কল্পনা চাকমা অপহরণ : বিচারহীন ২৮ বছর, অপরাধীদের দায়মুক্তি!

সিএইচটি নিউজ ডেস্ক
বুধবার, ১২ জুন ২০২৪
১৯৯৬ থেকে ২০২৪। দীর্ঘ আটাশ বছর। এই সময়ের মধ্যে দেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বহু পালাবদল ঘটেছে। কিন্তু হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী কল্পনা চাকমা অপহরণের বিচার হয়নি। গ্রেফতার ও বিচারের আওতায় আনা হয়নি চিহ্নিত অপহরণকারী লে. ফেরদৌস গংদের। কল্পনার চাকমারও কোন সন্ধান মিলেনি। উপরন্তু এ অপহরণ ঘটনায় জড়িতদের দায়মুক্তি দিয়ে গত ২৩ এপ্রিল ২০২৪ রাঙামাটি জেলা চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাটিও খারিজ করে দিয়েছেন।
হিল উইমেন্স ফেডারেশনের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমা অপহৃত হন ১৯৯৬ সালের ১১ ও ১২ জুনের মধ্যবর্তী রাত রাত ১:০০টার সময় (আন্তর্জাতিক সময়মান ১২ জুন) রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার নিউ লাল্যাঘোনা গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে। সেনাবাহিনীর তৎকালীন কজইছড়ি ক্যাম্প কমান্ডার লে. ফেরদৌস, ভিডিপির নুরুল হক ও সালেহ আহম্মদ-এর নেতৃত্বে অপহৃত হয়েছিলেন কল্পনা চাকমা। দীর্ঘ আটাশ বছরেও রাষ্ট্র তাঁর সন্ধান ও চিহ্নিত অপহরণকারীদের আইনের আওতায় এনে বিচার ও সাজা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
দেশের ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ৭ ঘন্টা পূর্বে সংঘটিত এ অপহরণ ঘটনাটি পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোচিত হয় এবং প্রতিবাদ-বিক্ষোভের ঝড় তোলে। হিল উইমেন্স ফেডারেশনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, প্রগতিশীল ব্যক্তি ও নাগরিক সমাজ বিচার বিভাগীয় তদন্তপূর্বক এ ঘটনার বিচারের দাবি জানায়।

ব্যাপক প্রতিবাদ-বিক্ষোভের মুখে ঘটনার প্রায় দেড় মাসের পর সরকার অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আব্দুল জলিলের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কিন্তু ওই তদন্ত কমিটি সরকারের নিকট প্রতিবেদন জমা দিলেও তা আজো জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি।
কল্পনা চাকমা অপহরণের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন তাঁর দুই ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা ও লাল বিহারী চাকমা। অপহরণকারীরা কল্পনা চাকমার সাথে তাঁদের দুই ভাইকেও বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। ভাগ্যিস তারা পথিমধ্য থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন।
সেদিনের ঘটনা বর্ণনা দিতে গিয়ে কালিন্দী কুমার চাকমা বলেন, “সেদিন দিবাগত রাত ১:০০টা/১:৩০টার মধ্যে একদল আর্মি এসে বাড়িটি ঘেরাও করে। তারা বাড়িতে বাইরে কেও আছে কিনা, শান্তিবাহিনী আছে কিনা জানতে চাই। পরে আর্মিরা ঘরের দরজা খুলে ফেলে বাড়ির লোকজনকে বাইরে বের হতে বলে। বাড়ির সকলের নাম জিজ্ঞাসা করে। প্রথমে তারা তাঁর ছোট ভাই লাল বিহারীকে ধরে নিয়ে যায়। পরে তাঁকে ও তার বোন কল্পনা চাকমাকে ধরে নিয়ে যায়। তাদেরকে কুয়াঘাটে নিয়ে গেলে সেখানে তিনি ছোট ভাই লাল বিহারীকে চোখ বাঁধা অবস্থায় দেখতে পান। সেখানে নেয়ার পর তাঁকেও চোখ বেধে দেয় আর্মিরা। পরে দুই ভাইকে আলাদা করে ফেলা হয়। কল্পনা চাকমা তখন পর্যন্ত তাঁর সাথে ছিল। এমতাবস্থায় তিনি একটি গুলির শব্দ শুনতে পেয়ে তাঁর ভাইকে গুলি করা হয়েছে বলে সন্দেহ হয়। এতে ভয়ে পেয়ে তিনি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে তিনি পানিতে ঝাঁপ দিয়ে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। এ সময় তিনি আরেকটি গুলির শব্দ শুনেন বলে জানান। তবে পানিতে ঝাঁপ দেয়ার কারণে তিনি কোন রকমে প্রাণে বেঁচে যান’। এ সময় তিনি একটি টিলার উপর থেকে শুধুমাত্র কল্পনা চাকমার ‘দাদা, দাদা’ চিৎকার শুনতে পেয়েছিলেন বলে জানান।
