মতামত

একটি বিরল ছাত্র আন্দোলন হত্যার এক বছর

0
চার শহীদের গ্রাফিতি


সুনয়ন চাকমা, সাবেক সভাপতি, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ 


২৪-এর জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতন এবং এতে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বদানকারী ভূমিকা পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি ছাত্র সমাজকে প্রবলভাবে আলোড়িত ও উজ্জ্বীবিত করেছিল। গ্রাফিতি আঁকায় সেনাদের বাধা, ছাত্র নির্যাতন ও হয়রানির প্রতিবাদে তারা ঝাঁকে ঝাঁকে রাস্তায় নেমেছিল। আন্দোলনের এক পর্যায়ে তারা “সংঘাত ও বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন” নামে একটি প্লাটফরমে সংগঠিত হতে চেষ্টা করে।

১৮ সেপ্টেম্বর সকালে এই সংগঠনের পক্ষ থেকে খাগড়াছড়ি শহরে ৮ দফা দাবিতে “মার্চ ফর আইডেন্টিটি” আয়োজন করা হয়। আনুমানিক ৪০ হাজার পাহাড়ি শিক্ষার্থী এতে অংশ নেয়, যা ছিল এক অভূতপূর্ব ঘটনা।

ছাত্রদের এই যুগান্তকারী উত্থানে সেনা-শাসকগোষ্ঠী ভয় পেয়ে যায়। তারা এই উদীয়মান ছাত্র আন্দোলনকে অঙ্কুরে শেষ করে দিতে ষড়যন্ত্র করতে থাকে এবং তাদের হাতে থাকা সকল Asset বা শক্তি নিয়োজিত করে। যেমন: উগ্র সাম্প্রদায়িক সেটলার সংগঠন, ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী ও জনসংহতি সমিতির সন্তু গ্রুপকে।

এই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সেনা গোয়েন্দারা ১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি শহরে মোঃ মামুন ও তার এক কর্মচারীকে ঠ্যাঙাড়ে সন্ত্রাসীদের দিয়ে অপহরণ ও পরে মামুনকে খুন করিয়ে পাহাড়ি-বাঙালি দাঙ্গা বাঁধিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চালায়। কিন্তু জনগণের প্রতিরোধের কারণে তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়।

এর পরদিন অর্থাৎ ১৯ সেপ্টেম্বর বাঙালি ছাত্র পরিষদ মামুন হত্যার জন্য পাহাড়িদের দায়ি করে দীঘিনালায় মিছিল করে এবং এক পর্যায়ে পাহাড়িদের ওপর হামলা চালায়। তারা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাটে লুটপাট করে ও আগুন ধরিয়ে দেয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরাও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য হাসিলের উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত এই হামলায় সেটলারদের সাথে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেয়। তাদের পিঠুনিতে ধনরঞ্জন চাকমা গুরুতর জখম হন ও পরে খাগড়াছড়ি হাসপাতালে মারা যান।

খাগড়াছড়িতে সংঘাত ও বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন-এর মার্চ ফর আইডেন্টিটি কর্মসূচির চিত্র, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪। ফাইল ছবি


দীঘিনালা হামলার প্রতিবাদে সন্ধ্যা থেকে শত শত লোকজন খাগড়াছড়ি-পানছড়ি সড়কে নেমে পড়ে। দীঘিনালার মতো খাগড়াছড়ি শহরেও হামলা হতে পারে এই আশঙ্কায় লোকজন রাতে পাহারা দিতে থাকে। এ সময় রাতে টহলরত সেনা সদস্যরা স্বনির্ভর এলাকায় জড়ো হওয়া পাহাড়িদের ওপর বিনা উস্কানিতে গুলি চালায়। এতে জুনান চাকমা ও রুবেল ত্রিপুরা নিহত এবং আরও অনেকে আহত হন।

এই দুই হামলার প্রতিবাদে ২০ সেপ্টেম্বর  সংঘাত ও বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন রাঙামাটি শহরে মিছিল ও সমাবেশ আয়োজন করে। কিন্তু তাদের মিছিলটি বনরূপায় গেলে উগ্র মুসলিম সাম্প্রদায়িক সেটলাররা তাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। মসজিদ থেকে পাহাড়ি বিদ্বেষী শ্লোগান দিয়ে লোকজনকে উত্তেজিত করে হামলা চালানোর নির্দেশ দেয়া হয়। মুহুর্তের মধ্যে পূর্ব থেকে জড়ো হওয়া কয়েক হাজার সেটলার মিছিলকারী পাহাড়িদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। রাঙ্গামাটির এই নৃশংস হামলায় অনিক চাকমা নামে এক শিক্ষার্থী মারা যায়, অনেকে আহত হয় এবং পাহাড়িদের কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি ধ্বংস করে দেয়া হয়।

প্রশ্ন হলো, এসব হামলার নেপথ্যে কারণ কী? এর উত্তর খুবই সহজ। সংঘাত ও বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ি ছাত্রদের ক্রমবর্ধমান আন্দোলন দমনের জন্যই সেনা শাসকগোষ্ঠী উগ্র সাম্প্রদায়িক সেটলারদের মাঠে নামিয়ে এই হামলা সংঘটিত করেছে। ১৯৯০ দশকে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের ছাত্র গণ জোয়ার ঠেকাতেও সেনারা একই কৌশল প্রয়োগ করেছিল, কিন্তু সে সময় ছাত্রদের সুদৃঢ় নেতৃত্বের কারণে তারা সফল হতে পারেনি। তারা যতই দমন পীড়ন চালিয়েছে, ততই আন্দোলন বেগবান হয়েছে।

