গুইমারায় সেনা-সেটলার হামলায় নিহত তিন বীর শহীদের সম্মানে স্মরণসভা, নতুন কর্মসূচি ঘোষণা

0


গুইমারা প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ

বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫

খাগড়াছড়ির গুইমারা রামসু বাজারে সেনা-সেটলারদের হামলায় নিহত ৩ বীর শহীদ আখ্র মারমা, শহীদ আথুইপ্রু মারমা ও শহীদ থৈইচিং মারমার সম্মানে আনুষ্ঠানিকতা পালন ও স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। স্মরণসভা থেকে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।

আনুষ্ঠানিকতা পালনের মধ্যে রয়েছে- স্মরণসভা মঞ্চে কালো পতাকা উত্তোলন, অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভে তিন শহীদের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, সাইরেন বাজিয়ে নীরবতা পালন, শপথ গ্রহণ ইত্যাদি।

আজ বুধবার (১৫ অক্টোবর ২০২৫) সকাল ১০টার সময় গুইমারার বরইতলী এলাকায় “শহীদ স্মৃতি সংরক্ষণ সংসদ” এর ব্যানারে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে গুইমারার বিভিন্ন এলাকা থেকে ১৫শ’র অধিক জনগণ স্বতঃস্ফুর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন।

স্মরণসভা ও আনুষ্ঠানিকতা পালন অনুষ্ঠানের ব্যানার শ্লোগান ছিল- “মরতে যখন শিখেছি, দুনিয়ায় কেউই আর আমাদের দমিয়ে রাখতে পারবে না”। এছাড়া মূল ব্যানারের দুই পাশে দুটি ফেস্টুনে লেখা ছিল “জান দেবো, মা-বোনের সম্ভ্রমহানি বরদাস্ত করবো না, রক্ত যখন দিয়েছি আরো দেবো, পাহাড় মুক্ত করে ছাড়বো।”

স্মরণসভা শুরুর পূর্বে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। পতাকা উত্তোলনের পরে ২৮ সেপ্টেম্বরে শহীদ হওয়া ৩ বীরের স্মরণে নির্মিত অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভে চৌকস টিমের মাধ্যমে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করা হয়।


এতে শহীদ পরিবার পক্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলী অর্পণ করেন শহীদ আথুইপ্রু মারমা’র সহধর্মিনী নুনুমা মারমা, থৈইচিং মারমার পিতা হলাচাই মারমা. জুনান চাকমার মাতা রুপসা চাকমা, রুইখই মারমার সহধর্মিনী রিতা চাকমা, রুবেল ত্রিপুরার মাতা নিরন্তাদেবী ত্রিপুরা; ছাত্র জনতা ও আন্দোলনকারীদের পক্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন রাসেল ত্রিপুরা ও বন্ধু ত্রিপুরা; এলাকাবাসীর পক্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন ক্যহ্লাচিং মারমা ও সদুঅং মারমা।

শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পন শেষে সাম্প্রতিক সময়ে নিজের বাস্তুভিটা, মা-বোনের সম্ভ্রম এবং অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে বীর শহীদদের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান জানিয়ে স্যালুট প্রদান ও সাইরেন বাজিয়ে ২ মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

শহীদদের সম্মানে দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা হচ্ছে। 

এরপর ২৮ সেপ্টেম্বর শহীদ আখ্র মারমা, শহীদ আথুইপ্রু মারমা ও শহীদ থৈইচিং মারমা প্রতি সম্মান জানিয়ে ও শহীদদের সম্মান অক্ষুন্ন রাখতে উপস্থিত সকলে মুষ্ঠিবদ্ধ হাতে শপথ নেন। শপথ বাক্য পাঠ করান স্মরণসভা আয়োজক কমিটির সদস্য ও অনুষ্ঠানের সঞ্চালক তানিমং মারমা।

