কাউখালী (রাঙামাটি) : ভারতে এ বছর ফেব্রুয়ারী মাসে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশিয়া গেমসে পদক বিজয়ী নদী চাকমাসহ চার পাহাড়ি নারীকে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এর পক্ষ থেকে গণ সংবর্ধনা দেয়া হয়েছে।
গতকাল রবিবার (১৭ এপ্রিল) রাঙামাটি জেলার কাউখালি উপজেলাধীন পানছড়ি হাই স্কুলে এই সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়। ইউপিডিএফের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক আনন্দ প্রকাশ চাকমা এতে সভাপতিত্ব করেন। এছাড়া এডভোকেট রিপন চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের সভাপতি সোনালী চাকমা, পানছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান সর্বোত্তম চাকমা ও লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান সুপার জ্যোতি চাকমা। স্বাগত বক্তব্য দেন কাউখালির পানছড়ি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক সুনীল কান্তি তালুকদার।
অনুষ্ঠানে ইউপিডিএফের পক্ষ থেকে কুস্তির ৪৮ কেজি ওজন শ্রেণীতে ব্রোঞ্জ বিজয়ী নদী চাকমাকে, ৫৮ কেজি ওজন শ্রেণীর ভারোত্তলনে রোপ্য বিজয়ী (১৪৪ কেজি) ফুলপদি চাকমাকে, ৪৯ কেজি ওজন শ্রেণীর তায়কোয়াণ্ডো প্রতিযোগীতায় ব্রোঞ্জ জয়ী প্রভা চাকমাকে ও কাবাডিতে ব্রোঞ্জ জয়ী জুনি চাকমাকে ক্রেস্ট ও তাদের প্রত্যেককে নগদ ২০ হাজার টাকা প্রদান করা হয়।
নদী চাকমা ছাড়া সংর্ধনা অনুষ্ঠানে বাকি ৩ জন উপস্থিত থাকতে পারেননি। রাঙামাটির সাপছড়ির বাসিন্দা ফুলপদি চাকমা পাকিস্তান ও কাজাকাস্তানে খেলায় অংশগ্রহণের কারণে যোগ দিতে পারেননি। তার পক্ষে সম্মাননা ক্রেস্ট গ্রহণ করেন তার বাবা সাধন কুমার চাকমা। রাঙামাটি সদরের দেওয়ান পাড়ার প্রভা চাকমার পক্ষে সম্মাননা গ্রহণ করেন তার ছোট বোন চিত্তি চাকমা। জুনি চাকমার সম্প্রতি বাঘাইছড়িতে বিয়ে হওয়ায় তিনিও অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেননি। তার বাড়ি রাঙামাটির রাঙাপানিতে।
ইউপিডিএফ নেতা আনন্দ প্রকাশ চাকমা পদক বিজয়ীদেরকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে নিপীড়ন নির্যাতনের মধ্যে থেকেও সাউথ এশিয়া গেমসে প্রতিযোগীতা করে পদক অর্জন করা সহজ কথা নয়। তাদের এই অর্জন ও কৃতিত্ব আমাদের সবার জন্য, দেশের জন্য বিরাট গৌরবের বিষয়।
তিনি বলেন, বিশেষভাবে লক্ষ্য করার বিষয় হলো যারা পদক পেয়েছে তারা সবাই নারী। কাজেই নারীদের প্রতি আমাদের সবার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। শিক্ষা, খেলাধূলা, সাংস্কৃতিক কর্মকা-সহ সকল ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে ও তাদেরকে উৎসাহিত করতে হবে। আমাদের আজকের এই সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান তাদেরকে উৎসাহিত করার একটি ক্ষুদ্র ও নগণ্য প্রয়াস মাত্র।

আনন্দ প্রকাশ চাকমা আশা প্রকাশ করে বলেন অদূর ভবিষ্যতে পাহাড়ি নারীরা আমাদের জন্য আরো সম্মান নিয়ে আসবে। তিনি নারীদের এই অর্জন থেকে শিক্ষা নিয়ে ছেলেদেরও খেলাধূলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের যোগ্য করে তোলার আহ্বান জানান।
সোনালী চাকমা পদকপ্রাপ্ত চার নারীর অর্জনকে সারা দেশ ও জুম্ম জাতির জন্য গর্বের বিষয় হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি অলিম্পিক গেমসকে টার্গেট হিসেবে নেয়ার জন্য তাদের প্রতি আহ্বান জানান।
সর্বোত্তম চাকমা বলেন আমাদের স্বনির্ভর হতে হবে এবং সর্ব ক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে হবে। তিনি জানান পানছড়িতে পাহাড়িরা এখন ‘তাগল’ বানানোর কাজও শিখেছে।
সুপার জ্যোতি চাকমা পদকজয়ী চার নারীকে পার্বত্য চট্টগ্রামের কৃতি সন্তান আখ্যায়িত করেন এবং তাদেরকে চেয়ারম্যান হিসেবে তার প্রাপ্ত এক মাসের সম্মানী ভাতা প্রদানের ঘোষণা দেন।
স্বাগত বক্তব্যে সুনীল কান্তি তালুকদার বলেন, ‘নদী চাকমা আমার ছাত্রী। পারিবারিক আর্থিক অনটন সত্বেও সে স্কুলের লেখাপড়া বাদ দেয়নি। আমি তাকে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছি। তার এ অর্জনের ফলে আমার শিক্ষক জীবন ধন্য হয়েছে বলে আমি মনে করি।’
নদী চাকমা সংবর্ধনা অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য ইউপিডিএফ-এর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তাকে সহযোগিতা করার জন্য তার স্কুল জীবনের শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে তিনি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।
তিনি বলেন তিনি মূলত ফুটবল খেলেতেন। ছোটবেলার স্মৃতি রোমন্থন করে তিনি বলেন, ‘খেলার জন্য বুট জুতা কেনার সামর্থ্য আমার ছিল না। এ জন্য বুটের বদলে পায়ে ছেড়া কাপড়, পাতলা পলিথিন মুড়িয়ে খেলেছি। অনেক সময় আমাকে তিরস্কার শুনতে হয়েছে। কেউ কেউ বলতো মেয়ে হয়ে কেন এত খেলাধূলা করি। কিন্তু তাদের এসব কথায় আমি কোন দিন কান দিইনি এবং দমে যাইনি।’
সংবর্ধনা সভা মঞ্চে আরো উপস্থিত ছিলেন সাবেক কাউখালি উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান অর্জুন মনি চাকমা, ইউপিডিএফের সংগঠক অলকেশ চাকমা, রবি চন্দ্র চাকমা ও নির্বাচিত জুম্ম প্রতিনিধি সংসদের সাধারণ সম্পাদক অমর জীবন চাকমা।
অনুষ্ঠানের হল ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। হলের ভেতরে জায়গা না থাকায় অনেককে স্কুলের বারান্দা ও মাঠে বসতে হয়েছে। সংবর্ধনা সভার জন্য কর্তৃপক্ষ স্কুলে ছুটি ঘোষণা করে।
—————-
সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।