খাগড়াছড়ির স্বনির্ভর হত্যাকাণ্ডের ৬ বছর : এখনো গ্রেফতার হয়নি খুনিরা

0
স্বনির্ভরে সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহতরা। ফাইল ছবি

খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
রবিবার, ১৮ আগস্ট ২০২৪

আজ ১৮ আগস্ট ২০২৪ খাগড়াছড়ি জেলা সদরের স্বনির্ভর বাজারে সেনা মদদপুষ্ট সন্ত্রাসী কর্তৃক প্রকাশ্যে দিবালোকে সংঘটিত নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ৬ বছর পূর্ণ হলেও খুনিরা এখনো গ্রেফতার হয়নি, তারা এখনো সেনা-প্রশাসনের আশ্রয়-প্রশ্রয় রয়েছে। ফলে জনমনে বিরাট প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে ‍এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্ত্রাসীদের কেন এখনো গ্রেফতার করা হচ্ছে না, কেন তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে?

২০১৮ সালের ১৮ আগস্ট সকাল ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে সেনা মদদপুষ্ট সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা এই নির্মম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে। এতে ইউপিডিএফের সহযোগী সংগঠন পিসিপি ও যুব ফোরামের তিন নেতাসহ ৭ জন নিহত হন।

ঘটনাস্থল স্বনির্ভর বাজার প্রশাসনের নিয়মিত নজরদারির একটি এলাকা। সেখানে রয়েছে একটি পুলিশ পোষ্ট। আর কয়েক গজ দূরত্বে রয়েছে বিজিবি সেক্টর হেডকোয়ার্টারের তল্লাশি চৌকি। এছাড়া প্রতিনিয়ত নানা গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারিতো রয়েছেই। 

প্রশাসনের এমন নিরাপত্তা বেষ্টনি ও নজরদারির মধ্যেই সেদিন প্রকাশ্য দিবালোকে ইউপিডিএফের সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী ও পথচারীদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায় ভারী অস্ত্রে সজ্জিত সেনা মদদপুষ্ট একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী। যাদেরকে জেএসএস এমএন লারমা (সংস্কার নামে পরিচিত) ও নব্যমুখোশ এর সদস্য বলেই প্রত্যক্ষদর্শী এলাকার লোকজন চিহ্নিত করেন। সন্ত্রাসীরা শহরের মহাজন পাড়া থেকে চেঙ্গী স্কোয়ার হয়ে ব্যাটারি চালিত অটোরিক্সায় (টমটম) করে এসে এ বর্বর হামলা চালায়। কিন্তু ঘটনার সময় পুলিশ ছিল নিরব দর্শকের ভূমিকায়।

স্বনির্ভর বাজারে সংঘটিত এ হামলায় ঘটনাস্থলে ৬ জন নিহত হন। নিহতরা হলেন- পিসিপি নেতা তপন চাকমা, এল্টন চাকমা ও যুব ফোরাম নেতা পলাশ চাকমা এবং তিন পথচারী উত্তর খবংপুজ্জে গ্রামের বাসিন্দা-মহালছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য সহকারী জিতায়ন চাকমা ও একই গ্রামের ছাত্র রুপম চাকমা এবং পানছড়ি এলাকার বাসিন্দা প্রকৌশলী ধীরাজ চাকমা। এতে আরো বেশ কয়েকজন আহত হন।


সন্ত্রাসীরা প্রায় আধ ঘন্টার মত সশস্ত্র তাণ্ডব চালালেও ঘটনাস্থলের কাছে থাকা পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়নি। উপরন্তু তারা সন্ত্রাসীদের নির্বিঘ্নে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা প্রদান করে।

স্বনির্ভর ঘটনার ঘন্টা দুয়েক যেতে না যেতেই সন্ত্রাসীরা আবারো পেরাছড়া এলাকায় বিক্ষোভরত জনসাধারণের ওপর হামলা চালায়। এতে আহত হয়ে ৭০ বছরের বৃদ্ধ শান কুমার চাকমা হাসপাতালে মারা যান এবং নারীসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। এ নিয়ে সেদিন নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭ জনে।

অভিযোগ রয়েছে, সেনাবাহিনীর খাগড়াছড়ি ব্রিগেডের তৎকালীন ব্রিগেড কমাণ্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদ এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। তার মদদেই সন্ত্রাসীরা সেদিন নৃশংস হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত করেছিল।

এ নৃশংস ঘটনার আজ ৬ বছর পূর্ণ হলেও রহস্যজনক কারণে খুনিরা রয়েছে এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। যদিও খুনি-সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায় প্রশাসনের নাকের ডগায় এবং সেনা-প্রশাসনের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থেকে তারা অবাধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।

উক্ত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশ ভুক্তভোগীদের পক্ষে থেকে মামলা নেয়নি। কিন্তু খুনিদের বাঁচাতে তারা নিজেরাই বাদী হয়ে অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি দেখিয়ে তড়িঘড়ি করে থানায় একটি মামলা দায়ের করে। ‍মুলত হামলার মূল হোতাদের আড়াল করাই ছিল পুলিশের এই মামলার উদ্দেশ্য।

পরে পরিবার ও সংগঠনের পক্ষে আদালতে পৃথক দু’টি মামলা দায়ের করা হলেও সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারে পুলিশের কোন তৎপরতা আজ পর্যন্ত লক্ষ্য করা যায়নি। ফলত সন্ত্রাসীরা এখনো বীরদর্পে অপরাধ কর্ম চালিয়ে যাচ্ছে।

উক্ত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আবু ইউসুফ আলীকে প্রধান করে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। যদিও তিন সংগঠন (পিসিপি, যুব ফোরাম, হিল উইমেন্স ফেডারেশন) এই তদন্ত কমিটিকে প্রত্যাখ্যান করে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়েছিল। প্রশাসনের গঠিত এই তদন্ত কমিটি আজ পর্যন্ত কোন প্রতিবেদন দিয়েছে কিনা তা জানা যায়নি।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের একটি তদন্ত দলও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। কিন্তু তারাও আজ পর্যন্ত কোন প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি।

ঘটনাটির অধিকতর তদন্তের জন্য চট্টগ্রাম পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)-কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে জানা গেলেও পুলিশের এই সংস্থাটিকেও সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারে কোনরূপ কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।

এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে দেশে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হলে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ শাসন করছে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতির তেমন কোন পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। আগের মতোই সেনাশাসন বলবৎ রয়েছে। স্বনির্ভর হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার না করে এখনো সেনাবাহিনীর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে রাখা হয়েছে।

ফলে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে, এই খুনিরা কী এভাবেই পার পেয়ে যাবে? তাদের কী কোন বিচার হবে না? সরকার-প্রশাসন কেন খুনিদের গ্রেফতার না করে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে?  তাহলে কী এই হত্যাকাণ্ডের সাথে রাষ্ট্রের সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে?

এদিকে, ‘রক্তাক্ত জুলাই ২০২৪’ ও ‘স্বনির্ভর হত্যাকাণ্ড ২০১৮’-এ নিহত আবু সাঈদ-মুগ্ধ, তপন-এল্টন-পলাশসহ ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলে নিহত সকল শহীদদের সন্মানে আজ খাগড়াছড়িসহ বিভিন্ন স্থানে স্মরণসভা ও প্রদীপ প্রজ্বলন কর্মসূচি রয়েছে বলে জানা গেছে। 



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More