এরপর তিনি গ্রামে এসে গ্রামবাসীদের ঘটনাটি জানালে গ্রামবাসীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে গুলি বহনকারী একটি ব্যাগ, চোখ বেঁধে দেওয়া গামছা ও লাল বিহারী চাকমার লুঙ্গি খুজে পান এবং পরদিন সকালে তাঁর ভাই লাল বিহারী চাকমাও বাড়িতে ফিরে আসেন বলে তিনি জানান। তবে কল্পনা চাকমার আর ফিরে আসেননি। এরপর থেকে কল্পনা চাকমার আর কোন হদিস তারা পাননি।”
অপহরণ ঘটনার পরবর্তী সময়ে কালিন্দী কুমার চাকমা চিহ্নিত অপহরণকারী কজইছড়ি আর্মি ক্যাাম্পের লে. ফেরদৌস এবং ভিডিপি সদস্য নুরুল হক ও সালেহ আহমেদকে আসামি করে বাঘাইছড়ি থানায় মামলা দায়ের করেন। কিন্তু থানা কর্তৃপক্ষ পরিকল্পিতভাবে অভিযুক্তদের নাম বাদ দিয়ে মামলা রুজু করে।

মামলা করার প্রায় সাড়ে চৌদ্দ বছর পর ২১ মে ২০১০ তারিখে বাঘাইছড়ি থানার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই ফারুক প্রথম চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।
পরে মামলার বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা এ প্রতিবেদনের ওপর নারাজী দিলে বিজ্ঞ আদালত ০২/০৯/২০১০ তারিখে মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দেন। এরপর সিআইডি’র তদন্ত কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ দুইবছর তদন্ত করে চিহ্নিত অপহরণকারীদের নাম বাদ দিয়ে ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১২ তার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।
সিআইডি’র তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর বাদী নারাজী দিলে বিজ্ঞ আদালত ১৬ জানুয়ারি ২০১৩ আরও অধিকতর তদন্তের জন্য রাঙামাটি পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দেন। এরপর ২০১৪ সালের ২০ জুলাই পুলিশ সুপার আমেনা বেগম তদন্ত অগ্রগতির প্রতিবেদন দাখিল করে বলেন যে “বিজ্ঞ আদালতের নির্দেশ মতে লেঃ ফেরদৌস এবং ভিডিপি সদস্য নূরুল হক ও ছালেহ আহমেদকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তাদের লিখিত জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়েছে। তাদের জবানবন্দির আলোকে প্রাপ্ত তথ্যসমূহ যাচাই বাছাই করা হচ্ছে। ঘটনার ১৮ বছর পরে ভিকটিমের চেহারায় অনেক পরিবর্তন হতে পারে। তাই অদূর ভবিষ্যতে তাকে উদ্ধার করা হলেও চেহারা দেখে শনাক্ত করা নাও যেতে পারে। কল্পনার ভাইয়েরা বৃদ্ধ বিধায় ভিকটিমকে উদ্ধার করা হলে তাকে চিহ্নিত করার জন্য তার ভাইদের ডিএনএ সংগ্রহের জন্য আদালতের নির্দেশপ্রাপ্ত হলেও মামলার বাদী ও তার ভাই লাল বিহারী চাকমা ডিএনএ সংরক্ষণের জন্য আগ্রহী নয় বিধায় তা সংগ্রহ করা হয়নি। যেহেতু এই মামলার মূল সাক্ষী ভিকটিম কল্পনা চাকমা নিজেই, তাই উক্ত কল্পনা চাকমা উদ্ধার না হওয়া কিংবা তার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না পাওয়া পর্যন্ত মামলার তদন্ত শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না।”
