ইউপিডিএফ সব সময় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ওপর শ্রদ্ধাশীল: মাইকেল চাকমা

ঢাকা প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
শনিবার, ১০ মে ২০২৫ে
ইউপিডিএফ সব সময় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ওপর শ্রদ্ধাশীল এবং একটি মানবিক, কল্যাণকর ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রই ইউপিডিএফের লক্ষ্য বলে জানিয়েছেন দলটির অন্যতম সংগঠক মাইকেল চাকমা।
আজ শনিবার (১০ মে ২০২৫) সকাল ১০টায় জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে ইউপিডিএফের সাথে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে তিনি এ কথা বলেন।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য সফর রাজ হোসেন, বদিউল আলম মজুমদার, মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া।
আর মাইকেল চাকমার নেতৃত্বে ইউপিডিএফ প্রতিনিধি দলে ছিলেন বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদে কেন্দ্রীয় সভাপতি অমল ত্রিপুরা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি জিকো ত্রিপুরা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাবেক সভাপতি ও ইউপিডিএফ সদস্য সুনয়ন চাকমা।
বৈঠকে মাইকেল চাকমা বলেন, ইউপিডিএফ প্রতিষ্ঠার পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়িত জাতি ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছে। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানেও আমাদের দল অংশগ্রহণ করে। আমাদের সংগঠন শুরু থেকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, নিপীড়নের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামে নিয়োজিত রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, যে অন্যায় শাসন পার্বত্য চট্টগ্রামে চলেছে, তার অবসানের লক্ষ্যে, এই বাংলাদেশকে বহুজাতির বহু ভাষার একটি বৈচিত্র্যময় দেশ হিসেবে যাতে প্রতিষ্ঠা করা যায়, সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশের সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে ইউপিডিএফ অনেক বেশি নিপীড়নের শিকার হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।

মাইকেল চাকমা বলেন, আমরা চেয়েছিলাম এই বাংলাদেশ একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক দেশ হোক, এই দেশে সকল ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল জাতি সত্তার মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজের রাজনৈতিক অধিকার, ভাষা সংস্কৃতির অধিকার ভোগ করুক।
কিন্তু বিগত সময়ে ইউপিডিএফের উপরে যেভাবে দমন-পীড়ন চালানো হয়েছিল, ইউপিডিএফ সেই রেজিমের প্রতি প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে।
২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে পার্বত চট্টগামের ২৭টি ভোটকেন্দ্রে শূন্য ভোট পড়ার কথা তুলে ধরে এই ইউপিডিএফ নেতা বলেন, এর মধ্য দিয়ে সেই রেজিমের পতনের সূচনা শুরু হয়। সেই রায় ছিল গণরায়, ইউপিডিএফের নেতৃত্বে জনগণ লালকার্ড দেখিয়েছিল। সেই লালকার্ড দেখানো থেকে শুরু করে, সর্বশেষ ছাত্র জনতার প্রতিবাদ প্রতিরোধ উত্থান হয়, সবশেষ শেখ হাসিনাকে দেশ ছাড়তে হয়।
মাইকেল চাকমা বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পরও পাহাড়ে যা ঘটেছে, তা কখনো প্রত্যাশিত ছিল না।
“ইউপিডিএফ সব সময় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ওপর শ্রদ্ধাশীল এবং একটি ‘মানবিক, কল্যাণকর ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র কায়েমই ইউপিডিএফের লক্ষ্য” বলেন তিনি।
“এই লক্ষ্যে ২০২৪’র গণঅভ্যুত্থানের পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে, এই সরকারের কাছ থেকে আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ অনেক কিছু আশা করেছিলাম। আমরা ভেবেছিলাম, অতীতে যে সমস্ত দমন পীড়ন চলে আসছিল, সেই দমন পীড়নের কিছুটা হলেও অবসান হবে এবং এই নতুন বাংলাদেশে আমরা আমাদের অধিকার নিয়ে পার্বত্য চট্টগামে অনেকটা স্বস্তিতে ভালো অবস্থায় থাকতে পারব।”
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, সেই ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের পর রাঙামাটি এবং খাগড়াছড়িতে যে ঘটনা ঘটেছে, হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, এটা কখনো প্রত্যাশিত ছিল না।

