মতামত

চাকমা-মারমা-ত্রিপুরা বিদ্বেষী প্রচার কেন?

0

থুইক্যচিং মারমা


পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিগত নিষ্পেষণের শিকার পাহাড়ি জাতিগুলো সম্পর্কে অপপ্রচার ও বিদ্বেষ ছড়ানো এবং তাদের মধ্যে বিভেদ-অনৈক্য সৃষ্টির প্রচেষ্টা নতুন নয়। মূলতঃ শাসকগোষ্ঠীর ডিভাইড-এন্ড-রুল পলিসির অংশ হিসেবে এটা করা হয়ে থাকে। শাসকদের উদ্দেশ্য হলো বিশেষত চাকমাদের বিরুদ্ধে অন্যান্য জাতির জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলা এবং তাদেরকে চাকমা-বিদ্বেষী করে তোলা। তবে ইদানিং চাকমা ছাড়াও, মারমা ও ত্রিপুরাদের বিরুদ্ধেও অন্যান্য জাতির লোকজনকে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা বেশ লক্ষ্যণীয়। এই ধরনের অপপ্রচারণা ও চেষ্টা সব সময় জারী থাকলেও দেখা যায়, যখনই সরকার বা শাসকগোষ্ঠীর কোন প্রকল্প বা তৎপরতার কারণে জনগণের মধ্যে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ অসন্তোষ আন্দোলনে রূপ নেয় তখনই এই ধরনের বিভেদমূলক, সাম্প্রদায়িক ও জাতিবিদ্বেষী অপপ্রচারণা জোরদার করা হয়।

গত ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ইত্তেফাকে (অনলাইন) প্রকাশিত একটি লেখা হলো তারই দৃষ্টান্ত। লেখাটির শিরোনাম ‘এটিই নতুন সশস্ত্র সংগঠন গড়ে ওঠার কারণ! পার্বত্য চট্টগ্রামে ছয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কোটাবঞ্চিত’। এখানে লেখক আবুল খায়ের-এর দুরভিসন্ধি অত্যন্ত পরিস্কার। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মাহফুজ পারভেজকে উদ্ধৃত করে লিখেছেন: ‘একচেটিয়া চাকমা সম্প্রদায় কোটাসহ সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা পেয়ে আসছে। আর বঞ্চিত থাকা বাঙালিসহ ১৩টি সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এই কারণে পার্বত্য অঞ্চলে নতুন করে সশস্ত্র সংগঠন সৃষ্টির অন্যতম কারণ করে (বলে) তিনি মনে করেন।’ (ভুল বাক্য)

তিনি আরও লিখেছেন, ‘কোটার বেশির ভাগ সুবিধা একচেটিয়াভাবে চাকমা এবং কিছু ক্ষেত্রে মারমা ও ত্রিপুরা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা পাচ্ছে।’ (ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী শব্দ অপমানজনক!) তার লেখা থেকে আরও একটি উদ্ধৃতি: ‘দেশে উচ্চশিক্ষায় ভর্তি ও সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে পার্বত্য তিন জেলার ছোট ছোট জাতিগোষ্ঠী আরও পিছিয়ে পড়েছে এবং বড় জাতিগোষ্ঠীর আধিপত্যের কারণে রাজনীতি ও সরকারি চাকরিসহ সব ক্ষেত্রে বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। এরূপ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার লক্ষ্যে সশস্ত্র দল কেএনএফ ও এমএনপি গঠিত হয়েছে বলে স্থানীয় বাসিন্দারা মনে করেন।’

এ কথা সত্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জাতিসত্তাগুলোর মধ্যে চাকমারাই শিক্ষাদীক্ষায় অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীগুলোর চাইতে তুলনামূলকভাবে অগ্রসর। কিন্তু তার মানে এটা অবশ্যই বলা যাবে না যে, তাদের এই ‘অগ্রসরতা’ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীগুলোকে দাবিয়ে রাখার বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে, যেভাবে শ্রীলংকায় স্বাধীনতা লাভের পর সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলীরা তামিলদেরকে বৃটিশ আমলে প্রাপ্ত সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে নিজেদের সুবিধা বৃদ্ধি করেছে। নেদারল্যাণ্ডের গবেষক ভেলাম ভেন সেন্দেল মনে করেন রাজনৈতিক দলে চাকমাদের প্রাধান্য থাকা স্বাভাবিক। সেটা না থাকলেই বরং আশ্চর্যজনক ব্যাপার হতো। তিনি লিখেছেন, It would be highly surprising if they (Chakma) were not: they  are the largest group in the Chittagong hills, they have an educated elite, and they have been among those who have been most severely affected, first by the Kaptai lake and later by in-migration and militarization. But the other groups in the Chittagong hills are not so absent from either the JSS or the casualty list.’ (The Invention of the `Jummas’: State Formation and Ethnicity in Southeastern Bangladesh)

উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি ও চাকুরির ক্ষেত্রে কোটা বরাদ্দ, ভর্তি ও নিয়োগের মালিক সরকার ও সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান; এখানে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা কিংবা পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্য কোন জাতিসত্তার কোন হাত নেই। সুতরাং চাকমা, মারমা বা ত্রিপুরা কর্তৃক কোটা সুবিধা থেকে অন্যদের বঞ্চিত করার অভিযোগ নিতান্ত অবান্তর। জানা মতে, এক দশক আগেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যোগ্যতা সম্পন্ন ম্রো ছাত্র পাওয়া যেত না, এখনও খুব বেশী পাওয়া যায় তা নয়। তবে ইদানিং ম্রোরাও উচ্চ শিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ম্রো ছাত্র না থাকার কারণ তাদের মধ্যে স্কুল কলেজ লেভেলে শিক্ষার বিস্তার না হওয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সুবিধা পেতে হলে কোন ম্রো বা অন্য যে কোন জাতিসত্তার শিক্ষার্থীকে তো আগে কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে আসতে হবে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য যদি কোন ম্রো/খুমি/বম শিক্ষার্থী না থাকে, তাহলে কোটার আসনগুলো কোটাভুক্ত অন্য জাতিসত্তার শিক্ষার্থীদের কাছে স্বাভাবিকভাবে চলে যাবে। এখানে অন্যকে বঞ্চিত করা বা অন্যায়-অন্যায্য সুবিধা পাওয়া হলো কিভাবে? তবে যদি এমন হয় যে, কোটার আসনে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা শিক্ষার্থীর সাথে ম্রো, চাক, খুমি, বম শিক্ষার্থীরাও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে, তাহলে সেক্ষেত্রে চাকমা বা মারমা শিক্ষার্থীদের উচিত হবে উক্ত আসন তাদের জন্য ছেড়ে দেয়া। অবশ্য এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তারা এক্ষেত্রে অধিকতর অগ্রসর জাতিসত্তা চাকমা শিক্ষার্থীকে বঞ্চিত করে তুলনামূলকভাবে অনগ্রসর ম্রো, চাক, খুমি শিক্ষার্থীকে উক্ত কোটা আসন বরাদ্দ দিতে পারে। তবে এ ধরনের পরিস্থিতি দৈবাৎ দেখা দিতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা শিক্ষার্থী কর্তৃক কোন ম্রো, চাক, বম শিক্ষার্থীকে বঞ্চিত হওয়ার ঘটনা আজও শোনা যায়নি।


পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত সকল জাতিসত্তার স্ব স্ব সংস্কৃতি বজায় রেখে বিকাশ লাভের সমান অধিকার থাকা উচিত। কিন্তু সরকার কি আমাদের সেই অধিকার দেয়? বর্তমানে সংবিধানে বাঙালি ভিন্ন অন্য কোন জাতিসত্তার স্বীকৃতি নেই। ভূমি বেদখল চলছে হরদম। বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ চলছে সমানে, তাদের কারণে পাহাড়িরা নিজ মাতৃভূমিতে এখন সংখ্যালঘু, পরবাসী। আগামী কয়েক দশকে আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব টিকে থাকবে কীনা তা নিয়ে আমরা শঙ্কিত।


কোটা প্রসঙ্গে এখানে আরও বলা দরকার যে, ২০১৮ সালে দেশে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনের সময় সরকার সকল প্রকার কোটা ব্যবস্থা বাতিল করেছিল। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে পাহাড়িদের কোন মতামত নেয়া হয়নি। সরকার মুক্তিযোদ্ধা কোটার সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের জন্য বরাদ্দ কোটা ব্যবস্থাকে এক করে দেখেছিল, যা ছিল একটি বড় ভুল। এ কোটা ব্যবস্থার পুনঃ প্রবর্তন দরকার। এখানে আরও উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, কোটা পদ্ধতি চালু থাকার সময়ও পাহাড়িদের জন্য বরাদ্দ কোটা পূরণ করা হতো না। সরকারের কাছে পেশ করা দাবিনামায় ইউপিডিএফ লিখেছে: ‘এক্ষেত্রে বিশেষ করে লক্ষণীয় যে, কোটা পদ্ধতি চালু থাকার সময়েও নিয়মিতভাবে, নির্ধারিত সংখ্যক পদে নিয়োগ দেওয়া হতো না। কোন কোন ক্ষেত্রে, সংশ্লিষ্ট জাতিসত্তার বাহিরে কোটার আসন সমূহ বণ্টন করা হতো। এছাড়া, ডিসি ও ইউএনও অফিসে এবং জেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তরিত নয় সে সকল সরকারী বিভাগ, স্বায়ত্তশাসিত আধা সরকারী প্রতিষ্ঠান ও এমনকি জেলা পরিষদের হস্তান্তরিত কিছু কিছু বিভাগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কোটা নীতির চরম বরখেলাপের নজির রয়েছে।’ (৭৭ নং দফা) এক কথায় যে সরকারী চাকুরিতে পাহাড়িদের জন্য যে কোটা বরাদ্দ রয়েছে তাও পুরোপুরি দেয়া হয় না। এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে ম্রো, চাক, বম, খুমিদের বঞ্চনার জন্য দায়ি কে?

পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত সকল জাতিসত্তার স্ব স্ব সংস্কৃতি বজায় রেখে বিকাশ লাভের সমান অধিকার থাকা উচিত। কিন্তু সরকার কি আমাদের সেই অধিকার দেয়? বর্তমানে সংবিধানে বাঙালি ভিন্ন অন্য কোন জাতিসত্তার স্বীকৃতি নেই। ভূমি বেদখল চলছে হরদম। বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ চলছে সমানে, তাদের কারণে পাহাড়িরা নিজ মাতৃভূমিতে এখন সংখ্যালঘু, পরবাসী। আগামী কয়েক দশকে আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব টিকে থাকবে কীনা তা নিয়ে আমরা শঙ্কিত। লামা এক সময় ছিল সম্পূর্ণ ম্রো সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল। এখন তারা বহিরাগত বাঙালিদের চাপে কোনঠাসা। তাদের হাজার হাজার একর জুম চাষের জমি কেড়ে নেয়া হয়েছে, এখন বাকি ৪০০ একরও কেড়ে নেয়ার জোর আয়োজন চলছে, হামলার পর হামলা হচ্ছে, পুরো এলাকার ম্রোদের মেরে ফেলার জন্য নদীতে বিষ ঢেলে দেয়া হচ্ছে। তাদের জন্য এখন বেঁচে থাকাই দায় হয়ে পড়েছে। শুধু লামা নয়, চিম্বুকসহ অন্যান্য আরও অনেক এলাকা থেকে তাদের উৎখাত করা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। তাদের জমিতে এখন নব্য বাঙালি জমিদারদের বিশাল বিশাল রাবার বাগান আর রিক্রিয়েশনের জন্য পর্যটন স্থাপনা, হোটেল ও মোটেল। অন্যদিকে ম্রোদের অবস্থা হয়েছে আরও প্রান্তিক, আরও শোচনীয়। এসব বড় বড় স্থাপনা ও বাগানের আড়ালে অপসৃয়মান তাদের অস্তিত্ব।

অনুরূপভাবে রামগড় ও মানিকছড়িও এক সময় ছিল সম্পূর্ণ মারমা অধ্যুষিত অঞ্চল, আর মাটিরাঙ্গার তবলছড়ি-তাইন্দং ত্রিপুরাদের আবাসভূমি। আজ সেখান থেকে তারা নির্বাসিত। তাদের প্রায় সব জমি ছলে বলে কৌশলে কেড়ে নেয়া হয়েছে।

এই যখন অবস্থা তখন সকল কোটা সুবিধা কেবল চাকমারা (ক্ষেত্র বিশেষে মারমা ও ত্রিপুরারাও) একচেটিয়া নিয়ে যাচ্ছে বলে মতলববাজী অপপ্রচারের উদ্দেশ্য একটাই হতে পারে — আর তা হলো শাসকগোষ্ঠী পাহাড়ে যে অন্যায় অবিচার জুলুম চালাচ্ছে তা আড়াল করা, পাহাড়িদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করা এবং তারা যাতে ঐক্যবদ্ধভাবে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারে তার চেষ্টা করা। তবে শাসকগোষ্ঠীর এই ষড়যন্ত্র কখনই সফল হবে না। কারণ বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে কোন তথ্য আর গোপন রাখা যায় না। #

লেখক গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক। লেখাটি তাঁর ফেসবুক থেকে নেওয়া হয়েছে।


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।


সিএইচটি নিউজের ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More