খাগড়াছড়িতে ‘সংঘাত ও বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন’র সংবাদ সম্মেলন
সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি এবং ছাত্র-জনতাকে সাথে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তুলতে আঞ্চলিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান

খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৪
পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত সেনাবাহিনী ও সেটালারদের সাম্প্রদায়িক হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর, এলোপাতাড়ি ব্রাশফায়ারে জুম্ম হত্যার প্রতিবাদে ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান পরিস্থিতি এবং তাদের প্লাটফর্ম সম্পর্কে স্পষ্টকরণের জন্য সংবাদ সম্মেলন করেছে ‘সংঘাত ও বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন’।
আজ বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর ২০২৪) সকাল ১০টায় খাগড়াছড়ি সদরের জিরোমাইল এলাকার হিল ফ্লেভারস রেস্টুরেন্টে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন তুষিতা চাকমা। এসময় আরো উপস্থিত ছিলেন লাব্রে মারমা, কৃপায়ন ত্রিপুরা, কিকো দেওয়ান প্রমুখ।
লিখিত বক্তব্যে তুষিতা চাকমা গত ১৯-২০ সেপ্টেম্বর এবং ১ অক্টোবর দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি সদর ও রাঙামাটিতে পাহাড়িদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা, ঘরবাড়ি-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর-লুটপাট এবং জুনান চাকমা, রুবেল ত্রিপুরা, ধন রঞ্জন চাকমা ও অনিক চাকমাকে হত্যার বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বৈষম্যহীন, মানবিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ায় অংশ হতে আমরা পাহাড়ি ছাত্র-জনতা রাজপথে নেমে দাবি জানিয়ে আসছি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে নস্যাৎ করে দিতে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহায়তায় সেটলারদের দ্বারা কৃত্রিম ও পূর্ব-পরিকল্পিতভাবে দীঘিনালা, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত করা হয়েছে’।
এতে তিনি আরো বলেন, ‘দেশে ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সাথে রাষ্ট্রীয় বৈষম্য এবং পাহাড়িদের উপর রাষ্ট্রীয় শোষণ-নিপীড়নের স্ট্রিম রোলার আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শাসনামলের মতোই অব্যাহত রয়েছে। আমরা মনে করি, সেনাশাসনের বৈধতা সৃষ্টির লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল প্রমাণ করতে পরিকল্পিতভাবে মব জাস্টিস ও সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনাগুলো ঘটানো হচ্ছে’।
সংবাদ সম্মেলনে অবিলম্বে সেনা-সেটেলার কর্তৃক সাম্প্রদায়িক হামলা, হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং শিক্ষার্থীদের নামে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার করে বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে বিচারের দাবি দাবি জানানো হয় এবং অনতিবিলম্বে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন মামলাগুলো প্রত্যাহার করা না হয় ‘কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবো’ বলে জানানো হয়।

তুষিতা চাকমার তার লিখিত বক্তব্যে সংবিধান সংস্কার কমিশনে পাহাড়িদের প্রতিনিধি না রাখার বিষয় তুলে ধরে বলেন, “গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পর একটি ইনক্লুসিভ বৈষম্যহীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখছে দেশের আপামর জনসাধারন। নতুন বাংলাদেশ বিনির্মানের অংশীদারী হতে আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে গড়ে তুলেছিলাম এই “সংঘাত ও বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন” প্লাটফর্ম। আমরা শুরু থেকেই সংবিধান সংস্কারে পাহাড়ি আদিবাসীদের মূল্যায়নের দাবি জানিয়ে আসছিলাম। সংবিধান সংস্কার কমিশনে চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়ের থাকার কথা থাকলেও আমরা জেনেছি একটি উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর চাপে সরকার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছে। যা বৈষম্যহীন ইনক্লুসিভ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার পরিপন্থী। যে আশা আকাঙ্খা নিয়ে পাহাড়ি জনগণ ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে এসে আমরা সেটার প্রতিফলন পার্বত্য চট্টগ্রামে দেখতে পাচ্ছি না। বাংলাদেশকে একটি বৈষম্যহীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরে আমরাও সম্পৃক্ত হতে চেয়েছি বারেবারে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র অভ্যুদয়ের পর থেকে রাষ্ট্রের কোনো শাসকই আমাদের রাষ্ট্র গঠনে সম্পৃক্ত তো করেনি বরং সবসময়ই পার্বত্য চট্টগ্রামকে তারা বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।”
সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যে তুষিতা চাকমা সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্লাটফর্ম সম্পর্কে নানা অপপ্রচারের বিষয়ে বলেন, “আমরা গভীর মর্মাহতভাবে লক্ষ্য করছি যে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের “সংঘাত ও বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন”—প্লাটফর্মকে বিতর্কিত করার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়াশীল অংশ এবং বিভিন্ন মহল আমাদের এই প্লাটফর্মকে ইউপিডিএফ এর সংগঠন বলে অপপ্রচার করছে এবং সেই সাথে বিভিন্ন স্বার্থন্বেষী মহল আমাদের এই প্লাটফর্মকে ব্যবহার করে তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা করছে। যা অত্যন্ত নিন্দনীয় ও দুঃখজনক। আমাদের প্ল্যাটফর্ম “সংঘাত ও বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন”—এর নামে অপপ্রচারের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। পাহাড়ে জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আমাদের যে গণতান্ত্রিক লড়াই তাকে এগিয়ে নিতে আমরা সকলের সাথে নিরপেক্ষ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।”
সংবাদ সম্মেলন থেকে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, “এগত্তর” স্লোগানকে সামনে রেখে গড়ে উঠেছে আমাদের এই প্ল্যাটফর্ম। আমরা সকল আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোকে পারস্পরিক বিরোধার্থক অবস্থান পরিহার করে, ছাত্র-জনতাকে সাথে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে যুগযুগ ধরে চলা রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন-নির্যাতন ও বৈষম্যর অবসান ঘটাতে যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি।”
এতে আরো বলা হয়, “আমরা মনে করি, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জুম্ম জনগণের সম্মিলিত শক্তিসহ সারা দেশের অধিকার সচেতন প্রগতিশীল মানুষের ঐক্যবদ্ধতা, দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে পাহাড়ের অভিভাবকতূল্য আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য এবং রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণকারীদের রাজনৈতিক সদিচ্ছাই পারে পাহাড়ের সংকট-সমস্যা সমাধান করে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে”।
এছাড়াও সংবাদ সম্মেলন থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিতকরণ, স্ব স্ব জাতিসত্তার স্বীকৃতিসহ “আদিবাসী” হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি, ৫% কোটা পুনর্বহাল, পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক ভূমি সমস্যার সমাধান ও ১৯০০ সালের রেগুলেশন বহাল রাখা, পার্বত্য চট্টগ্রামকে পানিশমেন্ট জোন হিসেবে ব্যবহার বন্ধ করাসহ ৮ দফা দাবি জানানো হয়েছে।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।