মতামত

উৎসবের চেতনা সমুন্নত রাখুন

0

 সংগৃহিত ছবি


এন চাকমা


বছর ঘুরে আবার আমাদের মাঝে এসে হাজির হয়েছে ঐতিহ্যবাহী প্রধান সামাজিক উৎসব ‘বৈ-সা বি’ (বৈসুক, সাংগ্রাই, বিঝু, বিষু, বিহু…)। পার্বত্য চট্টগ্রামের চেঙ্গী-মাইনী-ফেনী-কাচল-বড়গাঙ-শঙ্খ-মাতামুহুরী অববাহিকায় ঐতিহ্যবাহী সর্বজনীন উৎসব এটি। প্রতি বছরই পালিত হয় এই উৎসব। কিন্তু দিন দিন লোপ পাচ্ছে উৎসবের চেতনা। আগের সেই রীতি ও ঐতিহ্য মানছে না অনেকে। আনন্দ স্ফুর্তির নামে স্পষ্টততই বিকৃতি ঘটছে ঐতিহ্য-সংস্কৃতির। হারিয়ে যাচ্ছে উৎসবের সর্বজনীন রূপ।

পার্বত্য চট্টগ্রামে এই উৎসব ছিলো সত্যিই সর্বজনীন। সমাজের কোন শ্রেণীর লোকই উৎসবের আনন্দ থেকে বাদ যেতো না। এ উৎসব শুধু যে ঘুরে বেড়ানো, খাওয়া-দাওয়া, গান-বাদ্য বাজনা আনন্দ স্ফুর্তি করা–তা কিন্তু নয়। সাথে সাথে এটি গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, জীবপ্রেম, প্রকৃতি প্রেমের চেতনা জাগিয়ে তোলারও বিশেষ উপলক্ষ। উৎসব লগ্নে রীতি অনুযায়ী তরুণীরা দল বেঁধে সমাজের বয়োবৃদ্ধ গুরুজনদের স্নান করাতো, এটি ভালোবাসা প্রকাশের উজ্জ্বল নিদর্শন। নদীতে ফুল দিয়ে প্রকৃতি ও পরিবেশের সাথে একাত্মতা প্রদর্শন, বাড়ির গৃহপালিত পশুপাখিদের প্রতি বিশেষ যত্ন নেওয়া, গৃহপালিত গরু-ছাগল-মহিষদের ফুলের মালা পরিয়ে সাজিয়ে দেওয়া, মূল বিঝুর দিনে বাড়ি বাড়ি ঘুরে গ্রামের ছেলে-মেয়েদের হাস-মুরগীর জন্য খাবার দেওয়া–এসবই হচ্ছে এ উৎসবের জীবপ্রেম, প্রকৃতি প্রেমের এক উজ্জ্বল দিক।

বর্তমানে উৎসবের পুরোনো সংস্কৃতি-চেতনা-মূল্যবোধ হারিয়ে যেতে বসেছে। উৎসব আয়োজনের ধরণ আর উপকরণও পাল্টে যাচ্ছে। গেংখুলি আর গরিয়া নৃত্যের স্থান দখল করছে ব্যান্ড শো নামের এক উদ্দামতা। উৎসবের খাবারের তালিকায় উপাদেয় হিসেবে ‘পাজন’ (মারমা ভাষায় পাসং ও ত্রিপুরা ভাষায় পাচন)-এ স্থান এখনো শীর্ষে থাকলেও, ঐতিহ্যবাহী পিঠা-পায়েস এর পরিবের্ত রুটি-মাংস, পোলাও-বিরিয়ানি-মিষ্টি…ইত্যাদি চালু করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে এক শ্রেণীর স্বচ্ছল লোকদের মধ্যে। যা পুরোপুরিই এই উৎসবের রীতি-প্রথা ও ঐতিহ্যের পরিপন্থি। মূল বিঝুতে ‘পাজন-পাসং-পাচন’ আর সামর্থ্য অনুযায়ী ঐতিহ্যবাহী পিঠা-পায়েস-ফলমূল-সরবত নিয়ে অতিথি আপ্যায়নই হচ্ছে নিয়ম। পোলাও-বিরিয়ানি আয়োজনের কোন মানে হতে পারে না। রুটি-মাংস… এ জাতীয় খাবার পরিবেশন করে ঈদ-কোরবানি উৎসবের অন্ধ অনুকরণ করে নিজেদের সংস্কৃতির বিকৃতি ঘটানো কারোরই কাম্য হতে পারে না।

ঐতিহ্য রক্ষার দোহাই নিয়ে মদ্য পানে উৎসাহীরা এই উৎসবের সুযোগে মহাসমারোহে আয়োজন করে থাকে মদ-জগরা কানজির।

মদ্য পান আর মাতলামি করে তারা ঐতিহ্যের রক্ষক, ধারক বাহক বনে যায়। যা কখনোই একটা উন্নতি প্রয়াসী সমাজের ঐতিহ্য বলে বিবেচিত হতে পারে না। মদে চুর হয়ে রাস্তা-ঘাটে বিবস্ত্র হয়ে পড়ে থাকা, বেসুরে গান পাওয়া… কখনই ঐতিহ্য সংস্কৃতি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না।

বৃক্ষ যেমন পুরোনো ছাল ও ঝেড়ে ফেলে, মাটি থেকে রস আহরণ ও সূর্যের আলো বাতাস গ্রহণ করে সতেজ সুন্দর হয়ে বেড়ে ওঠে, একটা সমাজ ও জাতিকেও সেভাবে পুরনো জীর্ণ প্রথা কুসংস্কার ভেঙে অতীত বীরত্ব গাঁথা থেকে প্রেরণা ও শক্তি নিয়ে সামনে অগ্রসর হতে হয়। যে বৃক্ষ যত উঁচু তার শিকড় থাকে তত গভীরে। একটা জাতির বেলায়ও তা সত্য। সুসভ্য জাতির মূল শিকড় হচ্ছে নিজেদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। অতীতে গর্ব করার মতো আমাদের যেসব ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ ছিলো–সে সব আমাদেরকে আবার জাগিয়ে তুলতে হবে। ঐতিহ্যবাহী এই সামাজিক উৎসবের চেতনা পুনঃজাগরিত করে প্রতিষ্ঠা করতে হবে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জাতিসত্তাসমূহের ঐশ্বর্যমণ্ডিত সংস্কৃতি-ঐতিহ্যকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে।

তাই, বৈ-সা-বি শুধু আনন্দের নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জাতিসত্তাসমূহের ঐতিহ্যবাহী ঐশ্বর্যমণ্ডিত সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবে এই উৎসবের চেতনা সমুন্নত রাখতেই হবে।



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More