গুইমারায় সেনা-সেটলার হামলা: নিহত ৩, আহত ৩০, অগ্নিসংযোগে ব্যাপক ক্ষতি

0
সেটলার বাঙালিরা অগ্নিসংযাগ করে রামেসু বাজারটি পুড়িয়ে দেয়। 

সিএইচটি নিউজ ডেস্ক
সোমবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলার রামেসু পাড়ায় সেনাবাহিনী ও সেটলারদের হামলায় ৩ জন পাহাড়ি নিহত ও অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন। এছাড়া সেটলারদের অগ্নিসংযোগের ফলে রামেসু বাজার ও আশেপাশের বেশ কিছু বসতবাড়ি সম্পূর্ণ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

গতকাল রবিবার (২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫) দুপুরের দিকে জুম্ম ছাত্র জনতার আহ্বানে শান্তিপূর্ণ অবরোধ পালনকালে বিনা উস্কানিতে এ হামলার ঘটনাটি ঘটে।

খাগড়াছড়ি পৌরসভার সিঙ্গিনালায় এক মারমা কিশোরীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণে জড়িত সকলকে গ্রেফতার-শাস্তির দাবিতে এবং খাগড়াছড়ি সদরে সেটলার হামলার প্রতিবাদে জুম্ম ছাত্র জনতার আহ্বানে তারা এই অবরোধ কর্মসূচি পালন করছিল।

জানা যায়, খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলার রামেসু বাজার এলাকায় অবরোধ পালনকালে সেনাবাহিনী ও সেটলার বাঙালিরা অবরোধপালনকারী ছাত্র-জনতার ওপর হামলা, গুলি বর্ষণ এবং বাজারের দোকানপাট ও ঘরবাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে।

সেনা-সেটলারদের সাথে সেনাসৃষ্ট ঠ্যাঙাড়ে ‌‌‘মোত্তালেব’ বাহিনীর সন্ত্রাসীরাও হামলায় যোগ দেয় এবং ছাত্র-জনতার ওপর গুলি বর্ষণ করে বলে অভিযোগ রয়েছে।

হামলায় সেনা-সন্ত্রাসীদের গুলিতে ৩ জন ঘটনাস্থলে নিহত হন এবং ৩ জন নারীসহ অন্তত ৩০ জন আহত হন, যাদের অনেকের জখম গুরুতর বলে জানা গেছে।

নিহত তিন জনের পরিচয় জানা গেছে। তারা হলেন- ১. থোয়াইচিং মারমা (২৫), পিতা- হ্লাচাই মারমা, গ্রাম- বটতলা পাড়া, হাফছড়ি, গুইমারা, তিনি পেশায় একজন ড্রাইভার; ২. আখ্র মারমা (২৪), পিতা- আপ্রু মারমা, গ্রাম -সাইংগুলি পাড়া, বড়পিলাক, গুইমারা; এবং ৩. আথুইপ্রু মারমা (২৬), পিতা- নাম থোয়াইহ্লাঅং মারমা, গ্রাম লিচু বাগান, হাফছড়ি, গুইমারা।

আহতদের মধ্যে অনেকে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন, তাদের ১ জনকে সেখান থেকে চট্টগ্রামে রেফার করা হয়েছে। এছাড়া আহতদের অনেকে ভয়ে হাসপাতালে না গিয়ে এলাকায় চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে জানা গেছে। আহতদের তালিকায় একজন মানসিক প্রতিবন্ধী নারীও রয়েছেন।

সেনা সদস্যদের উপস্থিতিতে সেটলাররা রামেসু বাজারটি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এতে কয়েক কোটি টাকার ক্ষয়-ক্ষতি হয়।

