চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পিসিপি’র নবীন বরণ, প্রবীণ বিদায় ও সংবর্ধনা অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত

চবি প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
শনিবার, ৮ নভেম্বর ২০২৫
‘এসো জুম পাহাড়ের তরুণ প্রাণ, শৃঙ্খল ভাঙার পদযাত্রায় হই আগুয়ান’ এই স্লোগানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের নবীন শিক্ষার্থীদের বরণ, ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের বিদায় ও চাকসু নির্বাচনে বিজয়ীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আজ শনিবার (৮ নভেম্বর ২০২৫) সকাল ১০:৩০ টায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদ অডিটোরিয়ামে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার উদ্যোগে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ভুবন চাকমার সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক সুদর্শন চাকমার সঞ্চালনায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালেয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইয়াহ্ইয়া আখতার, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসাইন, প্রক্টর অধ্যাপক হোসেন শহীদ সরওয়ার্দী, ইসলামিক ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক মুনমুন নেসা চৌধুরী, পিসিপির কেন্দ্রীয় সভাপতি অমল ত্রিপুরা, সহ-সাধারণ সম্পাদক সোহেল চাকমা, সাংগঠনিক সম্পাদক রোনাল চাকমা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)-এর নির্বাহী সদস্য হেমা চাকমা। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সামাজিক ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানটি পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের দলীয় সংগীত “পাহাড়ি ছাত্র-ছাত্রী দল’’ গানটি পরিবেশনার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। এরপরে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শহীদ ফরহাদ হোসেন এবং হৃদয় চন্দ্র তরুয়া, পিসিপির চবি শাখার সাবেক সভাপতি শহৗদ মিটন চাকমা, সম্প্রতি গুইমারা ও গতবছর খাগড়াছড়ি, দীঘিনালা ও রাঙামাটিতে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলায় নিহতসহ অধিকার আদায়ের আন্দোলনে আত্মউৎসর্গকারী সকল বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়ে দুই মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
অনুষ্ঠানে নবীনদের উদ্দেশ্যে মানপত্র পাঠ করেন নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থী রাভিনা চাকমা ও প্রবীণদের উদ্দেশ্যে বিদায়ী পত্র পাঠ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের শিক্ষার্থী প্রত্যাশা চাকমা। চাকসু হল সংসদ নির্বাচনে বিজয়ীদের জন্য অভিনন্দন পত্র পাঠ করেন পিসিপি চবি শাখার তথ্য প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক শিউলি ত্রিপুরা।
অনুষ্ঠানে অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান হল সংসদের ভিপি রিপুল চাকমাকে ও ডাকসু সদস্য হেমা চাকমাকে চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইয়াহইয়া আখতার এবং নবাব ফয়জুন্নেসা হলের ভিপি পারমিতা চাকমাকে পিসিপির সভাপতি অমল ত্রিপুরা সম্মাননা স্মারক তুলে দেন। এছাড়াও নবাব ফয়জুন্নেসা হল, অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান হল, মাস্টারদা সূর্যসেন হল, প্রীতিলতা হল সংসদের নির্বাচিত মোট ১৮ জনের হাতে সম্মাননা স্মারক, প্রায় ১৫০ জন নবীন ও প্রবীণ শিক্ষার্থীদের মাঝে ফুল ও উপহারসামগ্রী দিয়ে বরণ ও বিদায়ী শুভেচ্ছা জানানো হয়।


নবীনদের বরণ ও বিদায়ীদের শুভেচ্ছা বিনিময়ে শেষে চাকসু নির্বাচনের অভিজ্ঞতা ও নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করেন অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান হল সংসদের পক্ষ থেকে ভিপি রিপুল চাকমা এবং নবাব ফয়জুন্নেসা হলের ভিপি পারমিতা চাকমা।
অনুষ্ঠানে চবি উপাচার্য ড. ইয়াহইয়া আখতার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে করে বলেন, যারা নির্বাচিত হয়েছেন আপনারা শুধু পাহাড়িদের নেতা না, চবির ২৮ হাজার শিক্ষার্থীর নেতা। নিজেদের তিন জেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ করবেন না। আমরা সবাইতো বাংলাদেশি। অন্যের সংস্কৃতিও আপনাদের বুঝতে হবে।