৯০ দশক ও ২৪-এর ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপট অনেকটা একই হলেও (৯০ দশকে এরশাদের এবং ২৪-এ হাসিনার পতনের পর আন্দোলন দুটি গড়ে উঠেছিল) তাদের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে।  সে সম্পর্কে এখানে আলোচনা করতে চাই না। তবে এখানে একটা কথা খুব জোর দিয়ে বলা দরকার যে, ২৪-এর আন্দোলনে সেনা-সেটলারদের চাইতেও সবচেয়ে বেশি ন্যাক্কারজনক ও বমিউদ্রেককারী ভূমিকা পালন করেছে জনসংহতি সমিতির সন্তু লারমা গ্রুপ। তারা প্রথমে ইনিয়ে বিনিয়ে ছাত্রদেরকে আন্দোলনে নিরুৎসাহিত করতে থাকে। কিন্তু তাতে কাজ না হলে সন্তু গ্রুপের নেতারা আন্দোলনের সমন্বয়কদের সরাসরি হুমকি দেয় – আন্দোলন করা যাবে না বলে জানিয়ে দেয়। এমনকি পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে হলেও।

আরও মজার ব্যাপার হলো: রাঙ্গামাটি হামলায় সন্তু লারমার আঞ্চলিক পরিষদের অফিসও আক্রান্ত হয়, গ্যারেজে রাখা ৯টি গাড়ি পুড়ে যায়। কিন্তু তারপরও আমাদের ”মহান বিপ্লবী নেতা” সন্তু বাবু কিংবা তার দল হামলার নিন্দা জানিয়ে একটি বাক্য পর্যন্ত খরচ করেনি। শুধু তাই নয়, সন্তু গ্রুপ হামলার জন্য উগ্র সাম্প্রদায়িক সেটলারদের দায়ি না করে সংঘাত ও বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের এবং ইউপিডিএফকে দায়ি করে। তার এই বিশ্বাসঘাতকতামূলক ভূমিকার কারণে সেনা-শাসকগোষ্ঠী মওকা পেয়ে যায় এবং বৈষম্য বিরোধী ছাত্র নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা ঝুলিয়ে দেয়। পরিণতিতে উত্থানশীল ছাত্র আন্দোলন শেষ হয়ে যায়।

পার্বত্য চট্টগ্রামের নাতিদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসে দেখা যায় সন্তু লারমা নিজে আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারলেও (আন্দোলন গড়ে তোলার ইচ্ছা তার কোন কালে ছিল বলে মনে হয় না), অন্যের হাতে গড়ে ওঠা আন্দোলন ধ্বংস করে দিতে কিন্তু তিনি খুবেই সিদ্ধহস্ত – এই সত্য বার বার প্রমাণিত হয়েছে। ১৯৮০ সালে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তার নিজ দলের নেতৃত্বে পরিচালিত সেটলার পুনর্বাসন বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রাম এবং ১৯৯০ দশকে প্রসিত খীসার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা প্রবল ছাত্র গণ আন্দোলন ১৯৯৫-৯৬ সালে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। তিনি বস্তুতঃ আন্দোলনের নামে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছেন এবং এখনও চালাচ্ছেন।

পাহাড়ের রাজনৈতিক ইতিহাস পাঠ আমাদেরকে আরও যে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয় তা হলো – ছাত্র আন্দোলন গড়ে ওঠার অনেক শর্তের মধ্যে একটি হলো তার নেতৃত্ব। ছাত্র সমাজের মধ্যে সুবিধাবাদী, আপোষকামী ও দোদুল্যমান ধারা প্রাধান্যে থাকলে কখনই ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠতে কিংবা বিকাশ লাভ করতে পারে না। অবশ্য এই কথা অন্যান্য আন্দোলনের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। সে কারণে ছাত্র সমাজের মধ্যে যারা মনে করেন অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন ছাড়া বিকল্প নেই, ভিক্ষা করে অধিকার পাওয়া যায় না, তাদেরকে অবশ্যই ছাত্র আন্দোলনে ঘাপতি মেরে বসে থাকা সুবিধাবাদী-আপোষকামী ধারার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে ও তাদেরকে মতাদর্শিকভাবে পরাস্ত করতে হবে।

২৪-এ সন্তু লারমা দলের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে পাহাড়ে ছাত্র আন্দোলন স্তিমিত হয়ে গেলেও, সেটা শেষ কথা নয়। আন্দোলন কখনই সোজা, সহজ ও সরল পথ ধরে চলে না। পার্বত্য চট্টগ্রামে লড়াকু জুম্ম ছাত্র সমাজ কখনই হার মানেনি। তারা বার বার জেগে উঠেছে এবং ভবিষ্যতেও আগ্নেয়গিরির মতো আরও প্রবল তেজে জেগে উঠবে। সেই আন্দোলনে বিশ্বাসঘাতক সন্তু লারমা ও তার দলও সেনা-শাসকগোষ্ঠীর সাথে খড়কুটোর মতো ভেসে যাবে। (সমাপ্ত)

[ লেখাটি সুনয়ন  চাকমা ফেসবুক থেকে সংগ্রহীত ]



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More