সেনাবাহিনীর গুলিতে আহত মানসিক প্রতিবন্ধী নারী আনুমা মারমা (২১)।


ঘটনার সূত্রপাত

গত ২৭ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি জেলায় দিনব্যাপী অবরোধ পালনকালে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা পরিষদ এলাকায় অবরোধকারী ছাত্র-জনতার ওপর সেটলাররা হামলা করলে উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থতিতে প্রশাসন দুপুর ২টা থেকে খাগড়াছড়ি পৌরসভা ও উপজেলা জুড়ে ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু এর মধ্যেও সেটলাররা মহাজন পাড়া ও পানখাইয়া পাড়ার য়ংড বৌদ্ধ বিহার এলাকায় পাহাড়িদের ওপর হামলা ও দোকানপাটে ভাঙচুর চালায়। তিন পাহাড়ি যুবককের কুপিয়ে জখম করে।

এদিন গুইমারা উপজেলা প্রশাসনও ১৪৪ ধারা জারি করে, যদিও সেখাানে কোন ঘটনা ঘটেনি।

খাগড়াছড়ি সদরে হামলার পরিপ্রেক্ষিতে জুম্ম ছাত্র জনতা পূর্বের দাবি কিশোরী ধর্ষকদের গ্রেফতার-শাস্তির দাবিতে ও হামলার প্রতিবাদে ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে লাগতার সড়ক অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করে।

এরপর গতকাল (২৮ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকে এলাকার ছাত্র জনতা গুইমারার রামেসু বাজার এলাকায় গুইমারা টাউনহলের সামনের সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে ও গাছের গুড়ি ফেলে অবরোধ কর্মসূচি শুরু করে। তারা সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে অবরোধ পালন করলেও দুপুরের দিকে সেনাবাহিনীর একটি দল সেখানে গিয়ে অবরোধপালনকারীদের সাথে কথা বলেন।  সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত একটি ভিডিওতে সেনাদেরকে অবরোধকারীদের বলতে শোনা যায়, ইতোমধ্যে একজন ধর্ষককে গ্রেফতার করে রিমাণ্ডে নেওয়া হয়েছে। বাকী ধর্ষকদের ধরতে একটু সময় লাগবে। তারা তাদেরকে ১৪৪ ধারা জারির কথা জানিয়ে সড়ক থেকে সরিয়ে যেতে বলে। তখন ছাত্র জনতা ধর্ষকদের গ্রেফতার ও খাগড়াছড়ি সদরে হামলার বিষয়ে তাদেরকে বলেন এবং অবরোধ বহাল রাখেন। এ বিষয়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরে তাদের মধ্যে বাগবিতণ্ডা চলে।

এক পর্যায়ে সেনাবাহিনীর সদস্যরা এগিয়ে এসে ছাত্র জনতার মাঝে ঢুকে পড়ে লাঠিচার্জ শুরু করে। এতে ছাত্র জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। এমতাবস্থায় বিক্ষুব্ধ ছাত্র জনতা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলে পরে সেখাানে সেটলার ও সেনা সৃষ্ট ঠ্যাঙাড়ে মোত্তালেব বাহিনীর একটি সশস্ত্র দল সেখানে এসে উপস্থিত হয়। সাথে সাথে সেটলাররা রামেসু বাজারের দোকানপাটে আগুন ধরিয়ে দিতে থাকে এবং সেনাবাহিনী ও ঠ্যাঙাড়েরা ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে একে একে লোকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হতে থাকেন। এ সময় এক ভয়ানক অবস্থার সৃষ্টি হয়। অনেকে যে যেদিকে পারে নিজেকে রক্ষা করতে সরে যেতে থাকে। অনেকে আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।

