জুলাই অভ্যুত্থানে জেএসএসের প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা
সোহেল চাকমা
চব্বিশের জুলাই দেশের আপামর জনগণের বহুল প্রতিক্ষিত একটি আশা—আকাঙ্ক্ষার অধ্যায়। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ, অন্যায় ধরপাকড়, গণবিরোধী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার, জেল-জুলুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, লুটপাট, দুর্নীতি, দখলদারিত্ব, সন্ত্রাস ইত্যাদি যখন দেশ পরিচালনায় ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের একমাত্র নীতি হয়ে দাঁড়ায় তখনই জুলাই অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। জনজীবনের ওপর কড়া নজরদারী ও কর্তৃত্ববাদী শাসনই দেশের ছাত্র-শিক্ষক-শ্রমিক-জনতাকে ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে বাধ্য করেছিল। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়ায় আচড়ে পড়েছিল গণজোয়ারের ঢেউ। ৫ই আগস্ট ’২৪, খড়কুটোর মতো ভেসে গিয়েছিল হাসিনার রাজত্ব। পতন হয়েছিল এক স্বৈরাচারী মাফিয়াতন্ত্রের।

জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী ইন্টেরিম সরকার গঠন হওয়ার পর জনমনে আশা ছিল একটি সুস্থ, সুন্দর জীবনযাপন। ছিল নিরাপত্তায় পরিবেষ্টিত সমঅধিকার ভিত্তিক এক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র রুপান্তরের স্বপ্ন। কিন্তু সেই আশা যেন দেশের আপামর জনগণকে চপেতাঘাত করে জুলাইকে বিতর্কিত ও বিদ্রূপাত্মক করে তোলেছে। শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরির গ্যারান্টি পায়নি, নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি, আইন ও বিচারব্যবস্থা জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারেনি, জাতিসত্তাসমূহের অধিকার সুরক্ষিত হয়নি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি, জনদুর্ভোগ কমেনি- পূর্বের মতোই সবকিছু বিরামহীনভাবে চলছে। উল্টোদিকে বেড়েছে মব সন্ত্রাস, নারী ধর্ষণ, জাতিসত্তার জনগণের ওপর দমন-পীড়ন। চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামী এটিএম আজহারকে মুক্তি দিয়ে ইন্টেরিম সরকার আইন ও বিচারব্যবস্থার যে খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তা দেশের ইতিহাসে এক নজীরবিহীন ঘটনা। ফলত, জুলাই অভ্যুত্থান বিরোধী আওয়ামী দোসরদের দৌরাত্ম বেড়েছে আর ইন্টেরিম গর্ভমেন্ট জুলাই অভ্যুত্থানকে পরিণত করেছে সার্কাসে।
তারই জাজ্বল্যপ্রমাণ মেলে যখন আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে একটু ফিরে তাকাই। পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনো ফ্যাসিস্ট হাসিনার দোসররা পুরোদস্তুর কর্তৃত্ববাদী শাসন পরিচালনা করছে। জুলাই আন্দোলনে হাসিনার তল্পিবাহক প্রশাসন শ্রমিক-ছাত্র-জনতার ওপর যে জঘন্য ও বর্বর হত্যাকান্ড চালিয়েছে তার দায় হাসিনার সহযোগী ও দোসররা কোনভাবেই এড়াতে পারে না। কথায় আছে, হত্যার সহযোগীরা হত্যাকারীর চেয়েও বড় অপরাধী। পাহাড়ে হাসিনার দোসর ও হত্যাকারীরা চিহ্নিত হলেও কাউকে গ্রেফতার ও বিচার করা হয়নি। আওয়ামী দোসর হিসেবে চিহ্নিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি বা জেএসএস ফ্যাসিস্ট হাসিনার পক্ষ নিয়ে জুলাই অভ্যুত্থানের বিরোধীতা করেছে। আন্দোলনের সময় ১৬ জুলাই ’২৪, জেএসএস এর সহ-সভাপতি ও হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি ঊষাতন তালুকদার প্রকাশ্যে বিবৃতির মাধ্যমে জুলাই আন্দোলকে রাষ্ট্রদ্রোহী ও আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সকলকে রাজাকার হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন। ছাত্র-জনতার পক্ষ নিয়ে জেএসএস’র অধিভূক্ত কোন সংগঠন জুলাই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেনি। ফ্যাসিস্ট হাসিনার মতো জুলাইয়ের আন্দোলন দমনই ছিল জেএসএসের প্রধান লক্ষ্য। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ইন্টেরিম সরকার আওয়ামী দোসর হিসেবে চিহ্নিত হাসানুল হক ইনু কিংবা রাশেদ খান মেননদের গ্রেফতার করতে পারলে আওয়ামীপন্থী জেএসএস নেতাদের কেন গ্রেফতার করতে পারছে না? আরো এক মাস পর জুলাই অভ্যুত্থানের একবছর পূর্ণ হবে। অথচ আওয়ামী দোসর ও জুলাই অভ্যুত্থান বিরোধী জেএসএস প্রধান সন্তু লারমা এখনো আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারে বসে জুলাই আন্দোলনের সুফল ভোগ করছেন। তাহলে এটা কি স্পষ্ট নয় সেনা-শাসকগোষ্ঠী পাহাড়ি জাতিসত্তাদের ওপর দমন-পীড়নের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে অনির্বাচিত আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান ও চিহ্নিত আওয়ামীপন্থী সন্তু লারমাকে এখনো ক্ষমতার মসনদে বহাল রেখেছে?

