খাগড়াছড়িতে নারী নির্যাতন বিরোধী বিশাল সমাবেশ : পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন বেগবান করার আহ্বান
খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি, সিএইচটিনিউজ.কম
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি নারীদের লড়াকু সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের উদ্যোগে খাগড়াছড়িতে নারী নির্যাতন বিরোধী বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সমাবেশ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠা, নারী অধিকার, ভূমি অধিকারসহ সহ পাহাড়ি জনগণের বেঁচে থাকার ন্যুনতম অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন বেগবান করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
আজ ২০ নভেম্বর, রবিবার সকাল সাড়ে ১০টায় খাগড়াছড়ি জেলা সদরের স্বনির্ভর মাঠে অনুষ্ঠিত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি সোনালী চাকমা। এতে অন্যান্যের মধ্যে আরো বক্তব্য রাখেন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-এর খাগড়াছড়ি জেলা ইউনিটের প্রধান সংগঠক প্রদীপন খীসা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মাইকেল চাকমা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি ক্যহাচিং মারমা, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের পূর্ব-৩ এর সদস্য সচিব এ্যাড. আমির আব্বাস তাপু, ল্যাম্প পোষ্টের সম্পাদক নাহিদ সুলতানা লিসা, জাতীয় গণতান্ত্রিক গণমঞ্চের চট্টগ্রাম জেলা সদস্য নুসরাত জাহান ছোটন, খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান নিরাপদ তালুকদার, ৪নং পেরাছড়া ইউনিয়নের সংরতি আসনের মেম্বার সাকিমা ত্রিপুরা, সাজেক নারী সমাজের সদস্য সচিব নিরূপা চাকমা ও ঘিলাছড়ি নারী সমাজের সদস্য কাজলী ত্রিপুরা। এছাড়া নির্যাতিতদের পক্ষ থেকে রোজিনা ত্রিপুরা সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। সমাবেশে স্বাগত বক্তব্য রাখেন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক রীনা দেওয়ান ও পরিচালনা করেন সাধারণ সম্পাদক কণিকা দেওয়ান। সমাবেশে তিন সহস্রাধিক নারী অংশগ্রহণ করেন।
বক্তারা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা দেশে নারীদের ওপর যৌন হামলা-নিপীড়ন দিন দিন বেড়ে চলেছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে আজ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে কমপে ২১ জন পাহাড়ি নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের পর খুন করা হয়েছে ৩ জনকে। এ ছাড়া ধর্ষণ প্রচেষ্টার শিকার হয়েছেন ৮ জন। ধর্ষিতাদের মধ্যে ৪ বছরের শিশু থেকে ৭০ বছরের বৃদ্ধা এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী রয়েছেন। প্রধানত পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে আসা সেটলার ও সেনা সদস্যরা এ সব ধর্ষণ ও ধর্ষণ-প্রচেষ্টার সাথে জড়িত রয়েছে। একইভাবে সমতলেও প্রতিনিয়ত নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেই চলেছে।
বক্তারা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, পাহাড়ি নারীদের জন্য পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম আজ যেন এক উন্মুক্ত বন্দীশালা। তাদের জীবনে কোন নিরাপত্তা নেই। ঘরে-বাইরে, বনে-জঙ্গলে জুম ঘরে কর্মস্থলে কোথাও তারা নিরাপদ নয়। তারা নিরাপদে বাড়িতে একা থাকতে পারে না, স্কুলে যেতে পারে না,ক্ষেতে খামারে কাজ করতে পারে না, মাঠে গরু চড়াতে পারে না, বন থেকে লাকড়ি আনতে পারে না, কুয়ো থেকে পানি আনতে পারে না, বিহারে মন্দিরে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যেতে পারে না –– সবখানে ওঁৎ পেতে রয়েছে মানুষরূপী নরপশুরা।
বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে হানাদার পাক বাহিনী যেভাবে নারী ধর্ষণকে স্বাধীনতাকামী বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিল, বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীও বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে তাই করছে। পার্বত্য চুক্তির আগে সেনা সদস্যরাই ধর্ষণের “দায়িত্ব” পালন করতো। এখন সেই “দায়িত্ব” সেটলারদের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। এ কারণে চুক্তির পরও নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা থেমে নেই। ইদানিং পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি নারীরাও যৌন হামলার শিকার হচ্ছেন। সমতলের নারীদের মতো তারাও ঘরের বাইরে নিরাপদ নন। এ দিক দিয়ে পাহাড়ি ও বাঙালি নারীদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। বক্তারা নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পাহাড়ি ও বাঙালি নারীদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
