এম. এন. লারমার মৃত্যুর প্রেক্ষাপট সম্পর্কে

মন্তব্য প্রতিবেদন
জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক জাতীয় সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ১৯৮৩ সালের ১০ই নভেম্বর নিজ দলের ঘাতকের হাতে নিহত হন। কিন্তু কোন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তারই দলের সহযোদ্ধারা কেন্দ্রীয় সদর দপ্তর আক্রমণ করে তাকে খুন করেছিল তা আজ অবধি আলোচনা হয়নি। বর্তমানে জনসংহতি সমিতির উভয় গ্রুপ তার মৃত্যুবার্ষিকী পালন করলেও, এ বিষয়ে নীরবতা পালন করে থাকে। অথচ ১০ নভেম্বর ছিল জুম্মদের জাতীয় জীবনে একটি বাঁকবদলকারী ঘটনা, যা বোঝার জন্য এই প্রেক্ষাপট জানা আমাদের খুবই জরুরী।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবর রহমান সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হলে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা আত্মগোপনে চলে যান এবং সশস্ত্রভাবে আন্দোলন পরিচালনার দায়িত্ব নেন। এর মাস খানেক পর ২৫ সেপ্টেম্বর তার ভাই সন্তু লারমা ভারতীয় মুদ্রা ও কার্তুজসহ খাগড়াছড়ির কুকিছড়ায় গ্রেপ্তার হন। সে সময় তিনি ছিলেন শান্তিবাহিনীর ফিল্ড কমান্ডার।
তার অবর্তমানে শান্তিবাহিনী সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। এর প্রতিউত্তরে বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক সেনা সমাবেশ ও সেটলার পুনর্বাসন কার্যক্রম হাতে নেয়। শান্তিবাহিনীর যোদ্ধারা সরকারের এই সেটলার পুনর্বাসন কর্মসূচি প্রতিহত করতে দেবজ্যোতি চাকমা ওরফে দেবেনকে প্রধান করে একটি টাস্ক ফোর্স গঠেন করে এবং নতুন আসা সেটলারদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালাতে থাকে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের এই নাজুক পরিস্থিতি সামাল দিতে জিয়াউর রহমানের সরকার ১৯৮০ সালের ২২ জানুয়ারি সন্তু লারমাকে মুক্তি দেয়। প্রখ্যাত ভারতীয় সাংবাদিক সুবীর ভৌমিক তার মুক্তির বিষয়ে মন্তব্য করে বলেন, জিয়া সন্তু লারমাকে ছেড়ে দিয়ে “ভালোমতোই লাভবান হয়েছিলেন।”
মুক্তির আগে সন্তু লারমা হাতে লেখা ৪৩ পৃষ্ঠার একটি দলিল বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেন, যার একটি কপি তিনি ছাড়া পাওয়ার পর প্রীতি কুমারদের পড়তে দিয়েছিলেন। প্রীতিবাবুর ভাষ্য মতে, উক্ত দলিলে জেএসএসের অভ্যন্তরীণ অনেক গোপন তথ্য লেখা ছিল এবং সন্তু লারমা দলিলের উপসংহারে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব বলে মন্তব্য জুড়ে দিয়েছিলেন।
১৯৮১ সালের মে মাসের মাঝামাঝি সন্তু লারমা পুনরায় পার্টিতে যোগ দেন। এর কয়েকদিন পর এম. এন. লারমা বিশেষ কাজে ছুটিতে গেলে তিনি সন্তু লারমাকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দিয়ে যান। এই দায়িত্ব পাওয়ার সাথে সাথে তিনি দুটি পদক্ষেপ নেন: ১) সেটলারদের ওপর হামলা বন্ধ করার নির্দেশ প্রদান এবং ২) দেবজ্যোতি চাকমাকে প্রধান করে গঠিত টাস্ক ফোর্স ভেঙে দেয়া।
সরকারকে দেয়া সন্তু লারমার ৪৩-পৃষ্ঠার দলিল, সেটলার পুনর্বাসন প্রতিরোধ করার জন্য গঠিত টাস্ক ফোর্স কারো সাথে পরামর্শ না করে স্বৈরাচারী কায়দায় ভেঙে দেয়া – এসব বিষয়গুলো তখন পার্টিতে ব্যাপক সমালোচনা ও বিতর্ক সৃষ্টি করে।