স্মরণসভায় উপস্থিত জনতা মুষ্ঠিবদ্ধ হাতে শপথ গ্রহণ করছেন। 


পরে ব্যর্থ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, পার্বত্য উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা, জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমা, গুইমারা রিজিয়ন কমান্ডার জেনারেল আবুল কালাম মো. শামসুদ্দীন রানাসহ হত্যাকারী, ধর্ষক, অগ্নিসংযোগকারীদের প্রতি ক্ষোভ ও ঘৃনা প্রকাশ করে প্রতিবাদী জনতা কুশপুত্তলিকা বানিয়ে ঝাড়ুপেটা-থুতু নিক্ষেপ করে এবং কুশপুত্তলিকা পুড়িয়ে ফেলে। এছাড়া আইএসপিআরের বিবৃতি ও জেএসএস সন্তু গ্রুপের প্রতিবেদন আগুনে পুড়িয়ে প্রত্যাখ্যান করেছে বিক্ষুব্ধ জনতা।

এ সময় উপস্থিত ছাত্র-জনতার মুহুর্মুহু স্লোগানে সভাস্থল প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।

এরপর স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন ’২৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে সেনাবাহিনীর গুলিতে শহীদ হওয়া জুনান চাকমার মাতা রুপসা চাকমা ও সঞ্চালনা করেন ‘স্মরণসভা আয়োজক কমিটি’র সদস্য তানিমং মারমা।

স্মরণসভায় সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি নীতি চাকমা। এছাড়া আরো বক্তব্য দেন শহীদ আথুইপ্রু মারমার সহধর্মীনি নুনুমা মারমা, সাবেক মেম্বার সদুঅং মারমা, সাজেক কার্বারি এসোসিয়েশনের সভাপতি নতুন জয় চাকমা, রামসু বাজারে হামলায় আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্য উহ্লামে মারমা. সুধু মেম্বার, স্মরণসভা আয়োজক কমিটির শান্ত চাকমা, ক্যহলাচিং মারমা ও অনিমেষ চাকমা প্রমুখ।

বক্তব্য রাখছেন নীতি চাকমা।

স্মরণসভায় নীতি চাকমা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে বলেন, আমার মা বোন  লাঞ্ছিত হলে যখন আমরা প্রতিবাদ করি তখন সরকার-শাসকগোষ্ঠি ও তার বাহিনীগুলো আমাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে ট্যাগ লাগিয়ে দেয়, সাম্প্রদায়িক হামলা চালায়, খুন-জখম করে। গুইমারা হামলা, হত্যা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা তারই জ্বলন্ত উদাহরণ।

তিনি হামলায় জড়িত সেনা-সেটলাদের অবিলম্বে গ্রেফতারপূর্বক বিচারের দাবি জানান।

সুধু মারমা আয়োজক কমিটিকে ধন্যবাদ জানান এবং গুইমারা রামসু বাজারে ঘটনায় শাসকগোষ্ঠীর প্রতি তীব্র নিন্দা জানান। তিনি বলেন, পাহাড়ে জন্ম হয়েছে বলেই আমরা অপরাধী। গত ২৮ সেপ্টেম্বর যে তিন জন শহীদ হয়েছেন তারা বোনের ধর্ষণ ও পাহাড়ে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে জীবন দিয়েছেন। তাদেরকে আমরা কখনো ভুলে যাবো না।

হামলার শিকার হয়ে জখম হওয়া শিক্ষার্থী উহ্লাম্যে মারমা বলেন. রামসু বাজারে ঘটনার সময় তিনি বাড়িতে ছিলেন। সেনা সেটলাররা তার উপর আক্রমণে তিনি আহত হয়েছেন। তবে এখন তিনি সুস্থ আছেন বলে জানান।

স্মরণসভায় অংশগ্রহণকারীদের একাংশ।


শান্ত চাকমা বলেন, আমরা জানি যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলে ১৯৯৭ সালে একটি চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু সেই চুক্তি পাহাড়ে শান্তি আনতে পারেনি। চুক্তির পর সেনাশাসন ও সেনা ক্যাম্প আরো বাড়ানো হয়েছে। এই অসম্পূর্ণ চুক্তির ফল হিসেবে আজকে গুইমারার মতো হামলার ঘটনা ঘটছে।