বক্তারা অভিযোগ করে বলেন, ধর্ষণসহ নারী নির্যাতনের জন্য দায়ি কোন সেনা কর্মকর্তা, সদস্য ও সেটলারকে আজ পর্যন্ত শাস্তি দেয়া হয়নি। ১৯৯৬ সালে অপহৃত ও নিখোঁজ হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী কল্পনা চাকমার অপহরণকারী লেঃ ফেরদৌস ও তার দোসরদের আজও বিচার করা হয়নি। তদন্ত রিপোর্টও আলোর মুখ দেখেনি। পাহাড়ি নারীদের ওপর যৌন নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো অপরাধীদের শাস্তি না হওয়া, অপরাধ করেও বিচারের সম্মুখীন না হওয়া।
বক্তারা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে যারা পাহাড়ি নারীদের ওপর যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তথা নারী অধিকারের পে কথা বলতে চায় তাদের কণ্ঠ রোধ করার জন্য সরকার ও সেনাবাহিনী উঠে পড়ে লেগে যায়। নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর সেনাবাহিনীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কারণেই কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করা হয়েছিল। গত ২০১০ সালের ২৯ আগস্ট নান্যাচর জোনের সেনারা হিল উইমেন্স ফেডারেশন রাঙামাটি জেলা শাখার আহ্বায়ক যুথিকা চাকমা ও সদস্য রত্না চাকমাকে গ্রেফতার করে হাতে অস্ত্র গুঁজে দিয়ে জেলে পাঠায়। এছাড়া ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদ করায় সংগঠনের সভাপতি সোনালী চাকমা, সাধারণ সম্পাদক কণিকা দেওয়ান, ও দপ্তর সম্পাদক চন্দনী চাকমার বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু এরপরও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলনকে স্তব্ধ করা যায়নি। শত বাধা বিপত্তি ষড়যন্ত্র মামলা হুমকী সত্বেও আমাদের সংগঠন আপোষহীনভাবে তার লড়াই চালিয়ে যেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
বক্তারা দৃপ্ত কণ্ঠে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি নারীরা তাদের ওপর নির্যাতন কখনোই নীরবে সহ্য করেনি। কল্পনা চাকমার অপহরণের প্রতিবাদে সে সময় ব্যাপক প্রতিবাদ হয়েছিল। ২০০৯ সালে রাঙামাটির ঘিলাছড়িতে যমুনা চাকমাকে ধর্ষণ প্রচেষ্টার প্রতিবাদে পাহাড়ি নারীরা গর্জে উঠেছিলেন। হাজার হাজার নারী সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। তাদের সেই আন্দোলন বৃথা যায়নি। সেনা কর্তৃপক্ষ তাদের দাবি মানতে বাধ্য হয়েছিল।
বক্তারা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠা, নারী অধিকার, ভূমি অধিকার সহ পাহাড়ি জনগণের বেঁচে থাকার ন্যুনতম অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের কোন বিকল্প নেই। তাই পূর্ণস্বায়ত্তশাসন আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য বক্তারা নারী সমাজ সহ সকলের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।
বক্তারা পার্বত্য চট্টগামে চলমান ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বলেন, এই সংঘাতে ইতিমধ্যে পার্বত্য চট্টগামে বহু রক্ত ঝরেছে। বহু প্রাণ য় হয়েছে। তাই আর সংঘাত নয়, ঐক্যবদ্ধভাবে অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে বেগবান করতে হবে।
বক্তারা বলেন, ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধ ও ঐক্য-সমঝোতার দাবিতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ইতিমধ্যে সারা পার্বত্য চট্টগ্রামে গণবিােভ ও গণপ্রার্থনার আয়োজন করেছে। ইউপিডিএফও বহু আগে থেকে ঐক্য সমঝোতার প্রস্তাব দিয়ে আসছে। এমনকি চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে জেএসএসকে পূর্ণ সমর্থন দেয়ার কথাও বলেছে। জনগণের এই ঐক্য সমঝোতার আকাঙ্ক্ষার প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করে বক্তারা সন্তু লারমার উদ্দেশ্যে বলেন, আর ভাইয়ের বুকে গুলি চালাবেন না। সরকারের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে এসে অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সাথে যুক্ত হোন। জনগণের দাবি ও আকাঙ্ক্ষার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে অবিলম্বে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধ করুন।
সমাবেশ থেকে বক্তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্ষণসহ নারী নির্যাতন বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং নারী নির্যাতনের সাথে জড়িত সকল সেনা অফিসার, সদস্য ও সেটলারদের বিচার, যৌন সহিংসতার শিকার নারীদের (পাহাড়ি ও বাঙালি) যথোপযুক্ত তিপূরণের ব্যবস্থা সহ তাদেরকে সামাজিকভাবে পুনর্বাসন করা, কল্পনা চাকমা অপহরণ তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ ও চিহ্নিত অপহরণকারী লেঃ ফেরদৌস ও তার সহযোগীদের বিচার করা, সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহার ও সেটলারদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে পুনর্বাসন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথাগত ভূমি অধিকারসহ পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের জোর দাবি জানান।