আজ বিশ্ব মানবাধিকার দিবস : পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লঙ্ঘন থেমে নেই

0


বিশেষ প্রতিবেদক, সিএইচটি নিউজ
বুধবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৫

আজ ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। ১৯৪৮ সালের এই দিনে জাতিসংঘ দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। এ লক্ষ্যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। ১৯৫০ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের গৃহীত ৩০টি ধারা সম্বলিত সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ৫ নং ধারায় বলা হয়েছে- ‘কারো প্রতি নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা অবমাননাকর আচরণ করা কিম্বা কাউকে নির্যাতন করা বা শাস্তি ভোগ করতে বাধ্য করা চলবে না’;  ৯ নং ধারায় বলা হয়েছে- ‘কাউকে খেয়াল খুশীমত গ্রেফতার বা আটক করা অথবা নির্বাসন দেয়া যাবে না;  ১৫ নং ধারায় বলা হয়, ‘প্রত্যেকেরই একটি জাতীয়তার অধিকার রয়েছে। কাউকেই যথেচ্ছভাবে তার জাতীয়তা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না’; ২০ নং ধারায় বলা হয়েছে- ‘প্রত্যেকেরই শান্তিপূর্ণভাবে সম্মিলিত হবার অধিকার রয়েছে’

৭৭ বছর আগে এই মানবাধিকার ঘোষণাপত্র গৃহীত হলেও বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে এর কার্যকর কোন প্রভাব নেই। বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠি কর্তৃক যুগ যুগ ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক শাসন জারি রেখে পাহাড়ি জনগণের ওপর চালানো হচ্ছে নিপীড়ন-নির্যাতনের স্টিম রোলার। সংঘটিত করা হয়েছে ডজনের অধিক গণহত্যাসহ অসংখ্য সাম্প্রদায়িক হামলা। রাষ্ট্রের নিয়োজিত বাহিনী-সংস্থাগুলো বিচার বহির্ভুত হত্যাসহ প্রতিনিয়ত অন্যায় ধরপাকড়, বেআইনিভাবে ঘরবাড়িতে তল্লাশি, শারীরিক নির্যাতন, নারীর ওপর সহিংসতা, ভূমি বেদখল, ধর্মীয় পরিহানি, সন্ত্রাসী লেলিয়ে দিয়ে অধিকারকামী নেতা-কর্মী খুন, গুম, অপহরণসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সংঘটিত করেই যাচ্ছে।  

শান্তির বাণী শুনিয়ে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও চুক্তির পরবর্তী দীর্ঘ ২৮ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিপীড়ন-নির্যাতন, হামলা, ভূমি বেদখল-উচ্ছেদ, নারী নির্যাতন আগের মতোই অব্যাহত রয়েছে। বলা যায়, চুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে।

মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে ‘কাউকে খেয়াল খুশীমত গ্রেফতার বা আটক করা অথবা নির্বাসন দেয়া যাবে না’ এমন কথা উল্লেখ থাকলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে  সেনা শাসন ‘অপারেশন’ উত্তরণ জারি রেখে এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের নিয়োজিত সেনাবাহিনী যত্রতত্রভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে যাচ্ছে। ইচ্ছে হলেই যে কাউকে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার, নির্যাতন, রাত-বিরাতে ঘরবাড়ি তল্লাশি- হয়রানি, খবরদারি-নজরদারি, হাতে অস্ত্র গুঁজে দিয়ে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে জেল হাজতে প্রেরণ, ধর্ষণ, ভূমি বেদখলসহ নানা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটেই চলেছে।

সাধারণ পাহাড়িদের ওপর সেনাবাহিনীর নির্যাতনের চিত্র।


প্রত্যেকেরই একটি জাতীয়তার অধিকার রয়েছে। কাউকেই যথেচ্ছভাবে তার জাতীয়তা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না’ বলে মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে বলা হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত পাহাড়িসহ সংখ্যালঘু জাতিগুলোকে নিজস্ব জাতীয় পরিচয়ের অধিকার থেকেও বঞ্চিত করার অপচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ’৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানে যেভাবে উগ্র বাঙালি জাতীয়তা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, একইভাবে ২০১১ সালের ৩০ জুন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমেও বাঙালি জাতীয়তা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা এখনো সংবিধানে বহাল রয়েছে।

মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে শান্তিপূর্ণভাবে সকলের সম্মিলিত হবার অধিকারের কথা বলা হয়েছে। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজনৈতিক দল-সংগঠনগুলোকে গণতান্ত্রিকভাবে মিছিল-মিটিং ও সমাবেশ আয়োজনে প্রায়ই বাধা-নিষেধের সম্মুখীন হতে হয়। সেখানে এখনো অপারেশন উত্তরণ নামে সেনাশাসন ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় কর্তৃক দমনমূলক ‘১১ নির্দেশনা’ জারি রেখে গণতান্ত্রিক অধিকারকে সংকুচিত করে রাখা হয়েছে। সরকারের অনুমতি ছাড়া বিদেশী নাগরিকদের পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করতে ও পাাহড়িদের সাথে কথা বলতে দেওয়া হয় না। 

বাংলাদেশ জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদে স্বাক্ষর করলেও এদেশের শাসকগোষ্ঠি বরাবরই পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। দেশে বিভিন্ন কালাকানুন তৈরি করে জনগণের ওপর দমনপীড়ন চালিয়েছে।

চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যূত্থানে বাংলাদেশে টানা সাড়ে ১৫ বছরের অধিক আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট শাসনের অবসান হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ ও জাতিসত্তার জনগণ এখনো শোষণ-নিপীড়ন-বঞ্চনা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। সাধারণ জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। অভ্যুত্থানের পর ড. ইউনুসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অতীতের ফ্যাসিস্টদের মতোই পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের ওপর দমন-পীড়ন জারি রেখে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।

অন্তর্বতীকালীন সরকার গঠনের পর দেড় মাসের মাথায় ২০২৪ সালের ১৯-২০ সেপ্টেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামে দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি সদর ও রাঙামাটি শহরে পাহাড়িদের ওপর পর পর কয়েকটি সাম্প্রদায়িক হামলা ও সেনাবাহিনী কর্তৃক ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচার গুলি চালিয়ে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করা হয়।  এতে ৪ জন প্রাণ হারান। পাহাড়িদের শত শত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান-ঘরবাড়ি-উপসনালয়ে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, লুটপাট চালানো হয়।  কিন্তু ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার এ ঘটনার বিচারে এখনো কোন উদ্যোগ নেয়নি।

উক্ত ঘটনার এক বছর অতিক্রান্ত হতে না হতেই এ বছর ২৭ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি সদরে ও ২৮ সেপ্টেম্বর গুইমারায় পাহাড়িদের ওপর আবারো ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হামলা চালানো হয়।এতে তিন জন মারমা যুবক নিহত ও নারীসহ অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। অগ্নিসংযোগ করে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে পাহাড়িদের শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠার ও বসতবাড়ি। অন্তর্বর্তী সরকার এ ঘটনায় জড়িত সেনা-সেটলারদের গ্রেফতার ও বিচারতো করেই নি, উপরন্তু ঘটনাটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে সেনাবাহিনীকে দিয়ে পাহাড়িদের ওপর দমন-পীড়ন বাড়িয়ে দিয়েছে।

গুইমারায় সেনা-সেটলার হামলার চিত্র, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫।

বিশ্ব মানবাধিকার দিবসটির মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে বাংলাদেশ সরকার তথা রাষ্ট্রের উচিত জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র মেনে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে সংখ্যালঘু জাতি ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন, বিচার বহির্ভুত হত্যাসহ সকল ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করা এবং সুষ্ঠূ গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করা।

আর জনগণের করণীয় হলো মানবাধিকার সুরক্ষায় রাষ্ট্রীয় দমন-নিপীড়নসহ সকল অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তোলা।



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More