট্রিম মিডিয়াগুলো পাহাড়ের সমস্যাকে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বলে চালিয়ে নিতে চায়। এটা অনেকটা সেনাবাহিনীর চোখ দিয়ে পাহাড়কে দেখা অর্থাৎ পাহাড়িদের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার এবং সংগ্রামকে এক পাশে রেখে বিরাজনীতিকরণ করা। সমতলেও চাঁদাবাজি, খুন খারাবি হয় কিন্তু পাহাড়ের সমস্যাকে রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে না দেখিয়ে দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখানো হয়।
এ সময় তিনি বৈ—সা—বি প্রাক্কালে বান্দরবানের ঘটনাপ্রবাহ পাহাড়ের উৎসবের আমেজ ম্লান করে দেয়ার কথাও তুলে ধরেন।
তিনি আরো বলেন, আশি—নব্বই দশকে সমতল থেকে পাহাড়ে বাঙালি পুনর্বাসন করা হয়েছে। এটার উদ্দেশ্য ছিল পাহাড়ি—বাঙালি কৃত্রিম দ্বন্দ্ব তৈরি এবং সাধারণ বাঙালিদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করা। চুক্তির আগে ১২টির অধিক গণহত্যা হয়েছে। ’৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তিতে কাগজে কলমে কোথাও শান্তি শব্দটি সংযুক্তি করা হয়নি। পার্বত্য চুক্তির মধ্যে দিয়ে বরং ভাগ কর, শাসন কর নীতি সরকার কার্যকর করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে কেএনএফের মতো প্রক্সি গ্রুপ তৈরি পার্বত্য চুক্তির অসারতার কারণে হয়েছে। আঞ্চলিক পরিষদের আসন বন্টনে কুকি—চীন ভাষাভুক্ত জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব খুবই কম। ২০১৮ সালের নির্বাচন কেন্দ্রীক রাজনীতির কারনে এমএনপি’র মতন প্রক্সি গ্রুপ তৈরি করা হয়েছে। সুকৌশলে রাষ্ট্র এই ব্যবস্থা তৈরি করেছে।
তিনি বলেন, বান্দরবানে ব্যাংক ডাকাতির পরে ৬০ জনের অধিক শিক্ষার্থী, জিমন্যাস্টিকসসহ সাধারণ জনগনকে গণহারে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়েছে। ২০১৮ সালে ১৮ আগষ্ট খাগড়াছড়িতে দিন দুপুরে বিজিবি সদর সেক্টরের ২০ গজের কাছাকাছি এলাকায় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতাদের প্রক্সি গ্রুপ দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গত বছরের ১১ ডিসেম্বর পানছড়িতে বিপুল চাকমাসহ উদীয়মান ৪ তরুণ নেতাকেও একই প্রক্সি গ্রুপ কর্তৃক হত্যা করা হয়েছে।
অঙ্কন চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটন কেন্দ্রিক ব্যবসা, সীমান্ত সড়কের নির্মাণের টেন্ডার সেনাবাহিনী নিয়েছে। আমাদের দেশের সেনাবাহিনী একটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সাজেক থেকে শুরু করে ডিম পাহাড়, রুমায় পর্যটন স্থাপনা নির্মাণে বহু পাহাড়ি উচ্ছেদ হয়েছে, বান্দরবান থেকে ৪০০ অধিক পরিবার মিজোরামে শরনার্থী হতে হয়েছে। কেএনএফের সাথে শান্তি আলোচনায় জেলা পরিষদের কর্তারা যায় অথচ পার্বত্য চুক্তিতে জেলা পরিষদকে আঞ্চলিক পরিষদ তদারকি করার কথা থাকলেও তাঁদের জানানো হয় না, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ও অবগত নয়।
তিনি আরো বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার টানা ৪ বার ক্ষমতাসীন হলেও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করতে বাধা কোথায়? পার্বত্য চুক্তির মধ্যে দিয়ে কার্যত পাহাড়ি জনগনের সাথে ভাঁওতাবাজি করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিসত্তাদের জন্য স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা দরকার। পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৩টি জাতিসত্তার সম্মিলনকে ভাঙার জন্য ভাগ কর, শাসন কর নীতি কার্যকর হয়েছে। পার্বত্য চুক্তি দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার শেখ হাসিনাকে আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাইয়ে দেওয়ার জায়গা ছাড়া পাহাড়ি জনগণ কিছু পাইনি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর সকলের দৃষ্টি আছে। গত বছর বাপেক্সকে খনিজ জরিপ চালানোর অনুমতি দেয়া হয়েছে। পাহাড়ে পাহাড়িদের থেকে ভূমি বেশি জরুরি শাসকদের এমন মনোভাব সেটা স্মরণ করিয়ে দেয়। ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আওয়ামী সরকার দেশের বাঙালি ভিন্ন জাতিসত্তাকে বাঙালি বানানো হয়েছে। এটাই হচ্ছে সংখ্যালঘুদের প্রতি আওয়ামী সরকারের নীতি। আজকে কল্পনা চাকমা অপহরণের এত বছরেও উদঘাটনে রাষ্ট্র কেন ব্যর্থ এবং মাইকেল চাকমাকে অপহরণ উদঘাটনে সরকার কেন ব্যর্থ এই প্রশ্ন রাখেন।
তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে রাজনৈতিক সমস্যা উল্লেখ করে রাষ্ট্রীয় মেকানিজম পরিবর্তন করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিকভাবে এ সমস্যা সমাধানের অভিমত তুলে ধরেন।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।