কাউখালী কলমপতি গণহত্যার ৪৫ বছর: আজও হয়নি বিচার

0

সিএইচটি নিউজ ডেস্ক
মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ ২০২৫

আজ ২৫ মার্চ কাউখালী (কলমপতি) গণহত্যা দিবস। ১৯৮০ সালের এই দিনে রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার কলমপতি ইউনিয়নে রাষ্ট্রীয় মদদে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও সেটেলার বাঙালি দ্বারা পাহাড়িদের ওপর এক বর্বরতম গণহত্যা চালানো হয়েছিলো। সেদিন সেনা কর্মকর্তারা বৌদ্ধ বিহার সংস্কারের জন্য পাহাড়িদের ডেকে এনে নৃশংসভাবে ব্রাশফায়ার করে এবং সেটলারদের লেলিয়ে দেয়। সেনা ও সেটলারের হামলায় এ হত্যাকাণ্ডে ৩০০-এর অধিক নিরীহ পাহাড়ি প্রাণ হারায়। হামলাকারীরা নিকটস্থ বৌদ্ধ বিহারগুলোতে হামলা করে ভিক্ষুদেরকে গুরুতর জখম করে এবং পুরো এলাকা তাণ্ডব-লুটপাট চালায়। এ হত্যাকাণ্ড ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের সাথে তুলনীয়।

স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় মদদে সংঘটিত বর্বরোচিত এ গণহত্যার আজ ৪৫ বছরেও কোন বিচার হয়নি।

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, যেদিন এই বর্বর গণহত্যার ঘটনা ঘটেছিল সেদিন ছিল সাপ্তাহিক হাটবার। স্থানীয় সেনা ইউনিটের কমাণ্ডার হাটে ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা দেয় যে পোয়াপাড়া বৌদ্ধ মন্দির মেরামত করা হবে। তাই পাহাড়িরা যাতে বৌদ্ধ মন্দির প্রাঙ্গনে অনতিবিলম্বে হাজির হয়। পাহাড়িরা মন্দির মেরামতের কাজ করার জন্য সেখানে উপস্থিত হলে সেনা কমাণ্ডার সবাইকে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করার নির্দেশ দেয়।  গুলিতে নিমিষেই প্রাণ হারায় শতাধিক পাহাড়ি। নিহতের মধ্যে বাজার চৌধুরী কুমুদ বিকাশ তালুকদার, স্থানীয় ইস্কুল কমিটির সেক্রেটারী কাশীদেব চাকমাও রয়েছেন।

এ হত্যাকাণ্ডের পরও সেনাবাহিনী ক্ষান্ত হয়নি। তারা সেটলারদের সঙ্গে নিয়ে পাহাড়ি অধ্যুষিত কাউখালী মুখ পাড়া, পোয়াপাড়া, কাউখালী বাজার, তোং পাড়া এবং হেডম্যান পাড়া আক্রমণ করে। সেনাবাহিনী গ্রামের চারিপাশে ঘিরে থাকে যাতে কেউ বেরুতে না পারে। আর সেটলাররা দা, কুড়াল ইত্যাদি অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে পাহাড়িদের কুপিয়ে হত্যা করে ও ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। মুখপাড়া বৌদ্ধ মন্দির, তোং পাড়া আনন্দ মোহন বৌদ্ধ মন্দির, পোয়া পাড়া বৌদ্ধ মন্দির, কাউখালী বৌদ্ধ মন্দির এবং হেডম্যান পাড়া বৌদ্ধমন্দিরও এদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। মারধর ও কুপিয়ে জখম করা হয় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের।

ঘটনার প্রায় একমাস পর ২২শে এপ্রিল ১৯৮০ তৎকালীন বিরোধী দলীয় তিন সংসদ সদস্য শাহজাহান সিরাজ(জাসদ), উপেন্দ্র লাল চাকমা(জাসদ) ও রাশেদ খান মেনন(ওয়ার্কার্স পার্টি) ঘটনা সরেজমিন তদন্ত করতে কলমপতি যান।  ঢাকায় ফিরে ২৫ এপ্রিল ১৯৮০ তারা এক সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করেন। এতে তারা জানান, “নৃংশস ঘটনাবলীর খবর সম্পূর্ণ সত্য। ২৫ মার্চ সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে তিনশ পাহাড়ি নিহত ও সহস্রাধিক নিঁখোজ হয়েছে। এ হত্যাকাণ্ডকে একাত্তরের পঁচিশে মার্চ পাকিস্তান হানাদার বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের সাথে তুলনা করে তারা বলেন- এই হত্যাকাণ্ড বাঙালি জাতির জন্য লজ্জা।”

সংবাদ সম্মেলনে তারা কলমপতি ইউনিয়নে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড ও অন্যান্য ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত, বিচার ও শ্বেতপত্র প্রকাশ, দুঃস্থ পাহাড়ি পরিবারগুলোর যথাযথ নিরাপত্তা সহকারে পুনর্বাসন, বিধ্বস্ত বৌদ্ধ মন্দির পুনর্গঠন, বিভিন্ন জেলা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে শরণার্থী (সেটলার) পুনর্বাসন বন্ধ করা, সেটলারদের অনতিবিলম্বে ফিরিয়ে নেওয়াসহ ছয় দফা দাবি জানান।

এ হত্যাকাণ্ডের পর এক হাজারের অধিক পাহাড়ি নিজ জায়গা-জমি, বসতভিটা ছেড়ে শরণার্থী হিসেবে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। বর্তমানে ঐসব জায়গা সেটলাররা বেদখল করেছে, বৌদ্ধ মন্দিরের জায়গায় মসজিদ বানানো হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে শুধু কলমপতি গণহত্যা নয়, এ যাবত ডজনের অধিক গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু এই রাষ্ট্র কোন গণহত্যারই বিচারের উদ্যোগ নেয়নি। উপরন্তু শাসকগোষ্ঠি পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে পাহাড়িদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার লক্ষ্যে নানা চক্রান্ত জারি রেখেছে।



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More