কল্পনা চাকমার চিহ্নিত অপহরণকারীদের সাজার দাবিতে কাউখালীতে নারী সমাবেশ

0


কাউখালী প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
বৃহস্পতিবার, ১২ জুন ২০২৫

কল্পনা চাকমার চিহ্নিত অপহরণকারী লে. ফেরদৌস গংদের সাজার দাবিতে রাঙামাটির কাউখালীতে প্রতিবাদী নারী সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেছে হিল উইমেন্স ফেডারেশন (এইচডব্লিউএফ)।

আজ বৃহস্পতিবার (১২ জুন ২০২৫) সকাল সাড়ে ১০টায় কাউখালী উপজেলঅ সদরে এ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। এতে বিভিন্ন এলাকা থেকে অন্তত দুই সহস্রাধিক নারী অংশগ্রহণ করেন।

সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের একাংশ।

সমাবেশের ব্যানার শ্লোগান ছিল “সারাদেশে নারীর ওপর চলমান বর্বরতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোল, নারী নিরাপত্তার প্রধান হুমকি সেনা-সেটলারদের পাহাড় থেকে সরিয়ে নাও”।

সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি নীতি চাকমা ও সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক রিতা চাকমা।

সমাবেশে সংহতি জানিয়ে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি নূজিয়া হাসিন রাশা, লেখক, অ্যাক্টিভিস্ট ও ইউল্যাব-এর শিক্ষক অলিউর সান, নারী অধিকার কর্মী ও অ্যাক্টিভিস্ট মার্জিয়া প্রভা, পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক পরিণীতা চাকমা, ছাত্র-জনতার সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ও জনপ্রতিনিধি উষাতন চাকমা, ইউপিডিএফের প্রতিনিধি নিকন চাকমা ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সহসাধারণ সম্পাদক সোহেল চাকমা।

সমাবেশে ছাত্র নেতা সোহেল চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে ১২ জুন ঘনিয়ে আসলে কল্পনা চাকমার আর্তচিৎকার পাহাড়ের প্রতিটি কোণে প্রতিধ্বনিত হয়। এই সময় সেনা-সেটলারদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

তিনি উল্লেখ করেন, ১৯৯৬ সালের ১২ জুন, জাতীয় নির্বাচনের মাত্র ৭ ঘণ্টা আগে কল্পনা চাকমাকে নিজ বাড়ি থেকে অপহরণ করা হয়। তার ভাইদেরও অপহরণের চেষ্টা হয়, যদিও তারা কোনোমতে প্রাণে বেঁচে যান।


তিনি আরো বলেন, কল্পনার অপহরণ শুধু একটি ব্যক্তিগত ঘটনা নয়, বরং এটি পাহাড়ে চলমান নারী ধর্ষণ, নিপীড়ন, খুন, গুম ও ধর্মান্তকরণসহ জাতিগত নিপীড়নের ধারাবাহিক চিত্র। এখনও লে. ফেরদৌস ও তার সহযোগীরা আইনের বাইরে রয়েছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, পাহাড়ি নারীরা থেমে নেই। কল্পনার সংগ্রামী চেতনা আজ আরও দ্বিগুণ শক্তিতে নারীদের আন্দোলনে প্রাণ জুগিয়েছে।

তিনি ইতিহাস তুলে ধরে বলেন, ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম ম্যানুয়াল অনুযায়ী পাহাড়িদের প্রথাগত ভূমি-অধিকার ছিল, যা পরবর্তীতে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। ১৯৮৩ সাল থেকে চার লক্ষাধিক বাঙালি সেটলার আনার মাধ্যমে শুরু হয় গণহত্যা ও পাহাড়িদের উচ্ছেদ করে দেয়া।

তিনি কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলা খারিজের তীব্র সমালোচনা করে বলেন, এই অন্যায় রায় পাহাড়িরা কখনও মানেনি, মানবেও না। নারী অধিকার, নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচারের একমাত্র সমাধান পূর্ণস্বায়ত্তশাসন।

