ইতিহাসে এ দিন : ধুধুকছড়ায় সন্তু লারমার প্রতিক্রিয়াশীল উক্তি: আন্দোলনের বুকে ছুরিকাঘাত

0
সন্তু লারমা। সংগৃহিত ছবি

১৯৯৫ সালের ১৫ জুন পানছড়ির সীমান্তবর্তী গ্রাম ধুধুকছড়ায় অপেক্ষমান ছাত্র-জনতার উদ্দেশ্যে সরকার ও জেএসএসের মধ্যেকার চলমান বৈঠক ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ভবিতব্য সম্পর্কে ধারণা দেয়ার সময় সন্তু লারমা ‘জঙ্গী আন্দোলন করে স্বায়ত্তশাসন আদায় হয় না। গুলতি মেরে স্বায়ত্তশাসন আদায় হয় না।’ বলে প্রতিক্রিয়াশীল উক্তি এবং পিসিপির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিষোদগার করেন ।

তার এই বক্তব্যে সমাবেশস্থলেই ছাত্র-জনতার মাঝে গুঞ্জন শুরু হয় এবং বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বেশির ভাগ লোক অসন্তোষ প্রকাশ করেন। সমাবেশে তৎকালীন পানছড়ি উপজেলার পাহাড়ি গণপরিষদের সভাপতি প্রদীপলাল চাকমাও উপস্থিতি ছিলেন। তিনি দাঁড়িয়ে সন্তু লারমার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রেখে জানতে চান, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্তশাসন তাহলে কোন পথে অর্জিত হতে পারে? কীভাবে আন্দোলন করা দরকার, আপনি আমাদের বলে দিন!’

উপস্থিত জনতা মনে করেছিলে সন্তু লারমা প্রদীপ লাল চাকমার প্রশ্নের উত্তর দেবেন। তাই ভবিষ্যত আন্দোলনের ব্যাপারে দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য শোনার আশায় তারা অধীর আগ্রহী হলেও সন্তু লারমা উক্ত প্রশ্নের কোন জবাব দেন নি। সন্তু লারমার হয়ে জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় নেতা গৌতম কুমার চাকমা উপস্থিত ছাত্র-জনতার উদ্দেশ্যে দু’চার কথা বলেন, পরবর্তীতে আলোচনার আশ্বাস দিয়ে তারা দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। ফলে হট্টগোল, গুঞ্জন ও নানা বিরূপ মন্তব্যের মধ্য দিয়ে সমাবেশ ভঙ্গ হয়।

এরপর প্রদীপ লাল চাকমা সমাবেশস্থল ছেড়ে নিকটস্থ ধুধুকছড়া দোকানে যান এবং সেখানে জড়ো-হওয়া লোকজনের সামনে সন্তু লারমার বক্তব্যে আবারও অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি এমনও মন্তব্য করেন, ‘এরা কেমন ধরনের জাতীয় নেতা? আমাদের মতো থানা লেভেলের নেতা-কর্মীদের প্রশ্নের উত্তর পর্যন্ত তারা ঠিক মতন দিতে পারলেন না!’ ধারণা করা হয় প্রদীপ লাল চাকমার এই মন্তব্য সন্তু লারমার কানে যায় এবং আত্মসমর্পনের পর ১৯৯৮ সালের ৪ এপ্রিল সন্তু লারমা প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে প্রদীপ লাল চাকমা ও কুসুমপ্রিয় চাকমাকে খুন করেন।

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার যে, আন্দোলন সম্পর্কে সন্তু লারমার উক্ত ১৫ জুনের প্রতিক্রিয়াশীল বক্তব্যের আড়াই থেকে তিন মাস পর খাগড়াছড়িতে সেনা গোয়েন্দারা “পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, পাহাড়ি গণ পরিষদের সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটি” বা পিপিএসপিসি নামে একটি ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী গঠন করেছিল। অনেকে মনে করেন সন্তু লারমার উক্ত বক্তব্য ছিল সেনাবাহিনীর কাছে একটি গ্রীন সিগন্যাল। অর্থাৎ পিসিপি, পিজিপিসহ গণসংগঠনগুলোর ওপর আঘাত হেনে তাদের দুর্বল করা যাতে সরকারের কাছে জেএসএসের আত্মসমর্পনের পথ পরিস্কার করা যায়।

