খাগড়াছড়িতে ভুক্তভোগীদের সাড়ে ৪ ঘন্টা মানববন্ধন, দেখা করলেন না মানবাধিকার কমিশনের কেউ
খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
সোমবার, ১৬ জানুয়ারি ২০২৩

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ ও সদস্যবৃন্দের খাগড়াছড়ি সফর উপলক্ষে আজ সোমবার (১৬ জানুয়ারি ২০২৩) বিভিন্ন ঘটনার ভুক্তভোগী লোকজন খাগড়াছড়ি শহরের চেঙ্গী স্কোয়ার এলাকায় দীর্ঘ সাড়ে ৪ ঘন্টা ব্যাপী মানববন্ধন করেছেন। তাঁদের আশা ছিল মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের সাথে দেখা করে তারা তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা জানাবেন। কিন্তু না, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানতো দূরের কথা কমিশনের কেউ মানববন্ধনকারী ভূক্তভোগীদের সাথে দেখা করতে আসেননি। সফর দলটি চুপিসারে মানববন্ধন কর্মসূচির এলাকা পাশ কাটিয়ে খাগড়াছড়ি শহরে প্রবেশ করে সার্কিট হাউজে পৌঁছায়।
সফরসূচি অনুযায়ী মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও তাঁর সদস্যবৃন্দ আজ সোমবার (১৬ জানুয়ারি ২০২৩) দুপুর ১টায় সড়ক পথে খাগড়াছড়ি সার্কিট হাউজে পৌঁছার কথা ছিল এবং বিকাল ৪টায় সেখানে একটি মতবিনিময় সভা হওয়ার কথা ছিল। সে অনুযায়ী দুপুর ১২টার দিকে খাগড়াছড়ি শহরের চেঙ্গী স্কোয়ার এলাকায় দীঘিনালার বাবুছড়ায় বিজিবি ৫১ ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার্স স্থাপনকালে উচ্ছেদকৃত ২১ পরিবারের সদস্যরা, ২০১৮ সালে স্বনির্ভর বাজারে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে নিহতদের পরিবার ও স্বজনরা এবং মহালছড়ির মাইসছড়ি ভূমি রক্ষা কমিটির ব্যানারে সেখানে ভূমি বেদখলের শিকার হওয়া লোকজন মানববন্ধনে মিলিত হন। এ সময় তারা ভূমি বেদখল ও মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধসহ বিভিন্ন দাবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ড-ব্যানার প্রদর্শন করে মানবাধিকার কমিশনের সফর দলকে অপক্ষো করতে থাকেন।

মানবন্ধনে বাবুছড়ায় বিজিবি কর্তৃক উচ্ছেদকৃত ২১ পরিবারের ব্যানারে লেখা হয় “নিরাপত্তা ও সেনা ক্যাম্প স্থাপনের নামে পাহাড়িদের ভূমি বেদখলের ষড়যন্ত্র বন্ধ কর”।
মাইসছড়ি ভূমি রক্ষা কমিটির ব্যানারে লেখা হয় “সেটলার বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সমতলে সম্মানজনক পুনর্বাসন কর, পাহাড়িদের প্রথাগত ভূমি অধিকারের স্বীকৃতি ও বেদখলকৃত ভূমি ফেরত দাও”।
স্বনির্ভর হত্যাকাণ্ডে নিহতদের পরিবার ও স্বজনরা ব্যানারে লেখেন “স্বনির্ভর হত্যাকাণ্ডের বিচার কর, মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ কর, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাও”।

