মতামত
জরুরী অবস্থার সময় ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে ইউপিডিএফ

মিল্টন চাকমা, সংগঠক, ইউপিডিএফ
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশে জরুরী অবস্থা জারি করা হয়, যা ওয়ান-ইলেভেন নামে পরিচিত। তৎকালীন সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদের সমর্থনে ফকরুদ্দীন আহমেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তার সরকার দুই বছর ক্ষমতায় ছিল।
এই জরুরী অবস্থার সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি বেদখল এক মহামারী রূপ ধারণ করে। খাগড়াছড়ির দীঘিনালা, মাইসছড়ি, মেরুং; রাঙ্গামাটির সাজেক, বুড়িঘাট, তিনটিলা এবং বান্দরবানের রুমা ও বালাঘাটাসহ বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়িদের জমি কেড়ে নেয়ার মহোৎসব শুরু হয়। জনগণের এই চরম দুঃসময়ে একটি মাত্র পার্টি তাদের পাশে দাঁড়িয়ে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল: সেই পার্টি হলো ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্রিয়াশীল আর কোন তথাকথিত জাতীয় ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল এই ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল না। এমনকি তারা প্রতিবাদ স্বরূপ একটি আঙুলও তোলেনি।
ইউপিডিএফ কীভাবে এই ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিল, তা বলার আগে সে সময়কার পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত করা দরকার।
১৯৯৭ সালের চুক্তির পর ইউপিডিএফ ও জেএসএসের মধ্যে সংঘাত (আসলে বলা উচিত ইউপিডিএফের ওপর জেএসএসের হামলা) বেড়ে যায়। দেশ বিদেশের অনেক মহল দুই পক্ষের এই দ্বন্দ্ব নিরসনের চেষ্টা চালায়। কিন্তু কেউ সন্তু লারমাকে ইউপিডিএফের সাথে আলোচনার টেবিলে বসতে রাজী করাতে সক্ষম হননি। কিন্তু ২০০৬ সালের প্রথম দিক যখন জেএসএসের জাতীয় কংগ্রেসকে ঘিরে তাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব তীব্র হয় এবং রূপায়ন দেওয়ান-সুধাসিন্ধু খীসারা সন্তু লারমার দুর্নীতি, অনিয়ম ইত্যাদি নিয়ে সোচ্চার হয়ে উঠলেন, তখন সন্তু বাবু নিজেই ইউপিডিএফের সাথে আলোচনার জন্য ছটফটানি শুরু করেন এবং এক পর্যায়ে ইউপিডিএফের কাছে আলোচনার প্রস্তাব দেন। তার এই প্রস্তাব যে তার কূটকৌশলের অংশ – উদ্দেশ্য একইসাথে দুই ফ্রন্টে লড়াই না করে প্রথমে দলের অভ্যন্তরীণ ফ্রন্টকে মোকাবিলা করা – তা ইউপিডিএফের বুঝতে অসুবিধা হয়নি। কিন্তু তা সত্বেও ইউপিডিএফ নেতারা জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে জেএসএসের সাথে বৈঠকে বসতে রাজী হন।
২০০৬ সালের প্রথমার্ধে দুই পার্টির মধ্যে কমপক্ষে ৩ বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং উভয়পক্ষ একে অপরের ওপর হামলা বন্ধ রাখতে সম্মত হয়। কিন্তু তৃতীয় বৈঠকে অনাক্রমণের সিদ্ধান্ত হওয়া সত্বেও, এই বৈঠকের পর এক সপ্তাহ না পেরোতেই সন্তু বাহিনী উক্ত সমঝোতা লঙ্ঘন করে ইউপিডিএফের ওপর পুনরায় হামলা শুরু করে। খুব সম্ভব সন্তু লারমা মনে করেছিলেন, কংগ্রেসে ‘বিদ্রোহীদের’ দল থেকে বিতাড়িত করে তার অবস্থান সংহত করতে সক্ষম হয়েছেন। অর্থাৎ দলের অভ্যন্তরীণ ফ্রন্ট সামাল দিতে পেরেছেন। কিন্তু তার এই হামলা বুমেরাং হয়ে যায়।
বিদ্রোহীদের বিতাড়ন সত্ত্বেও জেএসএস দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায় এবং তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব রক্তাক্ত সংঘাতের রূপ নেয়। তাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও জনগণের প্রতিরোধের কারণে জেএসএস সন্তু গ্রুপ পুরো খাগড়াছড়ি জেলা এবং রাঙ্গামাটির বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে সম্পূর্ণ উৎখাত হয়ে যায়। এই শোচনীয় পরিস্থিতিতে সন্তু গ্রুপ ইউপিডিফের কাছে আবার আলোচনার প্রস্তাব পাঠায় এবং রাঙ্গামাটির সাজেকে উভয় পার্টির মধ্যে এক আলোচনার মাধ্যমে আর একবার একে অপরের ওপর আক্রমণ বন্ধ রাখার সমঝোতা হয়।