তিনি আরও বলেন, চিংমা খেয়াংয়ের ধর্ষণ থেকে শুরু করে বম জনগণের উপর নিপীড়ন কোনো ঘটনারই বিচার হয়নি। লালত্লেং বমসহ দুইজনকে কারাগারে হত্যার দায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান ড. ইউনুস এড়াতে পারেন না। পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ বিশ্বাস করে, পূর্ণস্বায়ত্তশাসনই পাহাড়ি জাতিসত্তার মুক্তির একমাত্র পথ এবং এই লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি নুজিয়া হাসিন রাশা বলেন, কল্পনা চাকমা অপহৃত হওয়ার ২৯ বছর পেরিয়ে গেলেও প্রশ্নগুলো আজও একই রয়েছে, তিনি কোথায়? তিনি বেঁচে আছেন কি? তিনি আমাদের কাছে আর কখনো ফিরবেন কি না? এ প্রশ্নের উত্তর দেয়নি কোনো সরকার, কোনো রাষ্ট্র!

সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের একাংশ।

আমরা রাষ্ট্রকে বলতে চাই—আপনারা কল্পনাদের গুম করবেন, আমাদের পক্ষে কথা বলা মানুষদের খুন করবেন, ভয় দেখিয়ে দমন করতে চাইবেন কিন্তু আমরা থেমে যাইনি, যাবোও না!

আপনারা ভয় পান কল্পনা চাকমার আদর্শকে, কারণ তিনি ছিলেন এমন এক কণ্ঠস্বর, যিনি পাহাড় থেকে পাহাড়ে ঘুরে নারীদের সংগঠিত করেছেন মুক্তির সংগ্রামে।

কল্পনা লিখেছিলেন, “যদি পাখি বুঝতে পারে তাকে খাঁচায় বন্দি করা হয়েছে, তখন তার মনে ক্ষোভ জন্মায়, সে মুক্ত আকাশের স্বপ্ন দেখে।” কল্পনার সংগ্রাম ছিল সেই খাঁচা ভেঙে নিজের অধিকার ফিরে পাওয়ার লড়াই।

তিনি আরো বলেন, এ পর্যন্ত যতগুলো সরকারের রদবদল হয়েছে তারা শাসকদের সাথেই একাত্ম হয়েছে। কল্পনা বিশ্বাস করতেন—নারীর মুক্তির আন্দোলন, ভুমি রক্ষা এবং স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রাম এগুলো একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ২৯ বছরেও রাষ্ট্র কল্পনার অপহরণকারীদের অপরাধী মনে করে না। আজও পাহাড়ে নারীদের ওপর সেনা-সেটলারদের দ্বারা ধর্ষণ, নিপীড়নের ঘটনা ঘটে।

কল্পনা চাকমা আমাদের কাছে একজন প্রতীক নারী স্বাধীনতার, সংগ্রামের, সাহসের। পাহাড়ের প্রতিটি নারী আজ তাকে অনুপ্রেরণা মনে করে, এবং সেই আদর্শকে বুকে ধরে সামনে এগিয়ে চলছে বলে তিনি মন্তব্য করে।

সেনা-সেটলাররা বারবার বাধা দিলেও এই সংগ্রাম থেমে থাকবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আদিবাসী’ নারীদের মুক্তির লড়াই আর স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রাম—একই সূত্রে গাঁথা এবং তা অব্যাহত থাকবে।

আমরা দেখেছি, গণঅভ্যুত্থানের সময় সমতলের পাশে পাহাড়ের ভাই-বোনেরা একসাথে দাঁড়িয়েছিল। ভেবেছিল এবার বোধহয় সবাই একসাথে গনতান্ত্রিক পথে এগোবে। কিন্তু না, আজও রাষ্ট্র তাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকই মনে করে।

নূজিয়া হাসিন রাশা আরো বলেন, আপনারা কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করতে পেরেছেন, কিন্তু তার চেতনা, তার বিশ্বাসকে গুম করতে পারেননি। সেটা করতে হলে আপনাদের হাজার হাজার মানুষকে খুন করতে হবে, গুম করতে হবে। কারণ এই ২৯ বছরে হাজার কল্পনা চাকমার জন্ম হয়েছে। এই রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে পাহাড় ও সমতলের মানুষকে এক কাতারে দাঁড়াতে হবে। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ছাড়া মুক্তি সম্ভব নয়।

অলিউর সান বলেন, পাহাড়ে দীর্ঘ বহু বছর ধরে জাতিগত নিপীড়ন জারি রাখা হয়েছে। কল্পনা চাকমা এটি উপলব্ধি করতে পেরেছে বলে তার প্রতিবাদের আগুনকে নিভিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু সে আগুন নিশ্চয়ই নিভিয়ে যায়নি, কারণ পাহাড়ে কল্পনার চেতনায়, তার মনের প্রতিবাদের তীব্রতা আগুনকে আমরা পাহাড় সমতলে মনে ধারণ করে জিইয়ে রেখেছি।

তিনি আরো বলেন, সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মদদে বহিরাগত সেটলারদের ব্যবহার করে পাহাড়ের ভূমি বেদখল করা, জাতির অস্তিত্ব মুছে দিতে মরিয়া রয়েছে। বান্দরবানের বম জাতিসত্তাদের সন্ত্রাসী নামে নারী-শিশুদের গণ গ্রেফতার তারই উদাহরণ আমরা দেখতে পাই।

কল্পনা চাকমা অপহরণের ঘটনা যখন ঘটেছিল, তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় দলীয় সরকার বিদ্যমান ছিল না। তত্তাবধায়ক সরকারের আমলে নির্বাচনের আগে কল্পনা চাকমাকে রাতে অপহরণ করা হয়েছে। সেদিক থেকে স্পষ্ট, রাষ্ট্রের ক্ষমতায় যে আসুক না কেন, সেটি কোন দলীয় কিংবা তত্তাবধায়ক-অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশ রাষ্ট্র পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দিয়ে রেখেছে।

পাহাড়ে অপারেশন উত্তোরণ নামে এখনও সেনা মহড়া, ক্যাম্প স্থাপন, অস্ত্র দিয়ে ভয়ভীতি- হুমকি, মিথ্যা মামলা,হত্যা নিত্যদিনের ঘটনা বলে তিনি মন্তব্য করেন।

তিনি আরও বলেন, পৃথিবীতে কোন জায়গায় নিপীড়নের মাত্রাকে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব হয়নি, তারই উদাহরণ দেশের গণ-অভ্যুত্থানের ফ্যাসিস্ট হাসিনা পতন। যারা আজকে মনে করছে সন্ত্রাস দমনের নামে, পর্যটনের নামে পাহাড়িদের ন্যায্য অধিকারকে কেড়ে নিয়ে দমিয়ে রাখবে, তারা বোকার স্বর্গের বাস করছেন।

তিনি বলেন, পাহাড়ে কল্পনা নেই, কিন্তু আজকে নারী সমাবেশে হাজারও কল্পনা দেখছি। এই বন্ধুরা ভবিষ্যতে কল্পনা চাকমার থেকে আরও বড় সংগ্রামী হবে এ আশা ব্যক্ত করছি। আমাদের সংগ্রামকে দীর্ঘ সংগ্রামে সুতিকাগার হিসেবে বিবেচনা করবো এবং পাহাড়ে সকলকে সেই সংগ্রামের ধারায় প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান।

তিনি বলেন পাহাড় থেকে সেনাশাসন অবিলম্বে তুলে নিতে হবে। পূর্ণস্বায়ত্তশাসন ছাড়া পাহাড়ে কোন আলাপ- আলোচনা সম্ভব নয় বলেও তিন মত প্রকাশ করেন।

উষাতন চাকমা বলেন, ’৯৬ সালে কল্পনা চাকমা অপহরণের মধ্যে দিয়ে পাহাড় ও সমতল নারী নিরাপত্তার হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কল্পনা চাকমা মামলার প্রক্রিয়াসহ, নারীদের নির্যাতনের ঘটনার বিচারহীনতার প্রবণতা আমরা দেখতে পাই। কল্পনা চাকমা’র চিহ্নিত অপহরণকারীদের সাজার দাবিতে আজকের নারী সমাবেশে অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে আহ্বান- সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে মামলার বিচার, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।

তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে আমরা প্রতিনিয়ত সেনাশাসন, সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি। কারণ পাহাড়ে এতই সেনা ছাউনি, নিরাপত্তা বেস্টনির ভিতরেও প্রতিনিয়ত আমার মা-বোন, আামার বাবা-ভাইকে নির্যাতন, খুন-গুমের শিকার হতে হয়। ষড়যন্ত্র করে আমার নিজ মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত করা হয়। এসবের জন্য সরকার, সেনা-গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দায়ি বলে তিনি মন্তব্য করেন।

উষাতন চাকমা বলেন, পাহাড়ে শান্তির নাম দিয়ে প্রতিদিন পাহাড়ে মানুষগুলোকে তাদের ন্যায্যতার অধিকার দাবিকে দেশ বিভাজনের আখ্যা দিয়ে আন্দোলন দমিয়ে রাখার চেষ্টায় মরিয়া পাহাড়ের  সেনাশাসন। আজকে ২৯ বছরেও  কল্পনা চাকমার অপহরণের সন্ধান দিতে না পারার কারণে পাহাড়-সমতলে নারীদের নিরাপত্তার হুমকি বলে মন্তব্য করেন তিনি।

পক্ষে বক্তব্য রাখছেন অ্যাক্টিভিস্ট মার্জিয়া প্রভা। 

মার্জিয়া প্রভা বলেন, “কল্পনা চাকমা কোথায়?”—এই প্রশ্নের উত্তর আমরা ২৯ বছর ধরে খুঁজে চলেছি। পাহাড়ে, সমতলে, দেশে-বিদেশে উচ্চারিত হয়েছে এই প্রশ্ন, কিন্তু কোনো জবাব আসেনি।

আমি যতবার পার্বত্য চট্টগ্রামে যাই, একধরনের অপরাধবোধ, লজ্জা আর ক্ষোভ আমাকে ঘিরে ধরে। কারণ আমার পরিচয়, আমার পোশাক—সবই বাঙালি জাতিকে প্রতিনিধিত্ব করে, সেই জাতিগোষ্ঠীকে, যারা সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে পাহাড়িদের দমন-নিপীড়নে জড়িত।

তিনি আরো বলেন, গণঅভ্যুত্থানের সময় আমরা দেখেছি, পাঠ্যপুস্তকের ‘আদিবাসী’ পাতাটি ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল। সেই প্রতিবাদে পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামলে তাদের পেটানো হয় প্রকাশ্যেই, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে। শুধু রাষ্ট্রীয় বাহিনী নয় ‘স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি’র মতো গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমেও নিপীড়ন চালানো হয় যারা এই বাঙালি জাতিকেই প্রতিনিধিত্ব করে।

তিনি বলেন, পাহাড় নিয়ে রাষ্ট্রের একটা সুস্পষ্ট পরিকল্পনা রয়েছে—সেটি হলো পাহাড়িদের প্রান্তিক করে দিয়ে সেখানে বাঙালিদের বসতি গড়া। যখন পাহাড়িরা স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলে, তখনই তাদের বলা হয় ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’। অথচ স্বায়ত্তশাসন কি এ রাষ্ট্রে নতুন কিছু? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো বহু প্রতিষ্ঠান তো স্বায়ত্তশাসিত। তাদের কেন ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ বলা হয় না?

মার্জিয়া প্রভা আরো বলেন, নববর্ষে আমরা একটি পোস্টার হাতে দাঁড়িয়েছিলাম: “পাহাড় থেকে সেনাশাসন প্রত্যাহার করো” প্ল্যাকার্ড নিয়ে। এরপর শুরু হয় অনলাইন হেনস্তা, আক্রমণ। বলা হলো, পাহাড়ে সেনাবাহিনী রয়েছে ‘সন্ত্রাসী দমনে’। অথচ রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন সন্ত্রাস হচ্ছে—সেখানে সেনাবাহিনী লাগে না। আর এই বৈষম্যকে সমর্থন দেয় আমার জাতিগোষ্ঠী, বাঙালিরা।

তিনি বলেন, যখন আমরা “কল্পনা চাকমা কোথায়?” প্রশ্ন করি, তখন সামনে আসে দুটি সত্য—একটি রাষ্ট্রের পরিকল্পিত নিপীড়ন, আরেকটি পার্বত্য চুক্তির দ্বিচারিতা”।

১৯৯৬ সালে কল্পনা অপহৃত হন, ১৯৯৭ সালে হয় পার্বত্য চুক্তি। একই বাহিনী দিয়ে একদিকে তাকে অপহরণ করে, আরেকদিকে ‘চুক্তি’র আহ্বান জানায়। এটা প্রতারণা নয় তো কী?