মানববন্ধনে ভুক্তভোগী পরিবারের পক্ষ থেকে স্বনির্ভর হত্যাকাণ্ডে নিহত ছাত্র নেতা এল্টন চাকমার পিতা নীহার বিন্দু চাকমা সাংবাদিকদের বলেন, আমার ছেলে এল্টন চাকমা ঢাকায় মাস্টার্সের ২য় বর্ষের ছাত্র ছিল। স্বনির্ভর বাজারে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করা হয়েছে, সেখানে যে গণহত্যা করা হয়েছে ওই হত্যাকারীদের এবং মদদদাতাদের অবিলম্বে বিচার চাই।
মানববন্ধন করছেন কেন সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, আমাদের দুঃখের কথা মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানকে বলার জন্য এই মানববন্ধন করছি। কারণ আমাদের এলাকায় কত নির্যাতন, খুন, ধর্ষণ হচ্ছে এসব ঘটনার বিচার আমরা কোনদিন পাইনি।
কয়েক বছর আগে কালাপাহাড় নামক স্থানে একজন মহিলাকে ধর্ষণ করে নির্মমভাবে হত্যা করা হলেও বিচারতো আমরা পাইনি, ধর্ষকরা এখনো প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাদের গ্রামে এক মেয়েকে প্রকাশ্যে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে, সে বিচারও আমরা পাইনি। কাজেই, প্রশাসনের কাছে আমরা আর সুষ্ঠু বিচার আশা করতে পারি না। সেজন্য মানবাধিকার কমিশনের কাছ থেকে সুষ্ঠু বিচার পাওয়ার জন্য আমরা আজকে মানববন্ধন করছি।

মহালছড়ির পাগজ্যাছড়ি ভিতর পাড়ার বাসিন্দা ও মুরুব্বী সুশীল ভূষণ চাকমা সাংবাদিকদের বলেন, আমার নিজ জায়গা থেকে আব্দুল গফুর নামে এক সেটলার বাঙালি গাছ কেটেছে, বাধা দিলেও সে শুনেনি। এ ঘটনায় আমি মহালছড়ি থানায় মামলা দিয়েছি, কিন্তু কোন প্রতিকার পাইনি। গতবছর জয়সেন পাড়ায় পাহাড়িদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও জিনিসপত্র লুটপাট করা হয়েছে। সে ঘটনার বিচার তারা এখনো পায়নি। উল্টো পাহাড়িদের নামে মহালছড়ি থানায় মামলা দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, শুনেছি আজকে নাকি মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান আসছেন। তাই এসব ঘটনার সুষ্ঠু বিচার পাওয়ার জন্য মানবাধিকর কমিশনের কাছে বিচার চাইতে আজকে মানববন্ধনে এসেছি।
বাবুছড়ায় উচ্ছেদকৃত ২১ পরিবারে প্রতিনিধি নতুন চন্দ্র চাকমা বলেন, বিজিবি তাদেরকে উচ্ছেদ করার পর তারা এখনো ভূমিহীন অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন। তাদের নিজ ভূমি ফিরে পেতে মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যানের সাথে দেখা করতে এসেছেন।

বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত ভূক্তভোগী লোকজন মানববন্ধন করে মানবাধিকার কমিশনকে অপেক্ষা করেন। কিন্তু কমিশনের সফর দলটির দেখা পাননি মানববন্ধনকারী ভুক্তভোগীরা। কমিশনের কেউ তাদের সাথে দেখা করতে আসেননি।
পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কমিশনের সফর দলটি আসার পথে গুইমারায় কংজরী চৌধুরীর বাড়িতে যাত্রা বিরতি করে সময় ক্ষেপন করে। সেখান দুপুরের খানা খেয়ে তারা বিকাল ৩:৫০টার দিকে খাগড়াছড়ি জিরোপয়েন্ট পৌঁছে এবং সেখান থেকে তারা খাগড়াছড়ি শহরে প্রবেশের মূল সড়ক চেঙ্গী স্কোয়ারের রাস্তা ব্যবহার না করে বিকল্প রাস্তা দিয়ে খাগড়াছড়ি সার্কিট হাউজে পৌছায়।
এ খবর পেয়ে মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারী ভুক্তভোগীরা তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তারা মানবাধিকার কমিশনের সফর নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এরপর তারা মানববন্ধন কর্মসূচি সমাপ্ত করে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন এবং স্বনির্ভর বাজারে গিয়ে সমাবেশের মধ্য দিয়ে মিছিলটি শেষ করেন।

