মতামত
গুইমারায় রামসু বাজারে হামলা সুগভীর ষড়যন্ত্রের অংশ

রামসু বাজারের পোড়া ক্ষত।
অংসাচিং মারমা, মিল্টন চাকমা ও আইচুক ত্রিপুরা
খাগড়াছড়ি জেলার গুইমারা বাজার থেকে আনুমানিক মাত্র আধা কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে মারমা অধ্যুষিত রামসু বাজার। ১৯৯১ সালে বটতলা নামক গ্রাম থেকে রামসু মারমা এক ব্যক্তি প্রথম সেখানে একটি চায়ের দোকান দিয়েছিলেন। তখন ছাত্র-ছাত্রীরা গুইমারা স্কুলে আসা যাওয়ার সময় তার দোকানে বিশ্রাম নিত।
এরপর তাকে দেখে তার দোকানের পাশে মংরে মারমা নামে আরও একজন চায়ের দোকান খোলেন। এভাবে একের পর এক দোকান হলে ক্রমে সেখানে একটি বাজার গড়ে ওঠে। আর বাজারটি প্রথম যিনি চায়ের দোকান দিয়েছিলেন সেই রামসু মারমার নামেই হয়ে যায়।
পুড়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সেখানে পাহাড়িদের (মারমা) ৫৩টি দোকান ছিল। হলুদের গোডাউনসহ বাঙালিদের দোকান ৮টি। এসব দোকানে কাপড়-চোপড়, ঔষধ, সার, সবজি, শুটকি, কসমেটিক সবই বিক্রি হতো। সেলুন, মোটর সাইকেল মেরামত ও কম্পিউটার কম্পোজের দোকানও ছিল। আর ছিল চা, খাবার ও মুদির দোকান। এসবই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এমনকি সেখানে শাকসবজি ও তরিতরকারী রাখার জন্য একটি হিমাগারও রয়েছে। সেটা অবশ্য পুড়িয়ে দেয়া হয়নি।
গুইমারা বাজারের একেবারে কাছে হওয়ায় রামসু বাজারটি অনেক ব্যবসায়ীর ঈর্ষার কারণ হয়ে উঠেছিল। এই বর্ধিঞ্চু বাজারটিকে তারা প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করত। কারণ আশেপাশের অনেক পাহাড়ি গ্রামের লোকজন তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস এই বাজার থেকে সংগ্রহ করতে পারত। তাদের গুইমারা বাজারে যাওয়া লাগত না।
অপরদিকে গুইমারা সেনা ব্রিগেডের একেবারে কাছে পাহাড়িদের একটি বাজারকে সেনারা ভালো চোখে দেখত না। তারা “নিরাপত্তার” কারণে তাদের ক্যাম্পের চারপাশে কেবল বাঙালিদের বসতি রাখতে চায়। এ কারণে রামসু বাজারটি এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী ও সেনাদের চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়ায়। তারা মারমা অধ্যুষিত এই বাজারটি ধ্বংস করে দেয়ার জন্য ষড়যন্ত্র শুরু করে। ২৮ সেপ্টেম্বর সড়ক অবরোধের দিনটিকে তারা হামলার মোক্ষম সময় বলে ধরে নেয়।
রামসু বাজারকে টার্গেট করার উদ্দেশ্য হলো: প্রথমত, গুইমারায় উঠতি মারমা ব্যবসায়ীদের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়া। দুই, রামেসু বাজারকে গুইমারা বাজারের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠাকে রোধ করা। তিন, রামেসু বাজার ও তার আশেপাশের এলাকা থেকে মারমাদের উচ্ছেদ করে তাদের জমিজমা দখল করা এবং এভাবে এলাকাটিকে একটি বাঙালি মুসলিম সেটলার অধ্যুষিত এলাকায় পরিণত করা। চার, গুইমারা ব্রিগেডের “নিরাপত্তা ঝুঁকি” কমানো।

রামসু বাজার এলাকায় পুড়ে যাওয়া একটি বাড়ির চিত্র।
ষড়যন্ত্রকারী-হামলাকারীরা মনে করেছিল হামলার দায় ইউপিডিএফের ওপর চাপিয়ে দিয়ে তাদের অপরাধ আড়াল করা সম্ভব হবে এবং সড়ক অবরোধের সময় আক্রান্ত হওয়ার কারণে এলাকার পাহাড়িরা অর্থাৎ মারমারা ইউপিডিএফের বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠবে বা তাদের বিপক্ষে চলে যাবে। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারী সেনা সেটলারদের সেই ধারণা ছিল সম্পূর্ণ ভুল, জনগণ তাদের ইচ্ছা পূরণ করেনি। বরং হামলার পর এলাকার মারমা, ত্রিপুরা ও চাকমারাসহ সবাই স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে যে, বাঁচার জন্য নিজস্ব পার্টি ও সংগঠনের কোন বিকল্প নেই। আর ইউপিডিএফ-ই হলো তাদের নিজেদের পার্টি। একমাত্র এই পার্টিই জনগণের স্বার্থ ও অধিকারের জন্য বিরামহীন এবং আন্তরিকভাবে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
