আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, জাতিসত্তার ভাষা বিকাশে চাই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা

0

সিএইচটি নিউজ ডেস্ক ।। আজ ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৯ সালে ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসঙ্ঘের সদস্যদেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। দিনটি বাংলাদেশে ভাষা শহীদ দিবস হিসেবেও পালন করা হয়।

২০১০ সালের ২১ অক্টোবর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে এখন থেকে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করবে জাতিসংঘ এ মর্মে একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে পাস হয়।

ইউনেস্কো ও জাতিসংঘ কর্তৃক এ দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে এ স্বীকৃতির পেছনে রয়েছে সালাম, রফিক, জব্বার, বরকতদের তাজা রক্ত।

তৎকালীন পাকিস্তান সরকার উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে তার প্রতিবাদে গর্জে উঠে এদেশের (তৎকালীন পুর্ব পাকিস্তান) ছাত্র সমাজ। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে তারা গড়ে তুলে দুর্বার আন্দোলন। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত, রফিক প্রমুখের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল ঢাকার রাজপথ। যার ফলে বাংলা ভাষা পায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদা।

ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় পরর্বতীতে ’৭১ সালে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ৯ মাস সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

দিবসটি উপলক্ষে দেশব্যাপী নানা কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ সারাদেশে শহীদ মিনাগুলোতে ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হচ্ছে।

এখানে বলে রাখা দরকার, ২১ ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ ও পালন করা হলেও দেশে বসবাসরত বাঙালি ভিন্ন অপরাপর জাতিসত্তাগুলোর মাতৃভাষাগুলো এখনো স্বীকৃতি পায়নি। যদিও সরকার চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো ও সাদ্রী ভাষায় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে এবং এসব ভাষায় বইও দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ৫টি জাতিসত্তার ভাষায় মাতৃভাষার বই দেওয়া হলেও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অপ্রতুলতার কারণে এসব ভাষায় শিশুদের শিক্ষাদান ঠিকমত হচ্ছে না। যেসব বই ছাপানো হয়েছে সেসব বই পাঠদান করার জন্য শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না করার ফলে এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। তাই এখন প্রয়োজন শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে পাঠদানের ঘাটতি পূরণ করা।

মনে রাখতে হবে, শিশুরা ছোটকাল থেকেই তার মা-বাবার কাছ থেকে যে ভাষাই কথা বলতে শিখে, যে ভাষাতেই পরিবেশ, প্রকৃতি ও সমাজ সম্পর্কে তার পরিচয় হয়, যে ভাষায় কথোপকথনের মাধ্যমে তারা বেড়ে উঠে, সে ভাষা শিশুরা সহজেই আয়ত্ব করতে পারে। তাই দেশে বাঙালি ভিন্ন অন্য জাতির শিশুরা প্রথমেই বাংলা ভাষার আদ্যক্ষর দিয়ে পড়াশুনা শুরু করতে গিয়ে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এতে করে তারা নিজ মাতৃভাষার প্রতি মায়া-মমতা যেমনি হারিয়ে ফেলছে, তেমনি বাংলা ভাষাকে আয়ত্ত করতে গিয়ে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফলে একটা জোগাখিচুড়ি চিন্তা তাদের মাথায় ঢুকছে। এটাই হচ্ছে সংখ্যালঘু জাতির শিশুদের বেড়ে উঠার ক্ষেত্রে একটা নেতিবাচক দিক।

একজন শিশু তার মা’র কাছ থেকে যেভাবে প্রকৃতি, পরিবেশ, সমাজ, সামাজিক নিয়ম-শৃঙ্খলা বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা পায়, তেমনিভাবে প্রাইমারী স্কুলে তার নিজ ভাষায় পড়তে পারলে খুব সহজ ও সাবলীলভাবে নিজের সমাজ, সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারবে। এতে শিশুদের মস্তিষ্কের শক্তি উর্বর হয়ে উঠবে এবং তারা যে কোন বড় বিষয়ও ধারণ করতে পারবে।

তাই, সংখ্যালঘু জাতিসত্তাগুলোর ভাষা-সংস্কৃতি বিকাশে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা অবশ্যই প্রয়োজন। না হলে বৃহৎ জাতির ভাষার আধিপত্যে অপরাপর সংখ্যালঘু জাতিগুলোর ভাষা হারিয়ে যায়। পৃথিবীতে বহু জাতির ভাষা বিলুপ্তি ঘটেছে এবং অনেক ভাষা বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।

বাংলাদেশেও বহু জাতির ভাষা হারিয়ে গেছে এবং হারিয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। তাই রাষ্ট্র তথা সরকারের উচিত দেশে বসবাসরত সকল সংখ্যালঘু জাতির ভাষার স্বীকৃতি দিয়ে এসব ভাষা বিকাশে প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত বাংলার পাশাপাশি তাদের স্ব স্ব মাতৃভাষায় পাঠদানকে আরো সাবলীল ও জোরদার করা। আর এটা করা হলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য আরো বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে।

তবে আশার কথা হচ্ছে, বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের সংখ্যালঘু জাতিসত্তাগুলোর মধ্যে নিজেদের ভাষা চর্চা বাড়ছে। বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও সাহিত্য সংগঠন এবং ব্যক্তি বিশেষে নিজ নিজ উদ্যোগে এ নিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যে চাকমা বর্ণমালাগুলোকে ইউনিকোড ফন্টে রূপান্তর এক মাইল ফলক রচনা করেছে।

নোট: গত বছর ২১ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত এই লেখাটি কিছু সংযোজন সাপেক্ষে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।


সিএইচটি নিউজের ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More