এতে ভুক্তভোগীদের পক্ষে বক্তব্য দিয়ে রিতা চাকমা বলেন, ভুক্তভোগীরা মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের সাথে দেখা করার জন্য দুপুর ১২টা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত অধির আগ্রহে ছিলেন। অথচ কমিশন তাদের সাথে দেখা না করে চুপিসারে বিকল্প রাস্তায় সার্কিট হাউজে প্রবেশ করেছে।
তিনি বলেন, মানবাধিকার কমিশনকে এখন আওয়ামী লীগ সরকারের অংশ করা হয়েছে। তাই এই কমিশন স্বাধীনভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। যার ফলে কমিশন পাহাড়ি জনগণের সমস্যা নিয়ে কাজ করতে ব্যর্থ। সুতরাং এখান থেকে বুঝতে বাকি নেই এই কমিশন থেকে বেশি কিছুই আশা করা ভুল । তিনি কমিশনকে কেবল আওয়ামী লীগ সরকারের হাতের পুতুল হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। পর্যটন, সেনা ক্যাম্প স্থাপনের নামে ভূমি বেদখল, সেটলার বাঙালিরা প্রতিনিয়ত ভূমি বেদখল করছে, পাহাড়ি নারীদের উপর প্রতিনিয়ত ধর্ষণ-যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটছে। এছাড়াও গুইমারায় বৌদ্ধ বিহার ভাংচুর, মহালছড়ি মাইসছড়ি জয়সেন পাড়ায় পাহাড়িদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, বান্দরবান লামায় রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ’র নামে ত্রিপুরা, ম্রো সম্প্রদায়কে উচ্ছেদ করার পায়তারা চলানো হচ্ছে।
২০১৮ সালের ১৮ আগস্ট স্বনির্ভর বাজারের হত্যাকাণ্ড তুলে ধরে তিনি বলেন, সেদিন পুলিশ-বিজিবি সদস্যদের সামনে সেনা সৃষ্ট দুর্বৃত্তরা প্রকাশ্যে ৬ জনকে গুলি করে হত্যা এবং একই দিনে পেরাছড়ায় মিছিলের ওপর গুলি চালিয়ে আরেকজনকে হত্যা করে। সে সময় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন তদন্তে আসলেও কমিশনের সেই তদন্ত রিপোর্ট আজ পর্যন্ত প্রকাশ করা হয়নি। এই ঘটনায় জড়িত সন্ত্রাসীরা সেনা-প্রশাসনের আশ্রয়-প্রশ্রয়ের থেকে প্রতিনিয়ত অপহরণ, খুন, গুম, অপহরণ-মুক্তিপণ আদায় করছে। তারা মিঠুন চাকমার মতো একজন উদীয়মান নেতাকে হত্যা করেছে। অথচ এসব ঘটনায় কমিশন একেবারেই নিশ্চুপ রয়েছে।

তিনি বলেন, ২০১৭ সালে নান্যাচরে ছাত্র নেতা রমেল চাকমাকে সেনা হেফাজতে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা, ২০১৯ সালে সেনাবাহিনী কর্তৃক দীঘিনালায় ইউপিডিএফ’র তিন সদস্যকে, সাজেকে ইউপিডিএফের সাবেক সদস্যকে বিন বিচাারে গুলি করে হত্যা এবং ২০২২ সালে ইউপিডিএফ সংগঠক নবায়ন চাকমা মিলনকে সেনা হেফাজতে নির্যাতন চালিয়ে হত্যাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় মানবাধিকার কমিশন টু শব্দও করেনি। অথচ মানবাধিকার লঙ্ঘনের এসব ঘটনায় কমিশনের সবচেয়ে বেশি সক্রিয় হওয়ার কথা।
আজকে ভূক্তভোগীদের সাথে দেখা না করার ঘটনায় এটা প্রমান করে যে, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে চরমভাবে উদাসীন।
এদিকে, সকাল সাড়ে ১১টার সময় মানবাধিকার কমিশনের সফর দলটি খাগড়াছড়ি আসার পথে রামগড় এলাকার জনসাধারণ রামগড়-খাগড়াছড়ি সড়কে দাঁড়িয়ে মানববন্ধন করে মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধের বিভিন্ন দাবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ড ও ব্যানার প্রদর্শন করেন। এ সময় কমিশনের সফর দলটির সাথে জনগণ কথা বলতে চাইলে কমিশনের গাড়ি বহরের পিছনে থাকা বিজিবি সদস্যরা নিজেদের গাড়ি থেকে নেমে মানববন্ধনের ব্যানার কেড়ে নেয় ও মানববন্ধন ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার চেষ্টা চালায় বলে খবর পাওয়া গেছে।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।
সিএইচটি নিউজের ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন