মতামত
গুইমারা হামলা: সেনা-সেটলারের পিণ্ডি ইউপিডিএফের ঘাড়ে!

সেটলারদের লাগিয়ে দেয়া আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় গুইমরার রামসু বাজার।
মন্তব্য প্রতিবেদন
খাগড়াছড়ির গুইমারা হামলা কারা ঘটিয়েছে, কারা গুলি চালিয়েছে, তা এখন দিবালোকের মতো সবার কাছে পরিষ্কার। হামলার শিকার ব্যক্তিরাও স্পষ্টভাবে বলেছেন, সেনাবাহিনী ও ঠ্যাঙাড়ে সদস্যরই তাদের ওপর গুলি চালিয়েছে। কিন্তু তা সত্বেও সরকার ও সেনাবাহিনী হামলাকারী সেনা-সেটলারদের রক্ষার জন্য হামলার দায় ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ইউপিডিএফের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করছে। এক কথায়, গুইমারা ও খাগড়াছড়ির রিজিয়ন কমান্ডারগণ তাদের অপরাধ ঢাকার জন্য ইউপিডিএফকে বলির পাঁঠা বানাতে চাইছে। উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপাচ্ছে। যে জঘন্য অপরাধের সাথে ইউপিডিএফের সামান্যতম যোগ নেই, তাকে সেই অপরাধের জন্য দায়ি করা চরম অন্যায়। এটা কোনভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা এখন প্রকৃত হামলাকারী-অপরাধীদের গ্রেফতার না করে, বরং ইউপিডিএফের ওপর দমনপীড়ন বাড়ানোর হুমকি দিচ্ছেন। আরও নতুন সেনা ক্যাম্প স্থাপনের কথাও বলা হচ্ছে। অধিক সেনা ক্যাম্প মানে গুইমারার মতো আরও বেশি বেশি হামলা ও পাহাড়িদের ওপর দমনপীড়নের মাত্রা বৃদ্ধি ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ইতিমধ্যেই সেনা ছাউনিতে ভরে গেছে। এখানে বর্তমানে ৬টি সেনা ক্যান্টনমেন্ট ও ৫ থেকে ৬ শত সেনা ক্যাম্প রয়েছে। এছাড়া রয়েছে অসংখ্য বিজিবি, আনসার বাহিনী ও পুলিশ ক্যাম্প। প্রতি ৮ জন পাহাড়ির বিপরীতে রয়েছে একজন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য। এখন প্রশ্ন হলো, এত বিশাল নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যের উপস্থিতি সত্বেও কেন পাহাড়িদের ওপর উগ্র সেটলারদের সাম্প্রদায়িক হামলা বন্ধ হয় না? এর উত্তর হলো: পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনাবাহিনী সেটলারদের প্রতি ১০০% পক্ষপাতদুষ্ট। পাহাড়িদের নিরাপত্তা দেয়া তাদের উদ্দেশ্য নয়। তাদের উদ্দেশ্য হলো পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাহাড়ি শূন্য করা। সে কারণে রাঙ্গামাটি রিজিয়নের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ নাজমুল হক ইউপিডিএফকে দেশ থেকে বিতাড়িত করার হুমকি দিতে পারেন। ইউপিডিএফকে দেশছাড়া করা গেলে পাহাড়িরা নেতৃত্বহীন হয়ে পড়বে এবং তখন সাধারণ পাহাড়িদেরকেও দেশ ত্যাগে বাধ্য করা খুব সহজ হবে। এই হিসেব থেকে তিনি এই হুমকি দিয়ে থাকতে পারেন বলে ধারণা করা যায়।

পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনা-শাসকগোষ্ঠী এতটাই ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠেছে যে, তারা পাহাড়িদেরকে ধর্ষণের বিচার চাওয়ার অধিকার থেকেও বঞ্চিত করতে চায়। একজন সেনা সদস্য তো পাহাড়ি নারী ধর্ষণকে স্বাভাবিক ঘটনা বলেছে। কী পরিমাণ রেসিস্ট হলে এ কথা বলা যেতে পারে তা ভাবলে অবাক হতে হয়। সভ্য দেশে হলে ঐ সেনা সদস্যের তৎক্ষণাৎ চাকুরিচ্যুতিসহ অন্যান্য শাস্তি নিশ্চিত হতো। এটা বাংলাদেশ, এখানে তার শাস্তি নয়, পুরস্কারই জুটবে।
