ইউপিডিএফ নেতা মাইকেল চাকমা গুম হওয়ার ৪ বছর, এখনো খোঁজ মিলেনি

0

নিজস্ব প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
রবিবার, ৯ এপ্রিল ২০২৩

মাইকেল চাকমা। ফাইল ছবি

আজ ৯ এপ্রিল ২০২৩ ইউপিডিএফ’র অন্যতম সংগঠক ও ইউনাইটেড ওয়ার্কার্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউডব্লিউডিএফ) এর সাধারণ সম্পাদক এবং জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের ওয়ার্কিং টিমের সদস্য মাইকেল চাকমা গুম হওয়ার চার বছর পূর্ণ হলো। ২০১৯ সালের আজকের এই দিন নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর এলাকা থেকে সাংগঠনিক কাজ শেষে ঢাকায় ফেরার পথে রাষ্ট্রীয় সংস্থা কর্তৃক গুমের শিকার হন মাইকেল চাকমা। আজ চার বছরেও তাঁর কোন খোঁজ মেলেনি। রাষ্ট্র তাঁর সন্ধান দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

রাষ্ট্রীয় কোন সংস্থাই যে মাইকেল চাকমাকে তুলে নিয়ে গুম করেছে তার সুস্পষ্ট প্রমাণ মেলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর অসহযোগিতামূলক নানা আচরণের মাধ্যমে।

মাইকেল চাকমা নিখোঁজ হওয়ার পর ১৬ এপ্রিল ’১৯ তার এক আত্মীয় ধনক্ক চাকমা নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ থানায় অভিযোগ দায়ের করেন এবং ১৯ এপ্রিল একই থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। পুলিশ প্রথম দিকে মাইকেল চাকমাকে উদ্ধারে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার কথা বললেও পরে অবস্থান পাল্টিয়ে অসহযোগিতামূলক আচরণ শুরু করে। এমনকি থানায় জিডির বিষয়টি পর্যন্ত অস্বীকার করে।

এরপর ২০১৯ সালের ১৩ মে মাইকেল চাকমার বড় বোন সুভদ্রা চাকমা মাইকেল চাকমার সন্ধানের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করলে ২১ মে হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ মাইকেল চাকমা নিখোঁজের বিষয়ে ৫ সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত করে রিপোর্ট পেশ এবং তার অবস্থান সংক্রান্ত তথ্য জানাতে স্বরাষ্ট্র সচিবকে নির্দেশ প্রদান করেন। কিন্তু আজ তিন বছরেও এ নির্দেশের কার্যকারিতা লক্ষ্য করা যায়নি।

এদিকে পুলিশ জিডির বিষয়টি অস্বীকার করার প্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ২৫ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আকমল হোসেনের নেতৃদ্বে নাগরিক সমাজের একটি প্রতিনিধি দল সোনারগাঁ থানায় পূনরায় জিডি করতে যান। এ সময় থানায় দায়িত্বরত এসআই পঙ্কজ কান্তি সরকার পূর্বেকার জিডির বিষয়টি স্বীকার করলেও অদ্যাবধি পুলিশ মাইকেল চাকমার সন্ধানে কোন তৎপরতা দেখায়নি।

ইউপিডিএফভুক্ত বিভিন্ন সংগঠনসহ দেশের প্রগতিশীল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও ব্যক্তি মাইকেল চাকমার সন্ধানের দাবি জানিয়ে আসছেন। এই দাবিতে বিক্ষোভ, মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলনসহ নানা কর্মসূচি পালিত হয়েছে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, সিএইচটি কমিশনসহ মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিগণও মাইকেল চাকমা গুমের উদ্বেগ প্রকাশ করে তাঁর সন্ধান দেয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু সরকারের দিক থেকে মাইকেল চাকমার সন্ধানে চার বছরেও কার্যকর কোন পদক্ষেপ দেখা যায়নি।

মাইকলে চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে ও মানবাধিকারের পক্ষে সর্বদা সোচ্চার ছিলেন। তিনি দেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক মহলেও একজন সুপরিচিত রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। গুম হওয়ার কিছুদিন আগে তিনি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একটি প্রতিনিধি দলের সাথে সাক্ষাত করেছিলেন।

মূলত অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে তাঁর বলিষ্ট কণ্ঠ রুদ্ধ করে দেয়া ও পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলনরত ইউপিডিএফ’র ওপর রাজনৈতিক দমন-পীড়নের অংশ হিসেবে তাকে রাষ্ট্রীয় কোন একটি সংস্থা তাকে গুম করেছে-এটা দিবালোকের মতো পরিষ্কার।

তিনি নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে ইউপিডিএফ’র ওপর রাজনৈতিক দমন-পীড়ন ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পায়। রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক শত শত নেতা-কর্মীকে অন্যায়ভাবে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। কথিত ‌‘বন্দুকযুদ্ধের’ নামে বিনা বিচারে গুলি করে হত্যা করা হয় বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মীকে। সর্বশেষ গত বছর ১৫ মার্চ দীঘিনালায় ইউপিডিএফ নেতা নবায়ন চাকমা মিলন (সৌরভ)-কে অন্যায়ভাবে গ্রেফতারের পর অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

মাইকেল চাকমাকে খোঁজার প্রশ্নে রাষ্ট্রের বিভিন্ন আইন-প্রয়োগকারী সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর নানা অসহযোগিতামূলক আচরণই প্রমাণ করে মাইকেল চাকমা রাষ্ট্রের হেফাজতেই বন্দি রয়েছেন।

তাঁর পরিবার-পরিজন, দলের নেতা-কর্মী, দেশের বিভিন্ন প্রগতিশীল ও মানবাধিকার সংগঠন, ব্যক্তি ও নাগরিক সমাজ এখনো মাইকেল চাকমার প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় পথ চেয়ে রয়েছেন। সরকারের উচিত মাইকেল চাকমাকে সুস্থভাবে তাঁর পরিবার ও সংগঠনের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হওয়া।

এদিকে, মাইকেল চাকমা গুম হওয়ার ৪ বছর উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে অপহরণ, গুম, খুনসহ মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ এবং ইউপিডিএফ নেতা মাইকেল চাকমার সন্ধানের দাবিতে চার সংগঠন ইউনাইটেড ওয়ার্কার্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট, গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন আজ ঢাকায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অভিমুখে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করবে। এছাড়া সংগঠনগুলোর উদ্যোগে “অবিলম্বে মাইকেল চাকমার সন্ধানের দাবিতে এক হোন, অপহরণ, গুম ও খুনের বিরুদ্ধে রাজপথে নামুন, আন্দোলন গড়ে তুলুন” শিরোনামে একটি প্রচারপত্রও প্রকাশ করা হয়েছে।

চার সংগঠনের প্রকাশিত প্রচারপত্র।

অপরদিকে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল ‘মাইকেল চাকমাসহ গুম করা ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দেয়ার দাবিতে সোচ্চার হোন’ আহ্বানে একটি পোস্টার প্রকাশ করেছে। এতে গুম, বিচার বহির্ভুত হত্যা বন্ধ; ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮, বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ সহ নিবর্তনমূলক সকল আইন বাতিল, পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের ১১ দফা নির্দেশনা বাতিলসহ বিভিন্ন দাবি জানানো হয়েছে।


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।


সিএইচটি নিউজের ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More