আমরা সবাই জানি, কল্পনা অপহরণের সত্য উদঘাটন করা মোটেই অসম্ভব কিছু নয়। রাষ্ট্রের হাতে আছে সামরিক শক্তি, প্রযুক্তি, গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক—তারপরও লেফটেন্যান্ট ফেরদৌসকে ‘খুঁজে পাওয়া যায় না’। এর মানে তারা খুঁজতেই চায় না।

১৯৯৬ সালে তদন্তকারী ড. ইউনুস কল্পনার ঘটনাকে বলেছিলেন “হৃদয়ঘটিত ব্যাপার”! প্রশ্ন হলো—তিনি কি এখনো তাই মনে করেন?

কল্পনা চাকমা তার ডায়েরিতে নারীকে শুধুই সন্তান জন্মদানের যন্ত্র নয়, বরং সচেতন, স্বাধীন, আত্মনিয়ন্ত্রণক্ষম ব্যক্তি হিসেবে দেখার কথা বলেছেন। তাঁর চিন্তা আজও প্রাসঙ্গিক। এই আদর্শই ছিল তাঁর অপহরণের প্রধান কারণ।

সমতলে ধর্ষণের বিচার কখনো কখনো দেরিতে হলেও হয় কিন্তু পাহাড়ে হয় না কারণ, সেখানে ধর্ষণকে দেখা হয় জাতিগত অস্ত্র হিসেবে। সেনা-সেটলাররা পরিকল্পিতভাবে ধর্ষণকে ব্যবহার করে ভয় দেখাতে, দমন করতে।

তিনি আরো বলেন, ২৯ বছর ধরে তদন্তে ৩৯ জন সাক্ষী নিয়েও রিপোর্টে লেফটেন্যান্ট ফেরদৌসের নাম নেই। সব রিপোর্ট একই রকম—এটা প্রমাণ করে, রাষ্ট্র ও শাসকগোষ্ঠী কী বলতে চাইছে। আমরা বুঝে গেছি—এই রাষ্ট্র কোনোদিনই কল্পনাদের মুক্তি দেবে না। তাই এখন প্রয়োজন কল্পনা চাকমার আদর্শকে ধারণ করে নতুন নেতৃত্ব গড়ে তোলা। তাঁর চেতনার আলোকে আন্দোলন সংগঠিত করতে হবে—পাহাড়ে, সমতলে, সর্বত্র।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের নেত্রী পরিণীতা চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে নারী-শিশু, বৃদ্ধ-বণিতাসহ নিপীড়ন নির্যাতনের শিকার। নারী নেত্রী কল্পনা চাকমাকে যারা অপহরণ করা হয়েছে, আজ ২৯ বছর হলেও তার হদিস দিতে ব্যর্থ এ রাষ্ট্র এবং দোষীদের বিচারের তো দূরের কথা, মামলার শুনানি খারিজ করে দেয়া হয়েছে। তিনি ধর্ষণের বিরুদ্ধে উপস্থিত নারী সমাবেশকে একতাবদ্ধ হয়ে লড়াই সংগ্রামের থাকার আহ্বান জানান।


নিকন চাকমা বলেন, ইউপিডিএফ ও তার সহযোগী সংগঠনসমূহ বরাবরের মতই পাহাড় এবং সমতলের নিপীড়নের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে আসছে। পাহাড় এবং সমতলের আপামর জনতা ফ্যাসিস্ট হাসিনা পতন ঘটিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামবাসী জাতীয় নির্বাচনের ইতিহাসে ২৭টি ভোটকেন্দ্র শুন্য রেখে দিয়েছে। হাসিনা আমলে পাহাড়ি জনগণ কতটা নিপীড়িত ছিল সেটা ভোটকেন্দ্র শুন্য রাখার মধ্যে তারা দেখিয়ে দিয়েছে।