আজ পাহাড়িদের কেবল বিচার চাওয়ার অধিকার নেই তাই নয়, তাদেরকে দাবি তোলার অধিকারও দেয়া হচ্ছে না। অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন করা সংবিধান সংস্কার কমিশন ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপনকে সেনা-মদতপুষ্ট ফ্যাসিস্ট সেটলার সংগঠনগুলো বিরোধীতা করেছে, তারা ঢাকা ও রাঙ্গামাটিতে বিক্ষোভও দেখিয়েছে। আর ইউনূস সরকার তাদের দাবি মেনেও নিয়েছে।
এতকিছু সত্বেও পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী ও সেটলারদের দাপট পরিস্থিতির একটি দিক মাত্র। সেটলাররা গোটা বাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র অংশ। তাদের মধ্যেও সবাই হামলায় অংশ নেয়নি। তারা সবাই নিশ্চয়ই উগ্র ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক হবেন না। সেটলারদের উগ্র সাম্প্রদায়িক অংশটি যেভাবে অন্যায়ভাবে পাহাড়িদের ওপর হামলা চালিয়েছে সেটা যে দেশের সব বাঙালি বা সব সেটলার এমনকি সব সেনা কর্মকর্তা অনুমোদন করেন তা হতে পারে না। অনুমোদন করার কথাও নয়। সে কারণে অনেক সংগঠন ও ব্যক্তি বিশেষ (সেটলারসহ) সিঙ্গিনালার ধর্ষণ ও গুইমারা হামলার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। একজন সুস্থ বিবেকবান, ন্যায়পরায়ণ মানুষ কখনো অন্যের ওপর, অন্য জাতির বা সম্প্রদায়ের ওপর অন্যায় মেনে নিতে পারে না।
ফ্রান্সের বিরুদ্ধে আলজেরিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বিখ্যাত ফরাসী দার্শনিক ও লেখক জ্যাঁ পল সাঁত্রে আলেজেরিয়াবাসীর এই ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধকে মনেপ্রাণে সমর্থন করেছিলেন। তিনি আলজেরিয়ানদের ওপর ফরাসী সৈন্যদের বর্বর অত্যাচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। এমনকি তিনি বলেছিলেন তার যদি যুবা বয়স থাকতো তাহলে তিনি নিজ দেশ ফ্রান্সের বিরুদ্ধে আলজেরিয়ানদের হয়ে প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশ নিতেন। এজন্য ফরাসীরা তাকে গ্রেফতারের দাবি করেছিল, কিন্তু তিনি তার কথায় অবিচল থাকেন।
আশার কথা হলো, আজ বাংলাদেশেও এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়, যারা পাহাড়িদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে মনেপ্রাণে সমর্থন করেন। এমন বাঙালি ব্যক্তিত্বও আছেন, যারা পাহাড়িদের স্বাধীন হওয়ার কিংবা অন্য দেশের সাথে যুক্ত হওয়ার অধিকার রয়েছে বলে মনে করেন।
বাংলাদেশে আজ শোষিত-বঞ্চিত বাঙালি জনগণ ও নিপীড়িত পাহাড়ি জনগণের ভাগ্য একই সূত্রে গাঁথা হয়ে গেছে। নিপীড়িত পাহাড়ি জনগণকে মুক্ত না করে বাঙালি জনগণও নিজেদের মুক্তি অর্জন করতে পারবেন না। অপরদিকে বাঙালি জনগণের মুক্তি ছাড়া পাহাড়িরাও আলাদাভাবে মুক্তি অর্জনে সক্ষম হবেন না। তাই উভয়কে একসাথে লড়াই করে নিজেদের মুক্তি অর্জন করতে হবে। উভয়ের মুক্তির এটাই একমাত্র পথ।
(৩ অক্টোবর ২০২৫)
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।