সেনাবাহিনীর গুলিতে হতাহতদের কয়েকজন।


অপরদিকে সমানতালে রামেসু বাজারের দোকানপাটে আগুন দিতে থাকে সেটলাররা। একে এক পুড়ে যায় বাজারের সব দোকান ও বাজারের আশে-পাশে পাহাড়িদের বসতবাড়ি। এতে অন্তত ৫০টি দোকান ও ১৬টি বসতবাড়ি পুড়ে যায়। এছাড়া সেটলাররা বাজারে রাখা পাহাড়িদের ১৬টি মোটর সাইকেল ও ১টি মাহেন্দ্র (থ্রি হুইলার) গাড়ি পুড়িয়ে দেয়।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত ১৯ সেকেন্ডের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, সেটলাররা সেনাবাহিনীর সাথে থেকে “আল্লাহু আকবর, নারায়ে তাকবির” ধ্বনি দিচ্ছে আর সেনাবাহিনী ব্রাশ ফায়ার করছে।

হামলার পর সেনারা সরে গেলে তাদের সৃষ্ঠ ঠ্যাঙাড়ে মোত্তালেব বাহিনীর সন্ত্রাসীরা সশস্ত্র অবস্থায় রামেসু বাজারে অবস্থান নেয়। এতে নিহত-আহতদের উদ্ধার করতে বেগ পেতে হয়। পরে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসনকে অবগত করা হলে বিকালে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে এবং ৩ জনের লাশ উদ্ধার করে নিয়ে যায়।

বর্তমান পরিস্থিতি

গতকালের হামলার ঘটনার পর সেনাবাহিনীসহ আইনশঙ্খলা বাহিনী নানা তৎপরতা চালায়। তারা ড্রোন উড়িয়ে নজরদারি করে। রাতভর সেনারা রামেসু বাজার এলাকায় অবস্থান করে। আজও (সোমবার) দিনভর তারা রামেসু বাজার এলাকায় অবস্থান করেছে বলে জানা গেছে।

এখন পর্যন্ত সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা উপজেলার মোড়ে মোড়ে গাড়িযোগে টহল দিচ্ছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

এদিকে, আজ (সোমবার) বিকালে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতাল থেকে ময়নাতদন্ত শেষে নিহতদের মরদেহগুলো নিয়ে আসার কথা থাকলেও ময়নাতদন্ত শেষ না হওয়ায় এখনো মরদেহগুলো খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালের মর্গে রয়েছে বলে জানা গেছে।

প্রতিবাদ
গুইমারা ও খাগড়াছড়ি সদরে অবরোধকারী ছাত্র জনতার ওপর হামলা, গুলি করে হত্যা, অগ্নিসংযোগের প্রতিবাদে গতকাল চট্টগ্রাম, ঢাকা ও রাজশাহীতে বিক্ষোভ ও মশাল মিছিল করা হয়েছে। আজ (২৯ সেপ্টেম্বর) রাঙামাটির কাউখালীতে হিল উইমেন্স ফেডারেশন, পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘ, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম যৌথভাবে বিক্ষোভ মিছিল করেছে। এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠন, ব্যক্তি এবং শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে হামলার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবি জানিয়ে বিবৃতি প্রদান করেছে।

উল্লেখ্য, গত ২৩ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের সিঙ্গিনালায় ৮ম শ্রেণির এক পাহাড়ি শিক্ষার্থী প্রাইভেট পড়া শেষে বাড়ি যাওয়ার পথে তিন জন বাঙালি যুবক কর্তৃক সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় বলে অভিযোগ ওঠে। পরে এ ঘটনার প্রতিবাদ দেখা দিয়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনী শয়ন শীল (১৯) নামে এক যুবককে গ্রেফতার করে। তবে অভিযুক্ত বাকী দু’জনকে গ্রেফতারে পুলিশকে কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। উক্ত ঘটনার প্রতিবাাদে ও সকল অপরাধীকে গ্রেফতারের দাবিতে ‘জুম্ম ছাত্র জনতা’ নামের প্লাটফর্মের মাধ্যমে আন্দোলন চলছে। ধর্ষণ বিরোধী এ আন্দোলনে গুইমারায় উক্ত হামলা-হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটেছে, যা পার্বত্য চট্টগ্রামে এ যাবত ঘটেনি। 



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More