চবি উপাচার্য আরো বলেন, আমাদের স্বপ্ন সফল হবে যখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যোগ্য গ্র্যাজুয়েট তৈরি হবে। আমরা প্রশাসনের দায়িত্ব নেওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ইমেজ বৃদ্ধির জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। আমরা যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ এবং যোগ্য শিক্ষার্থী তৈরি করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা বিশ্বাস করি, যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ হলে যোগ্য গ্র্যাজুয়েট তৈরি হবে। এতে সবাই উপকৃত হবে।
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি অমল ত্রিপুরা বলেন, শাসকের শৃঙ্খল ভাঙতে ১৯৮৯ সালে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের জন্ম হয়েছে। পিসিপি গঠনের দিনই লংগদু গণহত্যার মৌন মিছিলের মাধ্যমে প্রতিবাদ এবং পরবর্তীতে লোগাং, নান্যাচর, মাল্যা গণহত্যার প্রতিবাদ সহ ভূমি বেদখল, মা বোনের ইজ্জত রক্ষার্থে ও শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক পাহাড়-সমতলে অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে, সংগ্রাম জারি রেখেছে।
তিনি আরো বলেন, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ের পাশাপাশি শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সমাজ রক্ষার্থে সংগ্রাম জারি রেখেছে এবং আগামী দিনেও এই লড়াই অব্যাহত থাকবে। ২০০০ সালে পিসিপি, টিএসএফ, বিএমএসসি, গারো স্টুডেন্ট ইউনিয়ন, সান্তাল স্টুডেন্ট ইউনিয়ন ও ওরাও ছাত্র সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা লাভের অধিকার নিশ্চিত সহ শিক্ষাসংক্রান্ত ৫ দফা দাবিতে আন্দোলন করেছিল। যদিও পরবর্তীতে পিসিপিকে এককভাবে এই দাবি আদায়ের সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে হয়েছে। আন্দোলনে ফলস্বরূপ আমাদের নতুন প্রজন্ম চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা সহ ৫টি জাতি নিজেদের মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াইয়ের আহ্বান জানিয়ে অমল ত্রিপুরা বলেন, আমাদের লড়াই শেষ হয়নি, আমাদের আরো কঠিন পথ পারি দিতে হবে। আগামীতে পাহাড়ে শিক্ষা সংকট নিরসন, শিক্ষা ব্যবস্থায় দুর্নীতিসহ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে এবং জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার্থে দল, জাতি ভেদাভেদ না রেখে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করতে হবে।
তিনি বলেন, পাহাড়ে লড়াইটা একক কোন দল বা সংগঠন, জাতি, ধর্ম, সম্প্রদায়ের নয়, কিংবা শুধমাত্র পাহাড়িদেরও নয় এই লড়াই পাহাড় সমতলে সকলের। এই লড়াইকে সুসংগঠিতভাবে এগিয়ে নিতে হবে। ছাত্র সমাজকে তাঁর ঐতিহাসিক গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে, কর্তব্য সম্পন্ন করতে হবে।
তিনি বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুষ্ঠু সুন্দর, নিরাপদ ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত জন্য এগিয়ে আসতে ছাত্র সমাজের প্রতি আহ্বান জানান। এছাড়াও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতির যে মেলবন্ধন সেটিকে সমুন্নত রাখার আহ্বান জানান।
প্রক্টর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বলেন, “বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গঠনে রক্তের বন্ধনকে আরো দৃঢ় করতে হবে। চাকসু নির্বাচিত প্রতিনিধিরা শুধু নির্বাচিত হয়েই যেন থেমে না থাকে, বরং আরো নতুন নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে।