বাদীর পক্ষ থেকে এই প্রতিবেদন নাখোশ করা হলে ২৭ মে ২০১৫ রাঙামাটি জেলা জজ আদালতের বিচারিক হাকিম মোহসিনুল হক আবারো অধিকতর তদন্তের প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। কিন্তু মামলাটির তদন্ত সম্পন্ন না হয়ে আমেনা বেগম অন্যত্র বদলি হয়ে গেলে ৩৯তম তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পান পুলিশ সুপার সাঈদ তারিকুল হাসান।
তিনি ২০১৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেশ করেন। ওই প্রতিবেদনে তিনি বলেন, “আমার তদন্তকালে ভিকটিমের অবস্থান নিশ্চিত না হওয়ায় তাহাকে উদ্ধার করা সম্ভব হয় নাই। এই লক্ষে বিশ্বস্ত গুপ্তচর নিয়োগ ছাড়াও বাদীর পক্ষে এবং এলাকার লোকজনদের সহায়তা কামনা এবং বিভিন্ন মাধ্যমে চেষ্টা করিয়াও ভিক্টিম কল্পনা চাকমাকে উদ্ধার এবং মামলার রহস্য উদঘাটন হয় নাই। বিধায় মামলা তদন্ত দীর্ঘায়িত না করিয়া বাঘাইছড়ি থানার চূড়ান্ত রিপোর্ট সত্য নং ০৩, তারিখ ৭/৯/২০১৬, ধারা ৩৬৪ দ: বি: বিজ্ঞ আদালতে দাখিল করিলাম। ভবিষ্যতে কল্পনা চাকমা সম্পর্কে কোনও তথ্য পাওয়া গেলে বা তাহাকে উদ্ধার করা সম্ভব হইলে যথানিয়মে মামলাটির তদন্ত পুনরুজ্জীবিত করা হইবে”।
পুলিশ সুপার সাঈদ তারিকুল হাসানের দাখিলকৃত চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে মামলার বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা আদালতে আবারো নারাজী আবেদন করেন। তার এই নারাজী আবেদনের উপর ২০১৭ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে চলতি বছর এপ্রিল পর্যন্ত বেশ কয়েক দফা শুনানী অনুষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ গত ২৩ এপ্রিল ২০২৪ অনুষ্ঠিত শুনানীতে রাঙামাটি জেলা চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের হাকিম ফতেমা বেগম মুক্তা পুলিশের দাখিল করা চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে মামলার বাদী কালিন্দী কুমার চাকমার নারজি আবেদন নামঞ্জুর করে আদেশ দিয়ে মামলাটি খারিজ করে দেন।
দীর্ঘ আটাশ বছরে এসে কল্পনা চাকমা অপহরণের ঘটনায জড়িত চিহ্নিত অপহরণকারী লে. ফেরদৌস গংদের বিচারের আওতায় না এনে মামলা খারিজ দিয়ে আদালত পক্ষপাতদুষ্টতার পরিচয় দিয়েছে। অপরাধীদের রক্ষায় আদালতের এ পদক্ষেপ দেশে বিশেষ করে পাহাড়ে বিচারহীনতার চিত্র আরো বেশি স্পষ্ট হয়েছে। আর এতেই প্রমাণ হয়, এই অপহরণ ঘটনা ছিল অত্যন্ত সুপরিকল্পিত এবং রাষ্ট্রীয় মদদদেই এই ঘটনা সংঘটিত করা হয়েছে। কাজেই, এ ঘটনায় রাষ্ট্র কখনো দায় এড়াতে পারে না।
হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও সিএইচটি কমিশন আদালত কর্তৃক মামলা খারিজের মাধ্যমে কল্পনা চাকমার চিহ্নিত অপহরণকারীদের দায়মুক্তির ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে সংবাদ মাধ্যমে বিবৃতি দেয়। সিএইচটি কমিশন আদালত কর্তৃক অপরাধীদের দায়মুক্তির ঘটনাকে বিচারিক গর্ভপাত হিসেবে আখ্যায়িত করে।
এছাড়া হিল উইমেন্স ফেডারেশনসহ সহযোগী সংগঠনগুলো কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলা খারিজের প্রতিবাদে গণবিক্ষোভ ও বিচারের নামে প্রহসনে লিপ্ত কুচক্রীদের কুশপুত্তলিকা দাহ কর্মসূচি পালন করে।
এদিকে, কল্পনা চাকমার অপহরণের ২৮ বছর উপলক্ষে এবং অপহরণ মামলা খারিজের প্রতিবাদ জানিয়ে হিল উইমেন্স ফেডারেশনসহ অন্যান্য সংগঠনগুলো ৬ জুন থেকে বিক্ষোভ ও চিহ্নিত অপহরণকারী লে. ফেরদৌস গংদের প্রতীকি ফাঁসি’র কর্মসূচি পালন করে আসছে। আজ ১২ জুন রাঙামাটির কুদুকছড়িতে একই কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া দিবসটি উপলক্ষে হিল উইমেন্স ফেডারেশন পোস্টার ও লিফলেট প্রকাশ করেছে।



সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।