প্রথাগত ভূমি অধিকারের স্বীকৃতিসহ ৯ দফা দাবি বাস্তবায়ন ও পর্যটনের নামে ভূমি বেদখল বন্ধের দাবিতে
চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের যুব মহাসমাবেশ
চট্টগ্রাম : “ভূমি কমিশনের অগণতান্ত্রিক ধারা বাতিল কর, সেটলারদের সমতলে পুনর্বাসন কর” এই দাবি সম্বলিত শ্লোগানে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথাগত ভূমি অধিকারের স্বীকৃতিসহ ৯ দফা দাবি বাস্তবায়ন ও আলুটিলায় পর্যটনের নামে ভূমি বেদখল বন্ধের দাবিতে চট্টগ্রাম নগরীতে যুব মহাসমাবেশ করেছে গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম (ডিওয়াইএফ)। এতে সমাবেশে ৭ শতাধিক যুবক -যুবতি অংশগ্রহন করেন।
আজ শুক্রবার (৩০ সেপ্টেম্বর) বেলা ৩টার দিকে চট্টগ্রাম মহানগরের শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় যুব মহাসমাবশে সভাপতিত্ব করেন গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সভাপতি অংগ্য মারমা এবং সমাবেশ সঞ্চলনা করেন কেন্দ্রীয় সাধরণ সম্পাদক জিকো ত্রিপুরা। সমাবেশ শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ডিওয়াইএফ কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক থুইক্যসিং মারমা। এছাড়া আরো বক্তব্য রাখেন, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার তথ্য প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক রূপন চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশন এর সাংগঠনিক সম্পাদক রিনা চাকমা, আলুটিলা ভূমি রক্ষা কমিটির সদস্য সাগর ত্রিপুরা। সমাবেশে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন গণসংহতি আন্দোলনের চট্টগ্রাম নগরের সমন্বয়ক হাসান মারুফ (রুমি), বাসদ মার্কসবাদী চট্টগ্রাম নগরের সমন্বয়ক অপু দাশ গুপ্ত, প্রগতিশীল ডা. ফোরামের জয়েন্ট কনভেনর ডা. সুশান্ত বড়ুয়া, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের পূর্ব-৩ অঞ্চলের সভাপতি ভূলন লাল ভৌমিক ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সাবেক সভাপতি ও ইউপিডিএফ সংগঠক মাইকেল চাকমা। এছাড়া সংহতি জানিয়ে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন এর নগর সভাপতি লোকেন দে, গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশন এর সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ারুল হক, মহানগর ত্রিপুরা কমিটির অহ্বায়ক খগেশ্বর ত্রিপুরা।
আলুটিলা ভূমি রক্ষা কমিটির সদস্য সাগর ত্রিপুরা বলেন, আলুটিলা ভূমি সমস্যা শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন নয়। সেই স্বাধীনাতার পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে জনগণকে সংখ্যালঘু করে ভূমি থেকে উচ্ছেদ করার জন্য সরকার বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করে চলেছে। আলুটিলা আমাদের প্রাণ এই ভূমি দখল করতে আসলে আমরা বসে থাকবো না। জেলা প্রশাসক এবং টিএনও আলুটিলা দেখতে গেলে নারীদের প্রতিবাদের মুখে সাদা কাগজে অলুটিলা পর্যটনের জন্য ভূাম অধিগ্রহন করা হয়নি বলে স্বাক্ষর দিয়ে যান।
যুব মহাসমাবশে গণসংহতি আন্দোলন-এর মহানগর সমন্বয়ক হাসান মারুফ রুমি বলেন, বর্তমান সরকারের এই তথাকথিত উন্নোয়ন জনগণ মানে না। সরকার সারাদেশব্যাপী উন্নয়নের নামে প্রাণ বৈচিত্র্য ধ্বংস করতে চাচ্ছে এবং পাহাড়ী জনগণকে উচ্ছেদ করতে তৎপর রয়েছে। তাই এই সরকারকে উচ্ছেদ না করে জনগণের গণতান্ত্রিক নায্য অধিকার বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।
বাসদ মার্কসবাদী চট্টগ্রাম নগরের সমন্বয়ক অপু দাশ গুপ্ত বলেন, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের ৯ দফার সাথে তাদের সংগঠন এক মত পোষণ করেন এবং এই দাবি বাস্তবয়নের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করতে হবে। আমরা সুন্দর রক্ষা, বাঁশখালীতে কয়লা বিদ্যুৎ এর জন্য জনগণের উচ্ছেদসহ সারাদেশব্যাপী জনগণের উপর অন্যায় নির্যাতন নিপীড়ণের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রাম করছি। আগামীতে পাহাড় ও সমতলে ঐক্যবদ্ধ লড়াই সংগ্রাম করতে হবে।
প্রগতিশীল ডা. ফোরাম এর জয়েন্ট কনভেনর সুশান্ত বড়–য়া বলেন, পরিস্থিতি খুব সংকটে। পার্বত্য চট্টগ্রামে আরো সংকটাপন্ন করার জন্য নতুন করে পর্যটনের নামে ভূমি বেদখলের ষড়যস্ত্র করছে। অবিলম্বে তা বন্ধ করে পাহাড়ি জনগণের নায্য স্বায়ত্তশাসন মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান।
জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের পূর্ব-৩ অঞ্চলের সভাপতি ভূলন ভৌমিক বলেন, পাকিস্তান সরকার পূর্ব বাংলার জনগণের স্বায়ত্তশান মেনে নেয়নি জনগণকে ওপর ২৫শে মার্চের গণহত্যা চাপিয়ে দিয়েছিলো। তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রামে জনগণের স্বায়ত্তশাসনের দাবি উপেক্ষা করে সরকার পাহাড়ি জনগণের উপর বাঙ্গালী জাতিয়তা চাপিয়ে দিয়েছিলো। যুবকরাই পারে যে কোন অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। পাহাড়ের যুবকদেরও পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
