চট্টগ্রামে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সংবাদ সম্মেলন
খাগড়াছড়িতে স্কুলছাত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত সকল আসামিকে গ্রেফতার-শাস্তিসহ পাঁচ দাবি

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
সোমবার, ২১ জুলাই ২০২৫
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খাগড়াছড়ি ভাইবোনছড়ায় সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার স্কুলছাত্রীর সাথে সাক্ষাত শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে অবিলম্বে ঘটনায় জড়িত সকল আসামিকে গ্রেফতার, দৃষ্টান্তমূলক সাজা কার্যকর করাসহ পাঁচ দফা দাবি জানিয়েছে ঢাকা থেকে আসা ভিকটিমের সাথে সাক্ষাতকারী প্রতিনিধি দলটি।
প্রতিনিধি দলটি আজ (২১ জুলাই ২০২৫) সকালে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেতৃত্বে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে এসে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিযে ভিকটিম স্কুলছাত্রী ও তার পরিবারের সাথে সাক্ষাত করে। এরপর বিকালে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের ‘আবদুল খালেক’ মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে হিল উইমেন্স ফেডারেশন।
সংবাদ সম্মেলনে উত্থাপিত দাবিগুলোর মধ্যে আরো রয়েছে, সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার স্কুল ছাত্রীর চিকিৎসার ব্যয়, সামাজিক নিরাপত্তাসহ পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা; পাহাড়-সমতলে নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি নারী ধর্ষণের মেডিকেল রিপোর্টের ওপর সরকারী বিশেষ সংস্থার গোপন নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া ও পাহাড়ি নারীদের নিরাপত্তার হুমকি সেনা-সেটলার প্রত্যাহার করা।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন- নীতি চাকমা, সভাপতি, হিল উইমেন্স ফেডারেশন; নাসরিন সিরাজ, নৃবিজ্ঞানী ও সহকারী অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়; তানিয়াহ মাহমুদা তিন্নী, শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক কর্মী; ব্যারিস্টার মিমি মেহনাজ, মানবাধিকার আইনজীবি; মারজিয়া প্রভা, অধিকারকর্মী ও সদস্য, গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি; ফেরদৌস আরা রুমী, অধিকারকর্মী ও সদস্য, গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি; ড. সুরাইয়া ইয়াসমিন পলি, সদস্য, ডক্টরস প্লাটফর্ম ফর পিপলস হেলথ; অমল ত্রিপুরা, সভাপতি, বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি); স্কাইয়া ইসলাম, অর্থ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটি, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল; রিপা মজুমদার, সদস্য, নারী মুক্তি কেন্দ্র; সীমা ত্রিপুরা, সহসভাপতি, ত্রিপুরা স্টুডেন্ট ফোরাম, বাংলাদেশ ও ছাত্র প্রতিনিধি কৃপায়ন ত্রিপুরা। এছাড়া ভিকটিম ছাত্রীর বড়বোনও এতে উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভাপতি নীতি চাকমা লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, গত ২৭ জুন রথযাত্রার মেলায় অংশ নেওয়ার পর সন্ধ্যায় বাড়িতে ফিরতে না পেরে খাগড়াছড়ির ভাইবোনছড়া বাজারস্থ উন্নয়ন বোর্ডের বাসভবনের পাশে এক আত্মীয়ের ভাড়া বাসায় রাত্রীযাপনের সময় রাত আনুমানিক সাড়ে ৯টর দিকে ৬ জন সেটলার বাঙালি (যারা বিএনপি রাজনীতির সাথে যুক্ত) দ্বারা ১৪ বছর বয়সী ৮ম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক পাহাড়ি স্কুলছাত্রী সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়। উক্ত ঘটনায় ধর্ষণের সাথে জড়িত খাগড়াছড়ি সদর থানায় দায়েরকৃত মামলায় অভিযুক্ত আসামী ভাইবোনছড়া ইউনিয়নের স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি আরমান হোসেন (৩২), সদস্য ইমন হোসেন (২৫) ও এনায়েত হোসেন (৩৫), শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন (৩২), বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. মুনির ইসলাম (২৯) ও ছাত্রদলের সহসাংগঠনিক সম্পাদক মো. সোহেল ইসলাম (২৩)’।
সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার ভুক্তভোগী ছাত্রী সামাজিক লজ্জা ও ভয়ভীতির কারণে প্রথমে পরিবারকে কিছু জানায় নি। ফলে ঘটনাটি সকলের কাছে অজানা থেকে যায়। পরে সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে গত ১২ জুলাই বিষ পান করে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। পরিবারের লোকজন তাকে উদ্ধার করে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর গত ১৬ জুলাই মেয়েটি পরিবারের লোকজনকে ধর্ষণের বিষয়টি জানায়। পরে ছাত্রীর বাবা বাদী হয়ে খাগড়াছড়ি সদর থানায় ৬ জনের নামে মামলা করলে সেদিন রাতে পুলিশ অভিযুক্তদের মধ্য থেকে চার জনকে গ্রেফতার করে। কিন্তু মামলা হওয়ার ৫ দিন অতিক্রম হলেও বাকী পলাতক দুই আসামীকে এখনো পর্যন্ত গ্রেফতার করেনি পুলিশ।