এই প্রেক্ষাপটে ১৯৮২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে ১ অক্টোবর পানছড়ির কোন এক গোপন স্থানে জেএসএসের দ্বিতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এই কংগ্রেসে পার্টিতে দুটি ধারা স্পষ্ট হয়: একদিকে দুই লারমা ভ্রাতার নেতৃত্বে একটি ধারা, যারা “নীতিগতভাবে দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম ও কৌশলগত কারণে দ্রুত নিষ্পত্তির” লড়াইয়ের নীতিতে বিশ্বাসী; আর অন্যদিকে প্রীতি কুমার চাকমা ও ভবতোষ দেওয়ানের নেতৃত্বে তাদের অনুসারীরা। তারা চান ভারত সরকারের সহায়তায় দ্রুত নিষ্পত্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে ভারতের সাথে যুক্ত করা। এজন্য সাধারণ জনগণ প্রীতি-ভবতোষ গ্রুপকে “বাদি” এবং লারমা গ্রুপকে “লাম্বা” বলে আখ্যায়িত করে। কংগ্রেসে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের সময় ভোটাভুটিতে লারমাপন্থীরা হেরে যান। তবে ঐক্যের স্বার্থে উভয় গ্রুপ একমত হয়ে এম. এন. লারমাকে সভাপতি করে জোড়াতালি দিয়ে একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করে।
কংগ্রেসে লাইনগত বিষয়সহ অনেক বিষয় নিষ্পত্তি না হওয়ায় দুই গ্রুপের মধ্যে একে অপরের বিরুদ্ধে প্রচারণা ও অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ চলতে থাকে। ১৯৮৩ সালের প্রথম ভাগে পরিস্থিতি বিষ্ফোরন্মুখ হয়ে ওঠে। লারমাপন্থীরা আলোচনার মাধ্যমে এই পরিস্থিতি নিরসনের জন্য ভবতোষ দেওয়ানকে প্রস্তাব দেন এবং তিনি ১ জুন পার্টির হেডকোয়ার্টারে গেলে তাকে বন্দী করে রাখেন। এই আলোচনার প্রস্তাব ছিল লারমাদের একটি কূটচাল। ভবতোষ দেওয়ান ভারতীয় গোয়েন্দাদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন। লারমাদের তাকে কৌশলে বন্দী করার উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয়দের সাথে বাদি গ্রুপের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া।
ভবতোষকে বন্দী করার খবর ছড়িয়ে পড়লে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পায় এবং উভয়ে পরস্পরকে সামরিকভাবে মোকাবিলার জন্য শক্তি নিয়োজিত করতে থাকে। এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে ৪ জুন লারমা গ্রুপ তাদের অনুগত একটি কোম্পানিকে দিয়ে বিশেষ সেক্টরে থাকা অস্ত্র ভাণ্ডার দখল করে নেয়।
এই ঘটনার ১০ দিন পর ১৪ জুন লারমাপন্থীরা বিশেষ সেক্টর সদর দপ্তর আক্রমণ করে শান্তিবাহিনীর “অস্ত্রগুরু” খ্যাত সামরিক প্রশিক্ষক অমৃত লাল চাকমা ওরফে বলী ওস্তাদকে হত্যা করে। এই হামলা লাম্বা-বাদি গৃহযুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলে এবং বলা হয় ১৪ জুনের হামলা না হলে ১০ নভেম্বর হতো না। কারণ এই হামলার পর বাদি গ্রুপ প্রতিশোধ নেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।
১৪ জুনের হামলা প্রসঙ্গে জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় নেতা রূপায়ন দেওয়ান লেখেন, ‘এই অস্থায়ী ব্যারাকে এম এন লারমা ও সন্তু লারমার সঙ্গে আলোচনায় জানতে পারি যে, বিদ্রোহ দমনের জন্য বিদ্রোহীদের (অর্থাৎ প্রীতি গ্রুপ – লেখক) গোলকপুদিমার ঘাঁটি আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত এর মধ্যে নেয়া হয়েছে এবং সেই জন্যই আলোচনার জন্য আমাকে ডাকা হয়েছে। আমাকে বলা হয় এই আক্রমণে আমাকে নেতৃত্ব দিতে হবে, যা শারীরিক অসুস্থতার কারণে সম্ভব হয়নি।’ তবে শেষে উষাতন তালুকদার এই হামলায় নেতৃত্ব দেন। এ সময় তারা মর্টার, রকেট, গ্রেনেড, এলএমজি ও অন্যান্য অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। লারমা পক্ষ দাবি করে ১৪ জুনের হামলার মাধ্যমে বিদ্রোহীদের অর্থাৎ প্রীতিগ্রুপের প্রণীত কেন্দ্র আক্রমণের পরিকল্পনা বানচাল করে দেয়া হয়। তাদের অভিযোগ বিশেষ সেক্টরের কমান্ডার ত্রিভঙ্গিল দেওয়ান এই পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছিলেন।
