কাউখালীতে নানা আয়োজনে বীরকন্যা প্রীতিলতার ৯৩তম আত্মাহুতি দিবস পালিত

0


কাউখালি প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ

বুধবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

রাঙামাটির কাউখালীতে নারী আত্মরক্ষা কমিটির উদ্যোগে গতকাল মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫) নানা আয়োজনে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার-এর ৯৩তম আত্মাহুতি দিবস পালিত হয়েছে।

দুই পর্বে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এর মধ্যে প্রথম পর্বে ছিল প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এর পরিচিতি পাঠ, অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও প্যারেড টিমের মাধ্যমে স্যালুট প্রদান ও শপথ গ্রহণ এবং দ্বিতীয় পর্বে আালোচনা সভা ও ক্যারাটে প্রদর্শন।

দুপুর ২টায় অনুষ্ঠিত এ আয়োজনে কাউখালীর বৃহত্তর ডাবুয়া এলাকায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন এলাকা থেকে আট শতাধিক ছাত্র, ছাত্রী ও সাধারণ জনগণ অংশগ্রহণ করে।

শুরুতে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এর পরিচিতি পাঠ করে শোনান হিল উইমেন্স ফেডারেশন কাউখালি উপজেলার সাধারণ সম্পাদক একামনি চাকমা। 

এরপর লড়াই সংগ্রামে আত্মবলিদানকারী বীর শহীদদের স্মরণে নির্মিত অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। এতে অংশ নেন যথাক্রমে নারী আত্মরক্ষা কমিটির সদস্য রিপনা চাকমার নেতৃত্বে একটি দল ও শিক্ষার্থীদের অপর একটি দল। এছাড়াও এলাকার মুরুব্বিসহ যুব-নারী সমাজের পক্ষ থেকেও পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়।


পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে ৪৫ জনের একটি নারী টিম মাঠে প্যারেড মার্চ করে এসে  প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারসহ লড়াই সংগ্রামে আত্মবলিদানকারী সকল বীর শহীদদের সম্মানে স্যালুট প্রদান করেন।

তারপর ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মবলিদানকারী বীর শহীদদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয় ।

পরে সমবেত জনতাসহ সকলকে শপথ নামা পাঠ করান নারী আত্মারক্ষা কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য রিপনা চাকমা। তার শপথনামা পাঠের মাধ্যমে অনুষ্ঠানে ১ম পর্ব শেষ হয়।

অন্যায়-অবিচার, দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামে অবিচল থাকার শপথ গ্রহণ করছেন উপস্থিত জনতা।

অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্ব বিকাল ৩ টার দিকে শুরু করা হয়।

“জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে বীরকন্যা প্রীতিলতাই আমাদের আদর্শ” স্লোগানকে ধারণ করে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় সংহতি জানিয়ে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন ইউপিডিএফ প্রতিনিধি থুইক্যচিং মার্মা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের রাঙামাটি জেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক দীপায়ন চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের ফটিকছড়ি ইউনিয়ন কমিটির সভাপতি বিউটি মার্মা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কাউখালি উপজেলার সভাপতি থুইনুমং মার্মা ও এলাকার স্থানীয় মুরুব্বী চাথুইমং মার্মা।

সভায় সভাপতিত্ব করেন নারী আত্মরক্ষা কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য রিপনা চাকমা সভাপতিত্বে ও সঞ্চালনা করেন রাঙামাটি জেলা নারী আত্মরক্ষা কমিটির সদস্য নন্দা চাকমা।

থুইক্যচিং মার্মা বলেন,  চট্টগ্রাম শহরের পাহাড়তলী স্টেশনের কাছে ইউরোপীয়ান ক্লাব ছিলো ব্রিটিশদের প্রমোদকেন্দ্র। সন্ধ্যা হতেই ইংরেজরা এই ক্লাবে এসে মদ খেয়ে নাচ, গান এবং আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠতো। একমাত্র শ্বেতাঙ্গ ও ক্লাবের কর্মচারীরা ছাড়া আর কেউ ধারে কাছে যেতে পারতো না। সেখানে লিখা ছিল, ‘কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ’।

সূর্য সেনের পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রীতিলতার নেতৃত্বে ১০ জনের একটি দল শিখে নেয় কীভাবে অস্ত্র চালাতে হয়, প্রয়োজনে কীভাবে খেয়ে ফেলতে হয় পটাশিয়াম সায়ানাইড। সিদ্ধান্ত হয় রাত ১০টা ৪৫ মিনিটের দিকে ক্লাবে আক্রমণ করা হবে। প্রীতিলতাকে পরানো হয় মালকোঁচা দেওয়া ধুতি আর পাঞ্জাবি। চুল ঢাকার জন্য মাথায় পরানো হয় সাদা পাগড়ি এবং পায়ে রাবার সোলের জুতা।

ক্লাবের পূর্বদিকের গেট দিয়ে ওয়েবলি রিভলবার ও বোমা নিয়ে আক্রমণের দায়িত্বে ছিলেন প্রীতিলতা। তিনি হুইসেল বাজিয়ে আক্রমণ শুরুর নির্দেশ দেওয়ার পরেই ঘনঘন গুলি আর বোমার আঘাতে পুরো ক্লাব কেঁপে উঠে। সব বাতি নিভে যায়। অন্ধকারে ছুটোছুটি করতে থাকে সবাই।