হাসিনা সরকার পতনের পর পাহাড়ে ছাত্র আন্দোলনের বিরোধীতা ও আন্দোলন দমনে জেএসএসের প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা, গ্রাফিতি অঙ্কনে সেনাবাহিনীর বাধা প্রদান, খাগড়াছড়ি, দীঘিনালা ও রাঙামাটিতে সেনা-সেটলারদের জাতিগত সাম্প্রদায়িক হামলা ও জেএসএস এর নীরব সমর্থন, পাহাড়ের একমাত্র রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী দল ইউপিডিএফ’র ওপর পানছড়িতে সন্তু লারমা জেএসএস’র সশস্ত্র ক্যাডারদের নগ্ন হামলা, সেনা তৎপরতা ও শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে জেএসএসের দালালিপনা অবস্থান স্পষ্ঠই প্রমাণ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে যুগ যুগ ধরে শোষণ বঞ্চনার শিকার ১৫টির অধিক জাতিসত্তাদের অধিকারবঞ্চিত রাখার জন্য সেনাবাহিনী দাবার গুটি হিসেবে জেএসএসকে ব্যবহার করছে। যার মূল স্তম্ভ ক্ষমতালিপ্সু সন্তু লারমা। আওয়ামী দোসর ও জুলাই অভ্যুত্থান বিরোধী সংগঠন হিসেবে যেখানে জেএসএস সন্তু লারমার গ্রেফতার হওয়ার কথা সেখানে সন্তু লারমা, ঊষাতন তালুকদার’রা দিব্যি সেনাবাহিনীর সহায়তায় ইন্টেরিম সরকারের ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করছেন। সমতল ও পাহাড়ের ক্ষেত্রে ইন্টেরিম সরকারের এই দ্বিমুখী আচরণ জুলাই আন্দোলনে শহীদদের রক্তকে কলঙ্কিত করেছে।
ইউনুস সরকার জুলাই আকাঙ্ক্ষা ধারণে ও দেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র রুপান্তরে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। ফ্যাসিস্ট হাসিনার রাষ্ট্রকাঠামো বজায় রেখে মুখে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বাক্যলাপ করা রীতিমতো হাস্যকর ব্যাপার! এটা ইউনুস সরকারের জুলাই আন্দোলনে আত্মত্যাগ করা হাজার হাজার শহীদদের সঙ্গে বেঈমানীও। চট্টগ্রাম ২৪ পদাতিক ডিভিশনের প্রেসক্রিপশনে পার্বত্য চট্টগ্রামকে সেনাশাসনের অধীনে রাখা কোনভাবেই একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নীতি হতে পারে না। এই নীতি মেনে নিয়ে ইন্টেরিম সরকার পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে প্রতারণা করেছে। দেশের শাসননীতিতে উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠীর প্রভাব জনগণের নিরাপত্তা ও নারী নিপীড়নের মাত্রাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ৫ মে বান্দরবানের থানচিতে খিয়াং জনগোষ্ঠীর নারীকে ধর্ষণের পর নৃশংসভাবে হত্যা, নিরীহ বম জনগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়ন-নিযার্তন ও চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে রাষ্ট্রীয় হেফাজতে বমদের হত্যার ঘটনা জুলাই আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচারহীনতার ম্যান্ডেট নিয়ে যেভাবে রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক সন্ত্রাসী কায়দায় অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, যেভাবে ধর্ষক ও অপরাধীরা দেশের আইন-বিচারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বারবার অপরাধ করার অবাধ স্বাধীনতা পাচ্ছে তা জুলাই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গঠিত হওয়া ইউনুস সরকারের জন্য বড় লজ্জার! গত ২৬ জুন কুমিল্লা মুরাদনগরের এক সংখ্যালঘু নারীকে গণধর্ষণ ও নগ্ন ভিডিও ধারণ করার ঘটনা সমগ্র দেশের জনগণকে হতবাক করেছে। এ ঘটনা দেশের জনগণ কতটা অনিরাপদ ও অনিশ্চয়তায় দিনযাপন করছে তার একটা ভয়াবহ বার্তা দেয়। দেশ কতটা রসাতলে গিয়েছে, মানুষকে হত্যা করা কতটা সহজ তা ইন্টেরিম সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত না হলে হয়তো বুঝা বড় দায় হতো। এ অবস্থায় চলতে থাকলে ইউনুস সরকারের প্রতি দেশের জনগণ আস্থা তো হারাবেই, একই সঙ্গে ফ্যাসিস্ট হাসিনার মতন নিকৃষ্ট শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন ড. ইউনুস।
পার্বত্য চট্টগ্রাম রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দমন-পীড়ন চালাবার পরিক্ষিত স্থান নয়। কর্তত্ববাদ কিংবা আধিপত্যবাদ বজায় রাখার লালসা ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যে উগ্র-বাঙালি জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী পাহাড়ি জাতিসত্তাগুলোর ওপর গণতান্ত্রিক শাসন বহির্ভূত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে চায়, সেনাশাসন জারী রাখতে চায় তা কোনভাবেই পাহাড়ি জনগণ মেনে নেবে না। ইন্টেরিম সরকারের উচিত সেই উগ্র ক্ষমতালিপ্সু গোষ্টীটিকে চিহ্নিত করে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া। পাহাড়িদের ভূমির অধিকার, নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিতের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশেষ ‘স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল’ ঘোষণা করা। অন্যথায় জুলাই অভ্যুত্থান বিরোধী ফ্যাসিস্ট হাসিনার দোসরদের দিয়ে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়ন-নির্যাতনের স্টীম রোলার জারী রাখার পরিণাম দেশের জন্য সুফল বয়ে আনবে না।
* সোহেল চাকমা, এজিএস, পিসিপি, কেন্দ্রীয় কমিটি।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।