তিনি আরো বলেন, আমরা জানি পার্বত্য চট্টগ্রামে যে অঘোষিত সেনা শাসন জারি রাখা রয়েছে। ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলে ২০১৫ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ১১ দফা নির্দেশনা জারি করার মধ্যে দিয়ে সেনাশাসনকে আরো বৃদ্ধি করা হয়েছে। যার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে আন্দোলনের লড়াকু সংগঠনের অনেক নেতা কর্মীকে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে, বিনা বিচারে জেল হাজতে রাখা হয়েছে।

তিনি বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে অধিকারের কথা বলতে পারবো ভাবলেও তা হয়নি। তারা পাহাড়িদেরকে অপবাদ দিয়ে বলতে চায়, পাহাড়িরা নাকি বিচ্ছিন্ন হতে চায়। কিন্তু এ রাষ্ট্রই বারংবার আমাদের বিচ্ছিন্ন রাখতে চায়। অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনৈ ঐক্যমত কমিশনের সাথে প্রথম দফায় ইউপিডিএফ বসতে পারলেও দ্বিতীয় দফায় তা বাতিল করা হয়। এখান থেকে বোঝা যায় কারা আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন রাখতে চাইছে। তার আরো একটি উদাহরন হলো- বান্দরবানে কেনএফ দমনের নামে বম জনগোষ্ঠীর নারী শিশুদের আটকে রেখে বিনা চিকিৎসায় হত্যা করা হচ্ছে।

সমাবেশে বক্তব্য প্রদান শেষে প্রতিরোধ সাংস্কৃতিক স্কোয়াড প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এতে প্রতিবাদী নাটিকা ও নৃত্যনাট্য পরিবেশন করা হয়।



অতিথি বক্তাদের ওপর হামলা, নিন্দা ও প্রতিবাদ

সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষে বিকাল ৪টার দিকে ঢাকায় ফেরার উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামে যাওয়ার পথে কাউখালী উপজেলাধীন বেতছড়ি নামক স্থানে সেটলার বাঙালিদের একটি দল পথরোধ করে সিএনজি থামিয়ে অতিথি বক্তা অলিউর সান, নূজিয়া হাসিন রাশা ও মার্জিয়া প্রভা’র ওপর হামলা ও হেনস্তা করে। এতে শিক্ষক অলিউর সান চোখে আঘাত পান।   

এ হামলার ঘটনায় হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘ তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে অবিলম্বে হামলায় জড়িতদের গ্রেফতার ও শাস্তির দাবি জানিয়েছে।

বিবৃতিতে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভাপতি নীতি চাকমা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের সভাপতি কণিকা দেওয়ান উক্ত হামলাকে অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক অভিহিত করে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে যে এখনো পতিত ফ্যাসিস্ট হাসিনার দোসরদের রাজত্ব ও অপশাসন চলছে এই ঘটনা তারই জ্বলন্ত প্রমাণ।

যতদিন পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা দখলদারিত্ব ও সেটলার উপনিবেশ থাকবে ততদিন সেখানে শান্তি আসবে না, পাহাড়ি নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না এবং সেই সাথে দেশেও প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসন কায়েম হবে না” বলে তারা মন্তব্য করেন।

বিবৃতিতে তারা অবিলম্বে হামলাকারীদের গ্রেফতার ও শাস্তি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাবাহিনী ও সেটলারদের প্রত্যাহারের দাবি জানান।

এর আগে সকালে পূর্ব নির্ধারিত নারী সমাবশেকে কেন্দ্র করে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে যৌথবাহিনীর ৪০-৫০ জনের একটি দল রাঙ্গী পাড়া, পানছড়ি, ডেবাছড়িসহ বিভিন্ন জায়গায় টহল দেয়।

অপরদিকে, সেটলার বাঙালিরা কাউখালী উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গন এলাকায় লাঠিসোটা নিয়ে মিছিল ও অবস্থান করে উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা চালায়।



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More