সাধারণ জনগণের কাছে এখন অনেক দালাল সংগঠনের মুখোশও খুলে পড়েছে। এই সংগঠনগুলো কখনো আওয়ামী লীগের আবার কখনো বিএনপির দালালি করেছে, এখনও করছে। সামান্য কিছু টাকা বা সুবিধা পেয়ে এরা নিজেদের জাতীয় স্বার্থ বিকিয়ে দেয় এবং বিএনপি ও আওয়ামী লীগের স্বার্থ উদ্ধার করে দেয়। কিন্তু জনগণের বিপদের সময় তাদের দেখা মেলে না। যেমন এখন রামেসু বাজারের মানুষদের দুঃসময়ে তাদেরকে জনগণ পাশে পাচ্ছে না। জনগণের এই দুর্দিনে একমাত্র যে পার্টি বিশ্বস্ত বন্ধুর মতো তাদের পাশে রয়েছে সে হলো ইউপিডিএফ।
বলা বাহুল্য, ইউপিডিএফের এই জনস্বার্থের পাহারাদারের ভূমিকার কারণেই সেনা-শাসকগোষ্ঠী পার্টির ওপর এত উগ্রভাবে আক্রোশ প্রকাশ করে থাকে। ইউপিডিএফের বাধার কারণেই তারা তাদের পাহাড়ি স্বার্থ বিরোধী ঘৃণ্য এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে পারছে না।
সঠিক নেতৃত্ব ছাড়া কোন আন্দোলন সফল হয় না, কোন নিপীড়িত জাতি মুক্তি বা অধিকার পেতে পারে না। সেনা-শাসকগোষ্ঠী এই সত্য খুব ভালোভাবে জানে। সে কারণে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম বা পাহাড়ি জনগণকে নেতৃত্বহীন করতে চায়। শরীর থেকে মাথা কেটে দিলে যেমন কোন মানুষ বা প্রাণী বাঁচতে পারে না, তেমনি কোন জাতির নেতৃত্ব বা পার্টিকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করা গেলে সেই জাতিও টেকে না। এই কারণে শাসকগোষ্ঠী ইউপিডিএফকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়। বিচ্ছিন্ন করার অনেক কৌশলের মধ্যে দু’টি হলো পার্টির বিরুদ্ধে দমনপীড়ন ও অপপ্রচার চালানো। যাতে জনগণ প্রকাশ্যে পার্টিকে সমর্থন করতে ভয় পায় এবং এভাবে পার্টিকে সাধারণ জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায়। কিন্তু শাসকগোষ্ঠীর পাহাড়ি বিরোধী ষড়যন্ত্র ও কর্মকাণ্ড পার্টিকে বরং জনগণের আরো কাছাকাছি নিয়ে যায়। তারা ক্রমে দেখতে পায় একটি সংগ্রামী পার্টি ছাড়া তাদের অধিকার নিয়ে বাঁচার আর কোন উপায় নেই।
রামসু বাজারের হামলার পর পাহাড়ি জনগণ বুঝেছে বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রামে কেউ নিরাপদ নয়। ২৮ সেপ্টেম্বরের হামলার আগের দিনও নিশ্চয়ই রামসু বাজারের পাহাড়ি মানুষ ভেবেছিল তারা “ভালো” ছিলেন। তারা কি ঘুর্ণাক্ষরেও মনে করেছিলেন তাদের ওপর হামলা হবে? আজ যারা মনে করছেন তারা “ভালো” আছেন, তাদেরও বোধোদয় হওয়া উচিত। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যেক পাহাড়িকে বুঝতে হবে, সংগ্রাম ছাড়া উপায় নেই। এই কথা বলার পর অনেকে বর্তমান আন্তঃজুম্ম সংঘাত ও অনৈক্যের প্রসঙ্গ তুলবেন। তাদেরকে বলতে চাই, কাজ বা দায়িত্ব ফাঁকি দেয়ার জন্য অলস অকর্মণ্য লোকের অজুহাতের অভাব হয় না। যে সংঘাত ও অনৈক্যের অজুহাতে নিজের জাতীয় দায়িত্ব পালন করতে চায় না, বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে চায় না, নিজের অধিকারের জন্য লড়াই করতে চায় না, সে আসলে শত্রুকেই লাভবান করে। কথাটা কড়া হলেও, না বললেই নয়, সেজন্য বলতে হলো।
শেষে বলতে চাই, ষড়যন্ত্রকারী সেনা-সেটলারের আগুনে রামসু বাজার পুড়ে ছাই হয়েছে সত্য, কিন্তু সেই ছাই সার হয়ে পাহাড়িদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনকে পরিপুষ্ঠ ও বলবান করেছে। ইউপিডিফের নেতৃত্বে পাহাড়ি জাতিগুলোর মুক্তি আসবেই। এই বিশ্বাস সবার রাখা উচিত।
এই সত্যটি সেনা শাসকগোষ্ঠী আগাম জেনে গেছে। সেজন্য তারা ইউপিডিএফকে ভয় পাচ্ছে। তারা যে ইউপিডিএফকে ভয় পায় তা তাদের বক্তব্যে ও কাজকর্মে স্পষ্ট বোঝা যায়। তারা এখন সবাইকে ইউপিডিএফ মনে করে। সব আন্দোলনে তারা ইউপিডিএফের গন্ধ পায়। গত ২৭ বছরের আন্দোলনে এটাই ইউপিডিএফের সবচেয়ে বড় অর্জন।
শত দমনপীড়ন সত্ত্বেও ইউপিডিএফ অন্যায়ের কাছে কখনও মাথা নত করবে না। আপনিও মাথা নত করবেন না। আপনি যদি অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করেন, যারা অন্যায়কারী তারাই আপনার কাছে একদিন মাথা নত করতে বাধ্য হবে।
(২ অক্টোবর ২০২৫)
* লেখকগণ: ইউপিডিএফ সংগঠক
** লেখাটি ইউপিডিএফের ওয়েবসাইট (www.updfcht.com) থেকে সংগৃহিত।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।