ইত্যবছরে দেশে জরুরী অবস্থা জারী হয়। এই সময় দুই পার্টির মধ্যে সংঘাত বন্ধ থাকায় ইউপিডিএফ ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার দিকে পূর্ণ মনোযোগ দেয়। অপরদিকে জনগণের এই বাঁচা-মরার লড়াইয়ে সামিল না হয়ে বিশ্বাসঘাতক সন্তু গ্রুপ সমঝোতাকে কাজে লাগিয়ে নিজের সাংগঠনিক ও সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে সচেষ্ট হয়। অর্থাৎ জরুরী অবস্থার সময় ইউপিডিএফ ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে জনগণকে নেতৃত্ব দেয়। অন্যদিকে জেএসএস সন্তু গ্রুপ নতুন করে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত শুরু করার জন্য, চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনের নামে স্বজাতির ভাইদের হত্যার জন্য প্রস্তুতি নেয়।
ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে সবচেয়ে তীব্র লড়াই চলে দীঘিনালার সাধনা টিলায় ও রাঙ্গামাটি জেলার সাজেকে। ইউপিডিএফ ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে জনগণকে সংগঠিত করে। বিভিন্ন এলাকায় ভূমি রক্ষা কমিটি গঠন করা হয়।
দীঘিনালায় সাধনাটিলা বনবিহারের ৩০০ একর জমি বেদখল করে সেখানে সেটলার পুনর্বাসনের জন্য দীঘিনালা জোন কমান্ডার খুবই সক্রিয় হন। তিনি সাধনাটিলায় সেটলারদের নিয়ে আসেন এবং পুনর্বাসনের আপ্রাণ চেষ্টা চালান। পাহাড়িরা যাতে তার চেষ্টায় বাধা না দেয় তার জন্য তিনি তাদেরকে গুলি করে মারার হুমকি দেন, সেনা টহল জোরদার করেন এবং এভাবে এক ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন। এই অবস্থায় সাধারণ জনগণ খুবই হতাশ, ভয়ে কাহিল এবং দিশাহারা হয়ে পড়ে। তারা সাধনাটিলার জমি আর রক্ষা করা সম্ভব হবে না বলে হাল ছেড়ে দেন।
এই চরম কঠিন পরিস্থিতিতে ইউপিডিএফ দৃঢ়ভাবে জনগণের পাশে দাঁড়ায় এবং তাদেরকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে উৎসাহিত করে ও সাহস যোগায়। ফলে ইউপিডিএফের নেতৃত্বে জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয় এবং আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা এই শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধে সামিল হয়। তারা একতাবদ্ধভাবে আগ্রাসী সেটলারদের বাধা দেয় এবং বিহার ও ভান্তেকে সেটলারদের হামলা থেকে আগলে রাখে। এভাবে এক পর্যায়ে সেনাবাহিনী ও সেটলাররা পিছু হটে যায়। তবে এরপরও তারা আরও কয়েকবার উক্ত বিহারের জমি জোরপূর্বক দখলের চেষ্টা চালায়, কিন্তু প্রতিবারই তাদেরকে পার্টির নেতৃত্বে প্রতিরোধ করা হয়। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ওয়াদুদ ভূইয়া নির্বাচিত হলে আবারও সাধনাটিলার জমি বেদখলের ষড়যন্ত্র হতে পারে। এজন্য সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
সাধনাটিলার জমি রক্ষার প্রতিরোধ সংগ্রামে পার্টির পক্ষ থেকে সে সময় বিশেষভাবে ভূমিকা পালন করেছিলেন অনিমেষ চাকমা ও শান্তিদেব চাকমা। প্রথমজন ২০১১ সালে সন্তু বাহিনীর সদস্যদের হামলায় শহীদ হন। তাকে বরকলের চিলাকধাক এলাকায় ঘাতকরা গুলি করে হত্যা করেছিল। আর শান্তিদেব চাকমা দু’বছর আগে অসুস্থ হয়ে মারা যান।
সাধনাটিলার পর ২০০৭-২০০৮ সালে সাজেকে সেটলার পুনর্বাসনের জন্য পাহাড়িদের উৎখাত করে জমি বেদখলের চেষ্টা চালায় সেনাবাহিনী ও উগ্র সেটলার গোষ্ঠী। সাজেকের বাঘাইহাট বাজারে সেটলারদের শতাধিক পরিবারকে নিয়ে আসা হয়। তারা পাহাড়িদের বেশ কয়েকটি গ্রামে আগুন লাগিয়ে দেয়। ব্যাপক লুটপাট চালায়। ইউপিডিএফ সেনা-সেটলারদের এই ভূমি বেদখল প্রতিরোধ করতে সেখানে আগে থেকে “সাজেক নারী সমাজ” ও “সাজেক ভূমি রক্ষা কমিটি” গঠন করে এলাকার পুরো জনগণকে প্রস্তুত করে রেখেছিল। পার্টি ও সাজেকের জনগণ একমন-একপ্রাণ হয়ে লড়াই চালিয়ে যান এবং ভূমি বেদখল প্রতিরোধ করতে সক্ষম হন।