কয়েকজন ইংরেজ অফিসারের কাছে রিভলবার ছিলো। তারা পাল্টা আক্রমণ করে। একজন মিলিটারি অফিসারের রিভলবারের গুলি গিয়ে লাগে প্রীতিলতার বুকের বাঁ পাশে। তিনি গুলি লাগার পরেও বেঁচেছিলেন। শুধু লজ্জা নয়, আটক হলে ইংরেজদের টর্চারে গোপন তথ্য প্রকাশ হতে পারে এজন্য দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী খেয়ে ফেলেন পটাসিয়াম সায়ানাইড। মুহূর্তে মাটিতে ঢলে পড়েন। 

শৈশবে তাকে ডাকা হতো রানি বলে। বিপ্লবী জীবনে তার ছদ্মনাম ছিলো ফুলতারা। তিনি ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম বাঙালি নেত্রী ও প্রথম বিপ্লবী নারী শহিদ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ করে শহিদ হন। এখনও ভারত উপমহাদেশের সংগ্রামী নারী সমাজে প্রীতিলতা বরণীয় ও স্মরণীয়।


তিনি আরো বলেন, ১৯৮০ সালের ২৫ মার্চ কাউখালীতে কলমপতি গণহত্যা সংঘটিত হয় জিয়াউর রহমানের আমলে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ফলে গতবছর ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনা সরকার উৎখাত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। ফ্যাসিস্ট হাসিনা পতনের পরে দেশে ড. ইউনুস এর অন্তর্বর্তী সরকার ১৯-২০ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি ও রাঙামটিতে সাম্প্রদায়িক হামলা চালিয়েছে। সেনাবাহিনীর গুলিতে ও সেটেলার বাঙালি কর্তৃক জুনান চাকমা, রুবেল ত্রিপুরা, ধনরঞ্জন চাকমা,  অনিক চাকমা শহীদ হয়েছেন। ঘটনার এক বছর পেরিয়ে গেলেও সরকার এখনো খুনিদের বিচার করেনি। ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে হটাতে পাহাড়ের মানুষে আন্দোলন করেছিল। হাসিনার ডামি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ ২৭টি কেন্দ্র ভোট শূন্য রেখেছিল।

দীপায়ন চাকমা বলেন, জাতির ক্রান্তিলগ্নে অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের বীরকন্যা প্রীতিলতার আত্মাহুতি দানকারী আদর্শকে উর্ধ্বে তুলে ধরে লালন করতে হবে। প্রীতিলতা-সূর্যসেন-কল্পনা দত্তদের আত্মাহুতির ত্যাগ স্কুল-কলেজ ছাত্র-ছাত্রীদের পড়তে, জানতে হবে। তাদের ত্যাগ, আদর্শ স্মরণ করে আমাদের অনুপ্রাণিত করাতে হবে। ব্রিটিশদের নির্মম নির্যাতন-নিপীড়নের মাত্রা অবর্ণনীয় হওয়ায় প্রীতি-কল্পনা-সূর্যসেনরা জাতির কান্ডারী হয়ে নিজের জীবনকে বিসর্জন দিয়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকে সফল করার পথ তৈরি করেছেন। ব্রিটিশরা যেভাবে ভারতবর্ষের মেহনতি মানুষের সম্পদ, টাকা-পয়সা লুন্ঠন করে নিপীড়ন চালিয়েছে ঠিক একই রূপ আজকের পাহাড়ের অবৈধ সেনাশাসন। পার্বত্য চট্টগ্রামে অবৈধ সেনাশাসন ব্রিটিশ শাসনের সীমা অতিক্রম করে চলেছে। এ সেনাশাসনের মাধ্যমে তারা পাহাড়ে পর্যটন শিল্পের ব্যবসা করে পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীগুলোকে জাতিগত নিধন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আমার করের টাকায় নিরাপত্তার নামে আমার ভাইয়ের বুকে গুলি চালানো হচ্ছে, আমার মা-বোনকে ধর্ষণ-শ্লীলতাহানি করা হচ্ছে। প্রতিনিয়ত রাত-বিরাতে নিরীহ সাধারণ জনগণের ঘরবাড়িতে তল্লাশি, হামলা, মামলা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে।


তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিগত বিভাজনের একমাত্র কারণ পাহাড়ে অবৈধ সেনাশাসন। এ সেনাশাসনকে উৎখাত করতে নারী-পুরুষ সকলকে আওয়াজ তুলতে হবে, রাজপথে নামতে হবে, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

তিনি জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগণকে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার আদায়ের জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান।

সভাপতি রিপনা চাকমা বলেন, সরকার পরিকল্পিতভাবে যখন পাহাড়ে সেটেলারদের নিয়ে আসে তখন থেকে বর্তমান অবধি পাহাড়ের নারীদের অনিরাপত্তার মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে। নিজের বাড়িতে, স্কুলে, হাট বাজারে কোথাও নিরাপত্তা নেই। কোন  সময় সেটেলার কর্তৃক আবার কোন সময় সেনাবাহিনী কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হতে হয়। নারীদের নিজেকে রক্ষার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। নারী আত্মরক্ষা কমিটির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে-কানাচে মা-বোনদের প্রস্তুত করতে চাই।  প্রীতিলতারা সশস্ত্র আন্দোলনের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। এই প্রশিক্ষণ শুধু নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেরনি। তাঁরা পুরো জাতিকে রক্ষার জন্য নিজেদের জীবনকে বিসর্জন দিয়েছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম রক্ষার জন্য আমাদেরও প্রীতিলতাদের মতো লড়াই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে হবে।

আলোচনা শেষে কারাটে প্রদর্শনীর মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠান সমাপ্ত হয়।



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More