প্রীতি কুমার চাকমার ভাষ্য মতে, লারমাপন্থীদের ১৪ জুনের হামলার আগে ১১ জুন পানছড়ির লোগাং নদীর তীরে মাইছ্যা চাকমা (সিদোল্যা) গ্রামের এক ব্যক্তির বাড়িতে দুই পক্ষের মধ্যে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এখানে ঠিক হয় যে পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হয়ে এলে প্রীতিবাবুরা বাত্তিতে অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সদর দপ্তরে যাবেন। কিন্তু ১৪ জুনের পর পরিস্থিতি আর স্বাভাবিক হয়নি, ফলে প্রীতি বাবুরাও আর ‘বাত্তিতে’ যাননি।
যাই হোক, ১৪ জুনের হামলার পরও তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতায় লারমা গ্রুপ ও প্রীতি গ্রুপের মধ্যে দুই বার বৈঠক হয়। শেষ বারের কেন্দ্রীয় উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ১ অক্টোবর ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায়। তিন দিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন এম. এন. লারমা। সেখানে আলোচনার পর একে অপরের ওপর হামলা-অপপ্রচার বন্ধ ও প্রতিপক্ষের হাতে বন্দী সদস্যদের মুক্তিসহ উভয় পক্ষের মধ্যে ১৩ দফা সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু এই সমঝোতার এক মাস ১০ দিন পর প্রীতি গ্রুপ লাম্বা গ্রুপের সদর দপ্তরে এক কমান্ডো হামলা চালিয়ে এম. এন. লারমা ও তার আট সহযোগীকে হত্যা করে।
আগরতলা সমঝোতার পরও কেন প্রীতি গ্রুপ নতুন করে লাম্বা গ্রুপের ওপর হামলা চালিয়েছিল, তার কোন সঠিক ব্যাখ্যা যেমন আজও মেলেনি, তেমনি লারমাপন্থীরা কেন ১৪ জুন বিশেষ সেক্টর আক্রমণ করে বলী ওস্তাদকে হত্যা করেছিল, কেন ৪ জুন বিশেষ সেক্টরে অভিযান চালিয়ে গোলাবারুদ দখল করে নিয়েছিল, কেন ভবতোষ দেওয়ানকে আলোচনার জন্য ডেকে হেডকোয়ার্টারে বন্দী করে রাখা হয়েছিল এবং এতে এম. এন. লারমার সম্মতি বা নির্দেশ ছিল কী না, তারও কোন সদুত্তর পাওয়া যায়নি।
এছাড়াও লারমার বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ ছিল প্রীতি গ্রুপের। প্রীতি কুমার চাকমার ভাষ্য মতে, সরকারকে দেয়া সন্তু লারমার ৪৩-পৃষ্ঠার দলিল সম্পর্কে জেনে এম. এন. লারমা তার ওপর অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু যখনই তারা দুই ভাই একান্তে আলাপ আলোচনা করেন, তার পর থেকেই এম. এন. লারমা সে প্রসঙ্গটি একেবারে চেপে যান এবং সন্তু লারমার পক্ষ নেন। এই বিষয়েও যথেষ্ট অনুসন্ধানের প্রয়োজন রয়েছে।
উপসংহারে বলা যায়, এম. এন. লারমার মৃত্যুর জন্য প্রীতি গ্রুপ প্রত্যক্ষভাবে দায়ি হলেও, তার প্রেক্ষাপট তৈরির ক্ষেত্রে লারমা প্রুপের শীর্ষ নেতাদের অগণতান্ত্রিক-ফ্যাসিস্ট মানসিকতা ও আচরণ যে বহুলাংশে ভূমিকা রেখেছে তাও অবশ্যই অস্বীকার করা যাবে না। আন্দোলনে পার্টিগত ও রাজনৈতিক সমস্যাগুলো গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে মীমাংসা করা না হলে সেগুলো অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অর্থাৎ সামরিকভাবে সমাধানের চেষ্টা অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। তাই চূড়ান্ত বিচারে এম. এন. লারমার মৃত্যু জেএসএস-এর অভ্যন্তরে সমস্যাগুলো গণতান্ত্রিকভাবে মীমাংসা করতে না পারারই ফল।
(১১ নভেম্বর ২০২৫)
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।