তিনি গুইমারার রামসু বাজারে সংঘটিত ঘটনাকে বিকৃত করে আইএসপিআরের প্রদত্ত বক্তব্য ও জেএসএস সন্তু গ্রুপের রিপোর্ট পাহাড়ের জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে বলে মন্তব্য করেন।

অন্যান্য বক্তারা বলেন, পাহাড়ের অধিকারের প্রশ্নে এক ও অভিন্ন হয়ে লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। তারা বলেন রামসু বাজারে ঘটনায় সেনাবাহিনী যদি নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতো তাহলে হামলা, হত্যাকাণ্ড, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের মতো ঘটনা ঘটতো না। তারা ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান এবং হামলায় জড়িত সেনা সদস্য ও সেটলারদের আইনের আওতায় এনে বিচারের দাবি জানান।

শেষে স্মরণসভার সভাপতি শহীদ জুনান চাকমা মা রূপসা চাকমা পক্ষে নতুন কর্মসূচিগুলো পড়ে শোনান অনুষ্ঠানের সঞ্চালক তানিমং মারমা।

ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে:

১। ১৭ অক্টোবর বৌদ্ধ বিহার/কিয়াং-এ প্রার্থনা।

২। ১৯ অক্টোবর খাগড়াছড়ি জেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কালো ব্যাজ ধারণ। রাঙামাটি ও বান্দরবানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহেও এ কর্মসূচি পালনে আহ্বান জানানো হয়।

৩। ২১ অক্টোবর কালো পতাকা উত্তোলন। হাটবাজার, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া সংগঠনসমূহের অফিসে এই কালো পতাকা উত্তোলন কর্মসূচি পালনের আহ্বান জানানো হয়।

৪। ৩০ অক্টোবর প্রদীপ প্রজ্জ্বলন। খাগড়াছড়ি জেলা ছাড়াও রাঙামাটি, বান্দরবান, ঢাকা, চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে একযোগে এই কর্মসূচি পালনের আহ্বান জানানো হয়।

স্মরণসভার সভাপতি রূপসা চাকমা ঘোষিত কর্মসূচি স্ব স্ব উদ্যোগে পালন করার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান।

বক্তব্য রাখছেন স্মরণসভার সভাপতি শহীদ জুনান চাকমার মা রূপসা চাকমা।

স্মরণসভা থেকে ২৮ সেপ্টেম্বরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের শহীদ দিবস ঘোষণা করা হয় এবং রামসু বাজার সড়কটি তিন বীর শহীদের নামে নামকরণের ঘোষণা দেওয়া হয়।

স্মরণসভা থেকে শহীদ স্মৃতি সংরক্ষণ সংসদ নামে ৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। এতে শহীদ জুনান চাকমার মা রূপসা চাকমাকে আহ্বায়ক, শহীদ রুইখই মারমার সহধর্মীনি রিতা চাকমাকে যুগ্ম আহ্বায়ক, শহীদ আথুইপ্রু মারমার সহধর্মীনি নুনুমা মারমাকে সদস্য সচিব নির্বাচিত করা হয়। সংসদের অন্যান্য সদস্যরা হলেন- শহীদ আখ্র মারমা মা ক্রাসং মারমা, শহীদ থৈইচিং মারমার বাবা হলাচাই মারমা, শহীদ রুবেল ত্রিপুরার মা নিরন্তা দেবী ত্রিপুরা ও শহীদ গুরি চাকমার সহধর্মিনী সাধনা চাকমা।

স্মরণসভায় মঞ্চে আরো উপস্থিত ছিলেন শহীদ আক্র মারমার মাতা ম্রাসং মারমা, শহীদ থৈইচিং মারমা পিতা হ্লাচাই মারমা, শহীদ রুবেল ত্রিপুরার মাতা নিরন্তা দেবী ত্রিপুরা, শহীদ গুরি চাকমার সহধর্মিনী সাধনা চাকমা, শহীদ রুইখই মারমা’র সহধর্মিনী রিতা চাকমা, সেনা-সেটলার কর্তৃক হামলার শিকার উহ্লামে মারমার পিতা ক্যজাইহ্লা মারমা ও সাজেক গণ অধিকার রক্ষা কমিটির সদস্য বিদ্যুৎ আলো চাকমা প্রমুখ।



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More