মেরুং, মাইসছড়ি ও পানছড়িতেও সেটলাররা ভূমি বেদখলের চেষ্টা চালায়। সেখানেও প্রতিরোধ করতে জনগণকে সংগঠিত করা হয়। ইউপিডিএফ সংগঠক মিঠুন চাকমা, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে ইউপিডিএফের সাথে যুক্ত হয়ে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন, তিনি এসব এলাকায় ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে সে সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি অনেক ঝুঁকি নিয়ে গ্রামে গ্রামে গিয়ে ভূমি বেদখল সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন এবং লোকজনকে ভূমি বেদখল প্রতিরোধ করতে উৎসাহিত করেছিলেন, সাহস যুগিয়েছিলেন। অথচ জাতীয় বেঈমান নরাধম তাতিন্দ্র লাল চাকমার (পেলে) লেলিয়ে দেয়া ঘাতকরা তাকে খাগড়াছড়ি শহরে প্রকাশ্য দিবালোকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
ইউপিডিএফ ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে যে সব পন্থা অবলম্বন করে তার মধ্যে রয়েছে: প্রচারপত্র বা লিফলেট বিলি, বুলেটিন প্রকাশ, স্মারকলিপি প্রদান ও জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে সংবাদ সম্মেলন আয়োজন, দেশে বিদেশে প্রচারণা এবং প্রবাসী জুম্ম সংগঠনগুলোকে দিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন।

খাগড়াছড়ির মহালছড়িতে ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য ইউপিডিএফের নেতৃত্বে মহালছড়ি ভূমি রক্ষা কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকায় ভূমি বেদখলের চিত্র তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলন করে। সেখানে অভিযোগ করা হয়, ৯ মাসে কিয়াংঘাট, মাইসছড়ি, ১ নং খাগড়াছড়ি ও কমলছড়ি ইউনিয়নে ৩৬৬ একর জমি বেদখল করা হয়েছে।
বান্দরবানে ভূমি বেদখলের রূপ ছিল সামরিক প্রয়োজন দেখিয়ে জমি অধিগ্রহণ। সেখানে রুমা গ্যারিসন সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ৯,৫৬০ একর ও বালাঘাটায় সেনানিবাস সম্প্রসারণের জন্য ১৩১.২৭ একর জমি অধিগ্রহণের নামে বেদখলের চেষ্টা করা হলে ইউপিডিএফ স্থানীয় জনগণকে সংগঠিত করে তা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়। ইউপিডিএফের নেতৃত্বে পাহাড়ি ও বাঙালিরা একসাথে বালাঘাটার জমি রক্ষার জন্য প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দেয় এবং ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। এছাড়া ইউপিডিএফ বিদেশের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের কাছেও ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালায়। ইউপিডিএফের প্রচেষ্টা ও নেতৃত্বের কারণে রুমা ও বালাঘাটায় জনগণ তাদের জমি রক্ষা করতে সক্ষম হয়। সরকারও জনস্বার্থের কথা বিবেচনা করে জনগণের দাবি মেনে নিয়ে জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া বন্ধ করে।

তবে অনেক চেষ্টা সত্বেও মাইসছড়িতে কিছু কিছু জায়গায় ভূমি বেদখল প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি। মূলতঃ যেসব এলাকায় জনগণ অতি বেশী ভীত সন্ত্রস্ত ছিল, ইউপিডিএফের বারংবার আহ্বান সত্বেও প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসেনি, সেখানে ভূমি বেদখল রোধ করা যায়নি। অন্যদিকে যেখানেই জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়িয়েছে সেখানে কমবেশি ভূমি রক্ষা করা গেছে।
ইউপিডিএফের পাশাপাশি যদি জেএসএসও সোচ্চার ও সক্রিয় হতো, তাহলে ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামকে আরও বেশি সফল করা যেতো। কিন্তু জেএসএস সেটা করেনি, তারা এ সময় নিজের ভাইয়ের বুক ঝাঁঝরা করে দেয়ার জন্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করে এবং লোকজন ভর্তি করে সামরিক ট্রেনিং দেয়। আর এভাবে শক্তি সঞ্চয় করার পর ২০০৭ সালের সাজেক সমঝোতা লঙ্ঘন করে তারা ২০১০-১১ সালের দিকে আবার ইউপিডিএফের ওপর হামলা শুরু করে। এই হলো নীতি-আদর্শচ্যুত ও রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়াগ্রস্ত জেএসএস সন্তু গ্রুপের কীর্তিকলাপ।
(৬ ডিসেম্বর ২০২৫)
* লেখা সংগ্রহ: ইউপিডিএফের ফেসবুক পেইজ।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।