লিখিত বক্তব্যে আরো বলা হয়, ছাত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনাটি জানাজানি হলে সহপাঠী শিক্ষার্থী ও পার্বত্যবাসীসহ দেশের বিবেকবান মানুষের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ঘটনার প্রতিবাদে ও বিচারের দাবিতে ১৭ জুলাই ২০২৫ মুনিগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় ও ভাইবোনছড়া উচ্চ বিদ্যালয়সহ এলাকার বেশ কয়েকটি স্কুল-কলেজের শত শত শিক্ষার্থী রাজপথে নেমে বিক্ষোভ মিছিল করেন। তাদের সাথে যুক্ত হয় বিভিন্ন এলাকার যুব-নারী-জনতাও। বিক্ষোভ- প্রতিবাদ ভাইবোনছড়ায় সীমাবদ্ধ না থেকে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, বান্দরবান, চট্টগ্রাম, ঢাকা, রাজশাহীতে বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক দল বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ইউপিডিএফ, বাসদ (মার্কসবাদী), সিপিবিসহ দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলও বিবৃতি দিয়ে ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়।
এতে অভিযোগ করে বলা হয়, গত ১৭ জুলাই সকাল ১১টায় ভাইবোনছড়ায় সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে এবং ধর্ষণকারীদের দ্রুত গ্রেফতার-শাস্তির দাবিতে “সাধারণ শিক্ষার্থী ও যুব সমাজ” এর ব্যানারে ভাইবোনছড়া বাজার এলাকায় বিক্ষোভ চলাকালে স্থানীয় ভাইবোনছড়া আর্মি ক্যাম্পের সেনা সদস্যরা বিক্ষোভকারীদের ওপর অতর্কিভাবে হামলা চালিয়েছে। সেনারা লাঠিচার্জ করে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় এবং কয়েকজনকে ধরে নিয়ে অমানুষিকভাবে শারীরিক নির্যাতন করেছে। এতে ডিবিসি নিউজের খাগড়াছড়ি জেলা প্রতিনিধি (সাংবাদিক) মিলন ত্রিপুরা ও এলাকার সাধারণ গ্রামবাসী জগৎ শান্তি চাকমা মারাত্মকভাবে জখম হন। সেনা সদস্যরা সাংবাদিক মিলন ত্রিপুরার কাছ থেকে ছবি তোলার কারণ জানতে চায় এবং ক্যামেরা থেকে ছবিগুলো তাদের সামনে মুছে ফেলতে বাধ্য করে। এছাড়া সেনাদের হামলায় মুক্তি বাবু ত্রিপুরা, সুনয়ন ত্রিপুরা, শিবা ত্রিপুরা, ও সৌরভ ত্রিপুরাসহ অনেকে আহত হয়েছেন।
ধর্ষণবিরোধী বিক্ষোভে সেনা সদস্যদের এমন হামলার ঘটনা অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক। যা সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্ব কাজের চেয়ে ধর্ষকদের রক্ষা করার মত অর্থাৎ রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভুমিকা পালন করার সামিল।
সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনাকে ধামচাপা দিয়ে রাখতে একটি কু-চক্রি মহল নানাভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে উল্লেখ করে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, দেশের শাসন ক্ষমতা প্রত্যাশী একটি রাজনৈতিক দলের এজেন্ডার অংশ হিসেবে তারা স্যোসাল মিডিয়ায় নানা বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে। নিজেরা বক্তব্য লিখে দিয়ে ত্রিপুরা জাতি ভিত্তিক সামাজিক সংগঠনসমূহ ও তথাকথিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম সম-অধিকার আন্দোলন’ এর ব্যানারে সংবাদ সম্মেলন করিয়েছে, যার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত দলীয় পরিচয়ধারী অপরাধীদের রক্ষা করা।
লিখিত বক্তব্য পাঠ শেষে ঢাকা থেকে আগত প্রতিনিধি দলের সদস্য নৃবিজ্ঞানী ও ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক নাসরিন সিরাজ বলেন, ভিক্তিমের সাথে সাক্ষাতের পর আমরা জানতে পেরেছি ধর্ষণের ঘটনার ২৫দিন অতিবাহিত হলেও এখনো পর্যন্ত ধর্ষণের কোন মেডিকেল রিপোর্ট সংগ্রহের জন্য পুলিশ প্রশাসন থেকে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। এতে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন নানা অজুহাতে চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন ও গাফিলতির পরিচয় দিয়েছে। যা ধর্ষকদের রক্ষা এবং ধর্ষণের মামলায় অভিযুক্তদের বিচার ও শাস্তি পাওয়ার পরিবর্তে বেকসুর খালাস পাওয়ার সুযোগ তৈরী করে দিচ্ছে।
তিনি অবিলম্বে ভিক্তিমের মেডিকেল রিপোর্ট সংগ্রহ ও পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্ষণের ক্ষেত্রে মেডিকেল রিপোর্টের উপর সেনা-শাসকগোষ্ঠীর গোপন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার দাবি জানান।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।