আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে শাহবাগে হয়ে গেলো ‘বহু ভাষার লহরী’

0

ঢাকা প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে উপলক্ষ করে সকল জাতিসত্তার মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকারসহ সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে ঢাকায় শাহবাগে অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘বহু ভাষার লহরী’ অনুষ্ঠান।

শনিবার (২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫) বিকাল ৪টায় পাহাড়, সমতল ও চা বাগানের পাহাড়ি-‌আদিবাসী জাতিসত্তার শিক্ষার্থী এবং নাগরিকদের যৌথ উদ্যোগে এ কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। আলোচনাপর্ব ও সাংস্কৃতিকপর্বে অনুষ্ঠানটি সাজানো হয়।

আলোচনা পর্বে বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক মানস চৌধুরী, পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ার এবং চাকমা ভাষার গবেষক পুলক জীবন খীসা, চা বাগান জাতিসত্তার প্রতিনিধি মিখা পিরেগু, সমতল আদিবাসীর প্রতিনিধি সোমা ডুমরি। এ পর্বটি সঞ্চালনা করেন বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদের সভাপতি অঙ্কন চাকমা।

সাংস্কৃতিকপর্বে নৃত্য পরিবেশন করেছে মুন্ডা নাচে সান্ত্বনা পাহান ও তার দল, ত্রিপুরা নাচের দল তপস্যা এবং মণিপুরী নৃত্যশিল্পী অবন্তী সিনহা। একক ও দলীয় সঙ্গীত পরিবেশনা করেছে বিবর্তন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, চম্পাবতী এন মারাক (গারো) এবং সুমনা হেমব্রম (মাহালী ভাষা)। এছাড়াও কর্মসুচিতে সংজগার(পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠী ভাষার ব্যান্ড), তাগল (চাকমা ব্যান্ড), তারাশ (সাঁওতাল ব্যান্ড), হুল (সাঁওতাল ব্যান্ড), রে রে (গারো ব্যান্ড) এবং সমগীত সংগীত পরিবেশন করে। পাশাপাশি প্রদর্শিত হয়েছে বহু ভাষার লড়াইয়ের ইতিহাস।

আলোচনা পর্বে অধ্যাপক মানস চৌধুরী বলেন, “আজকে একজন নবীনের সাথে দেখা হয়েছে যিনি ম্রো, তিনি আমাকে বললেন তাদের দুইটি ঔপনিবেশিক ভাষার চাপ সামলে বড় হতে হয়। বলাই বাহুল্য একটি ইংরেজি ভাষা এবং অন্যটি বাংলা। এটি বাংলাদেশের অন্যান্য জাতিসত্তার ভাষাভাষীদের ক্ষেত্রেও সত্য। বাংলাদেশের আদিবাসীদের দ্বিভাষী হওয়াটা বাধ্যতামূলক। তাদের নিজেদের ভাষা শেখার পাশাপাশি আবশ্যিকভাবে তাদের বাংলা ভাষাটাও শিখতে হয়। এমনকি শুধু শেখা বা জানা না, একজন ‌আদিবাসীকে পরীক্ষা দিতে হয় তিনি কিভাবে বাংলা বলছেন, সঠিক উচ্চারণে বাংলা বলছেন কিনা”।

তিনি আরও বলেন, ‘পাহাড় ও সমতলে প্রতিটি কর্মসুচি শুরুতে দেশাত্মবোধক গান গাওয়ার মাধ্যমে আদিবাসীদের প্রমাণ দিতে হয় যে তারা দেশের সহী নাগরিক। পাহাড়ে এবং সমতলের জাতিসত্তার কেউই কখনও এই রাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় প্রশাসনে ছিলেন না। বহু বছর আগে এখানে সার্বভৌম সাঁওতাল পরগণা অঞ্চল ছিল, সার্বভৌম মণিপুরি রাজ্য ছিল, সার্বভৌম মুন্ডা পরগণা ছিলো। একবার কলকাতায় একজন মুন্ডারি দাঁড়িয়ে বলেছিলেন “আমাদের যখন সার্বভৌম রাজত্ব ছিল, তখন কোন বাঙালির উদ্ভব হয়নি”। তিনি বাংলাদেশে সেনাশাসন, কর্পোরেট কোম্পানি এবং আমলাতন্ত্র যেভাবে পাহাড় এবং সমতলের আদিবাসীদের জীবন ও অস্তিত্ব ঝুঁকিতে ফেলেছে তা বর্ণনা করে জানান যে, যখন একটি জাতির জীবন অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে তখনই তার ভাষা চর্চা কঠিন হয়ে পড়ে।

চাকমা ভাষার গবেষক পুলক জীবন খীসা বলেন, ‘আমি চাকমা ভাষায় কথা বলতে কখনই দ্বিধাবোধ করিনা। আমি মনে করি প্রতিটি জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেতে হবে এবং প্রতিটি জাতিসত্তাকেই তার মাতৃভাষায় স্বচ্ছন্দে কথা বলার সাহস অর্জন করতে হবে, চর্চা করতে হবে’। তিনি চাকমা হরফ/লিপি ও চাকমা ভাষাকে বাংলার চাইতে প্রাচীন বলেও অভিমত দেন।

সমতলের প্রতিনিধি ও বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সংগঠক সোমা ডুমরি জানান, ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠী কেবল ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনেই যুক্ত ছিলো না, তারা যুক্ত ছিল ৭১ এ এবং সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী জুলাই আন্দোলনেও। কিন্তু পরবর্তীতে তাদেরকে ন্যারেটিভ থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়।‘

তিনি আরও বলেন, ‘আমার মাতৃভাষা মাহালি এবং আমি মাহালি ভাষায় কথা বলি। আদিবাসীরা যখন তাদের নিজ মাতৃভাষায় কথা বলে তাদেরকে বিভিন্ন রকম অপমান এবং হয়রানির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। অথচ ভাষা কেবল যোগাযোগ না, ভাষা হচ্ছে নিজের অনুভূতিকে প্রকাশের মাধ্যম’।

চা বাগান জাতিসত্তার প্রতিনিধি মিখা পিরেগু বলে, ‘চা বাগানে ৯০টির অধিক জাতিসত্তার ভাষা রয়েছে। অথচ তা নিয়ে গবেষণা এবং সংরক্ষণের ভুমিকার ক্ষেত্রে কখনোই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেওয়া হয় না’।

বহু ভাষার লহরীর সাংস্কৃতিক পর্ব সঞ্চালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইশরাত জাহান ইমু। শাহবাগে বিভিন্ন জাতিসত্তার নিজ মাতৃভাষায় পরিবেশিত গানে, নৃত্যে এবং কবিতায় মধ্যরাত পর্যন্ত চলে এ পর্বটি।



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More