ছাত্র উপদেষ্টা ড. আনোয়ার হোসেন তার বক্তব্যে বলেন, “চাকসু নির্বাচনে সকল শিক্ষার্থীর পাশাপাশি বিশেষ করে পাহাড়ের ছাত্র সংগঠন ও জাতিসত্তার শিক্ষার্থীরা গঠনমূলক ও সৌহার্দ্যপূর্ণ নির্বাচন করতে সহায়তা করেছে।
তিনি চাকসু প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনাদেরকে পাহাড়ের একদম প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বম, খিয়াং, চাক শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করে যেতে হবে। একই সাথে তিনি আগামীতে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড ও একাডেমিক এক্সসিলেন্সি অর্জনে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সহযোগীতা কামনা করেন।
ইসলামিক ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুনমুন নেসা চৌধুরী বলেন, “আমাদের রাষ্ট্র খুব ছোট কিন্তু বৈষম্য ও বঞ্চনা অনেক বেশি। পার্বত্য চট্টগ্রামের যে ভূগোল, নৃতত্ত্ব, অর্থনৈতিক অবস্থা এবং রাষ্ট্রের সাথে পাহাড়ে যে সম্পর্ক সেখানে আরো বেশি বৈষম্য রয়েছে।”
তিনি বলেন, “আপনারা শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম নয়, পুরো বাংলাদেশের শিক্ষার্থী। সুতরাং রাষ্ট্রকেই আপনাদের দায়িত্ব নিতে হবে।”
পিসিপির সহ সাধারণ সম্পাদক সোহেল চাকমা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে বিশ্ব বিদ্যার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার অন্যতম মাধ্যম। জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে সেই বিদ্যাকে দেশ, সমাজ ও জাতির স্বার্থে উপযোগী করে তুলতে পারাটাই জীবনের সার্থকতা।
তিনি আরো বলেন, বিগত বিভিন্ন সময়ের তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে এইবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অধিক সংখ্যক পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেছে। এটি আমাদের জন্য গৌরবের।
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, অস্তিত্বের প্রশ্ন যখন সামনে আসে, তখন রাজনীতিই হয়ে ওঠে আমাদের ক্যারিয়ার। আমরা যেহেতু পাহাড়ে নিপীড়নের মধ্যে দিয়ে বেড়ে উঠেছি এবং এখনো সেখানে নিপীড়ন চলছে, তাই যতদিন চেঙ্গী-মাইনি-সাঙ্গু-কাচালং-মাতামুহুরি নদী বহমান থাকবে ততদিন আমাদের রাজনৈতিক সংগ্রাম জারী রাখতে হবে।
পিসিপির সাংগঠনিক সম্পাদক রোনাল চাকমা বলেন, জীবনের প্রয়োজনে আমরা যেখানেই থাকি না কেন, আমরা যেন আমাদের পাহাড়ের শেকড়কে ভুলে না যাই। তিনি ক্যাম্পাসে অবস্থানকারী সকল পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের মাঝে সহনশীল, সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার আহ্বান জানান।
ডাকসু সদস্য হেমা চাকমা বলেন, “যখনই পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ সাংবিধানিক পরিচয় চায়, সাংবিধানিক অধিকার চায়, অধিকারে প্রশ্নে, ন্যায্যতার প্রশ্নে ও সমতার প্রশ্নে ছাত্র সমাজ ঐক্যবদ্ধ হয় তখনই রাষ্ট্র ভিন্ন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। আমরা চাই একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র গঠন হোক এবং আমরা সাংবিধানিক পরিচয়ে বাংলাদেশী হিসেবে বাস করতে চাই।”
সভাপতির বক্তব্য ভূবন চাকমা বলেন, চাকসু হল সংসদ নির্বাচনে জয়ের মাধ্যমে পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। এই গৌরবকে ধরে রাখতে হলে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতে হবে। তিনি শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ, দায়িত্বশীল ও অধিকারের জন্য কাজ করে যাওয়ার আহবান জানান।
বিকালে দ্বিতীয় পর্বে নবীন ও প্রবীণ শিক্ষার্থীদের পরিচয় ও স্মৃতিচারণমূলক বক্তব্যের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের কর্তৃক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।

সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।