এরপর পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনীতি ও আন্দোলনের মোড় উল্টো দিকে ঘুরতে থাকে। একদিকে সরকার-সেনাবাহিনী পিপিএসপিসি ঠ্যাঙাড়েদের দিয়ে এবং অন্যদিকে জেএসএস-শান্তিবাহিনী অর্থাৎ সে সময়ে চলমান সংলাপের উভয় পক্ষ আন্দোলনকারী শক্তি পিসিপি, পিজিপি ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের ওপর আঘাত হানা শুরু করে। ঠ্যাঙাড়েরা বিম্বিসার খীসাকে অপহরণসহ পুরো খাগড়াছড়ি জেলায় সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে এবং তাদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে অমর বিকাশ চাকমা শহীদ হন। অন্যদিকে সন্তু লারমাও বসে থাকেননি। তিনিও সেনা-সৃষ্ট ঠ্যাঙাড়েদের সাথে তাল মিলিয়ে উক্ত তিন সংগঠনের ওপর চড়াও হন। পাহাড়ি গণ পরিষদের তৎকালীন প্রধান ও বর্তমানে ইউপিডিএফ সভাপতি প্রসিত বিকাশ খীসাসহ আরো কয়েকজন নেতাকে যেখানে পাওয়া যায় সেখানে ‘গ্রেফতার’ করতে  শান্তিবাহিনীর কাছে নির্দেশ দেন। পানছড়িতে প্রদীপ লাল চাকমা, কুসুম প্রিয় চাকমা, দেবোত্তম চাকমা, রিংকু চাকমাসহ আরো কয়েকজন নেতা রাজনীতি করতে পারবে না বলে সন্তু লারমা ডিক্রি জারি করেন এবং তাদের কয়েকজনকে বলপূর্বক সংগঠন থেকে পদত্যাগে বাধ্য করেন। খাগড়াছড়িতে পিসিপির সম্মেলনে যোগ দেয়ার কারণে সুবলঙে শান্তিপ্রিয় চাকমা ও চন্দ্র মোহন চাকমাকে শান্তিবাহিনীর সদস্যরা মারধর করে। এভাবে সন্তু লারমা সরকারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা জনগণের আন্দোলনের পিঠে ছুরিকাঘাত করেন এবং নিজের আত্মসমর্পনের পথ পরিস্কার করে নেন।

ধুধুকছড়ায় প্রতিক্রিয়াশীল বক্তব্যদানের পরবর্তী ১ বছর ৫ মাস ১৭ দিনের মাথায় সন্তু লারমা সরকারের সাথে লিখিত ‘পার্বত্য চুক্তি’ সম্পাদন করেন, ‘অলিখিত চুক্তিতে’ আবদ্ধ হন এবং শেখ হাসিনার কাছে একে ৪৭ রাইফেল হস্তান্তরের মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করে আন্দোলন গুটিয়ে ফেলেন। এর প্রতিদান হিসেবে তিনি সরকারের কাছ থেকে আঞ্চলিক পরিষদের গদি লাভ করেন।

সহজ শেখ হাসিনার হাতে সন্তু লারমার অস্ত্র সমর্পণ। ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮, খাগড়াছড়ি স্টেডিয়াম।

নব্বইয়ের দশকে ছাত্র-গণজাগরণের উত্তাল সময়ে সরকারের সাথে আপোষ সহজ ছিল না। লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে আত্নসমপর্ণের পথ প্রশস্ত করতেই সন্তু লারমা ধুধুকছড়ায় পরিকল্পনা মাফিক এমন প্রতিক্রিয়াশীল বক্তব্য দিয়ে সুবিধাবাদ ও দালালি উস্কে দিয়েছিলেন। সন্তু লারমার এই প্রতিক্রিয়াশীল বক্তব্য আন্দোলনের বুকে ছুরিকাঘাত ও জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার সামিল। এজন্য তিনি ইতিহাসে চিরদিন নিন্দিত ও ঘৃণিত হয়ে থাকবেন।

প্রকৃত সংগ্রামী নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে ও আক্রমণ চালিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে সন্তু লারমা এখনও আন্দোলনে বিভ্রান্তি ও অচলাবস্থা সৃষ্টির অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছেন। তার প্রত্যক্ষ মদতে ও নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের সুবিধাবাদী আপোষকামী ধারাটি শাসকগোষ্ঠীর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নিয়োজিত রয়েছে। অন্যদিকে আপোষহীন বিপ্লবী ধারাটি সকল বাধা-ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মরণপণ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। তারাই এখন অনেক সংগ্রামের পর প্রধান ধারায় পরিণত হতে চলেছে। #



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More