সমাবেশে নেতৃবৃন্দ, তিন পার্বত্য জেলাকে পর্যটন জোন ঘোষণা করার জন্য গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে নেতৃবৃন্দ এই কমিশন কতটুকু স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারবে এবং পাহাড়িদের হৃত জমি ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে সরকার কতটুকু আন্তরিক সে ব্যাপারে যথেষ্ট সংশয় প্রকাশ করেন। তাছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি সমস্যা হলো অন্যান্য সমস্যার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পর্কিত একটি রাজনৈতিক সমস্যা। এই রাজনৈতিক সমস্যাকে কেবলমাত্র আইনী প্রক্রিয়ায় ও কাঠামোর মধ্যে সমাধান করতে চাওয়া কতটুকু যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত সে ব্যাপারে তারা প্রশ্ন রাখেন।
নেতৃবৃন্দ সরকারকে অবিলম্বে যুব ফোরামের উত্থাপিত ভূমি সংক্রান্ত ৯ দফা দাবি মেনে নেয়ার আহ্বান জানান। তারা এইসব দাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ব্যাপক গণআন্দোলন গড়ে তোলার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের সকল গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল দল ও সংগঠনসহ আপামর জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।
সমাবেশে গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সভাপতি অংগ্য মারমা উক্ত ৯ দফা দাবি উত্থাপন করলে উপস্থিত জনতা তমুল করতালির মাধমে দাবিনামার পক্ষে সমর্থন জানান এবং আন্দোলন সংগ্রামের দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করেন।
সমাবেশ শেষে শহীদ মিনার থেকে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি ডিসি হিল ও প্রেস ক্লাব ঘুরে চেরাগী পাহাড়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের মাধ্যমে সমাপ্ত ঘোষণা করেন কেন্দ্রীয় সভাপতি অংগ্য মারমা।
উল্লেখ্য, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের উত্থাপিত ভূমি সংক্রান্ত ৯ দফা দাবিগুলো হচ্ছে- ১) বাংলাদেশ সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত প্রথাগত যৌথ ভূমি মালিকানার স্বীকৃতি দিতে হবে; ২) ভূমি বেদখল বন্ধ করতে হবে, বেদখলকৃত জমি ফিরিয়ে দিতে হবে এবং বেদখলকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে; ৩) পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি-বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনকে পরিপূর্ণভাবে গণতান্ত্রিক রূপ দিতে হবে। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির নামে বহিরাগতদের বৈধতা দেয়া চলবে না। সেনাশাসক জিয়াউর রহমান ও স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নিয়ে আসা বহিরাগতদেরকে দেয়া অবৈধ কবুলিয়ত বাতিল করতে হবে; ৪) পার্বত্য চট্টগ্রামকে স্বায়ত্তশাসিত এলাকা ঘোষণা পূর্বক স্থায়ী বাসিন্দাদের দ্বারা নির্বাচিত একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে হবে এবং এই প্রতিষ্ঠানের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অর্পন করতে হবে; ৫) বহিরাগতদের কাছে জমি বিক্রয়, লিজ, বন্ধক কিংবা অন্য কোন উপায়ে হস্তান্তর সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে; ইতিমধ্যে যেসব জমি এভাবে হস্তান্তরিত হয়েছে তা বাতিল করতে হবে। বান্দরবানসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে অবাসিন্দাদের কাছে সরকারের দেয়া জমির লিজ বাতিল করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের প্রকাশ্য সম্মতি ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান, উত্তোলন, আহরণ ও পাচার করা যাবে না; ৬) কাপ্তাই হ্রদ এলাকায় জলে ভাসা জমি বা ফ্রিঞ্জ ল্যান্ড চাষীদের সুবিধার্থে পানির সীমা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং পানির সীমা বৃদ্ধির নির্ধারিত ছক (রুল কার্ভ) যথাযথভাবে অনুসরণ ও এ সম্পর্কে চাষীদের অবহিত করতে হবে; ৭) সেনা, বিজিবি তথা নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প, সেনানিবাস, গ্যারিসন ইত্যাদির নির্মাণ ও সম্প্রসারণের নামে কিংবা পর্যটন, বনায়ন, শিল্প কারখানা স্থাপন ইত্যাদি অজুহাতে জমি অধিগ্রহণ বা বেদখল করা যাবে না; ৮) ভারত-প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থীদেরকে তাদের সাথে সরকারের সম্পাদিত চুক্তি মোতাবেক নিজ নিজ জমিতে যথাযথ পুনর্বাসন করতে হবে। আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদেরকেও স্ব স্ব জমি ফিরিয়ে দিয়ে ক্ষতিপূরণসহ পুনর্বাসন করতে হবে। ৯) যে সব বহিরাগত পরিবারকে পাহাড়িদের জমিতে পুনর্বাসন করা হয়েছে তাদেরকে সমতল জেলায় সম্মানজনকভাবে জীবিকার নিশ্চয়তাসহ পুনর্বাসন করতে হবে।
—————
সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।