মাইকেল চাকমা বলেন, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল, সেই তদন্ত কমিটি এখনো প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। ফলে কারা সেই হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল, তা জানতে পারলাম না। তাছাড়া এখন পর্যন্ত পার্বত্য চট্রগ্রামে যে অবস্থা রয়েছে, সেই ক্ষেত্রে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যে কার্যক্রম, এর প্রতি আমরা কিছুটা হতাশা ব্যক্ত করতেই পারি।
অতীতের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশের সবার জন্য মঙ্গলজনক পদক্ষেপ গ্রহণ করে একটি সুখী সমৃদ্ধশালী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নের কথা বলেন এই ইউপিডিএফ নেতা।
এর আগে গত ১০ এপ্রিল ২০২৫ সংবিধান সংস্কার কমিশন, জন প্রশাসন সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন ও পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ওপর জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে ইউপিডিএফ মতামত প্রদান করে।
এতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ঘোষণা ও জাতীয় সংসদে পাহাড়িদের জন্য সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা করা, পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থা প্রণয়ন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপমুক্ত প্রশাসন ব্যবস্থা চালুকরণ, পর্যটন শিল্পের সার্বিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় পাহাড়িদের অংশগ্রহণ, মিশ্র পুলিশ বাহিনী গঠন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় সংখ্যানুপাতিক হারে পাহাড়িদের মধ্য থেকে বিচারক নিয়োগ বিধান প্রণয়ন, পাহাড়িদের প্রথাগত ভূমি অধিকার প্রদানসহ বিভিন্ন মতামত তুলে ধরা হয়। এসব মতামতের ভিত্তিতেই আজকের বৈঠকে আলোচনা হয়।
বৈঠকের শুরুতে আলী রীয়াজ বলেন, “একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রই কেবল সকলের অধিকারকে নিশ্চিত করতে পারে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারে। বিকেন্দ্রিত বিচার বিভাগের মধ্য দিয়ে প্রত্যেকটা মানুষের ঘরের দরজায় সুবিচারের ব্যবস্থা করতে পারে।
“জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সকলের সঙ্গে আলোচনা করে জাতীয় সনদ তৈরি করার জন্য সচেষ্ট আছে। তাতে আশা করছি সব ধরনের নাগরিক অধিকার সুরক্ষিত করতে পারবে। সেই সুরক্ষা ছাড়া গণতান্ত্রিক সমাজ, রাষ্ট্র, নাগরিকদের মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।”
তিনি বলেন, “আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে আমরা যেন সকল নাগরিক মিলে, সকল ধরনের মত মিলে একটি সুনির্দিষ্ট পথ তৈরি করতে পারি। এটা একটা ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যা তৈরি হয়েছে বহু প্রাণের বিনিময়। এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারর মত পেয়েছি, যে সুযোগ, এই মুহূর্তকে প্রকৃত পক্ষে সফল করে তোলার জন্য আমাদের সকলকে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে।
“আশা করছি বাংলাদেশের সমস্ত নাগরিক, রাজনৈতিক দল এই আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে অগ্রসর হবে। রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে এমন এক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যেখানে নাগরিক যেন মনে না করেন তার অধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। তার যেন নাগরিক অধিকারকে সুরক্ষা করবার প্রতিষ্ঠান থাকে। সেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, যে রাষ্ট্র মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করে, সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করে, সকলের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠা করে, সেই লক্ষ্যে আমরা সকলেই কাজ করার চেষ্টা করছি।”
আলী রীয়াজ বলেন, “নিঃসন্দেহে ইউপিডিএফ একটি ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত রাজনৈতিক দল। তারা নাগরিকদের অধিকার আদায়ে দীর্ঘদিন সংগ্রামে লিপ্ত আছে, সক্রিয় থেকেছে। আপনারা বিভিন্নভাবে নির্যাতিতও হয়েছেন, অধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। আপনাদের রাজনৈতিক অবস্থানের ভিন্নতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার আদর্শ-সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা, সে বিষয়ে অবিচল অঙ্গীকার লক্ষ্য করেছেন।”
উল্লেখ্য, রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর একীভূত সুপারিশ চূড়ান্ত করার পাশাপাশি এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য তৈরির জন্য কাজ করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
পাঁচটি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশের ওপর ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মতামত জানতে চেয়েছিল ঐকমত্য কমিশন। এরপর সেই মতামত ধরে সংশ্লিষ্ট দলের সঙ্গে সংলাপ চলছে। তারই ধারাবাহিকতায় আজ ইউপিডিএফের সাথে কমিশন বৈঠক করেছে।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।