মন্তব্য প্রতিবেদন

তারেক রহমানের “প্ল্যানে” পাহাড় আছে কি?

0

মন্তব্য প্রতিবেদন



বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ১৭ বছরের নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে গত ২৫ ডিসেম্বর দেশে ফিরেছেন। তার আগমন উপলক্ষে রাজধানীর ৩০০ ফিট নামক এলাকায় আয়োজিত সংবর্ধনা সভায় তিনি বলেছেন, “আই হ্যাভ অ্যা প্ল্যান ফর দ্য পিপল অফ মাই কান্ট্রি।”

তিনি বলেছেন, তিনি পাহাড়ের মানুষ, সমতলের মানুষ – মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, হিন্দুসহ সকলকে নিয়ে একটি নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চান। এটাই তার স্বপ্ন।

তারেক রহমান ২০০৭-৮ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। পরে তাকে যুক্তরাজ্যে নির্বাসনে যেতে বাধ্য করা হয়। সে সময় দেশের মানুষের মনে তার মা খালেদা জিয়ার সদ্য বিদায়ী সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি ও তার নিজের সমান্তরাল সরকার “হাওয়া ভবনের” কুকীর্তি ডগডগে ছিল। এ কারণে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি ঘটেছিল।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন সময় ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক হামলার কিছু চিত্র।

সেই পর থেকে বিএনপির শীর্ষ নেতা তারেক রহমানের ইতিবাচক রূপান্তর ঘটেছে কীনা তা এখনও অজানা। তবে তার দলের নেতাকর্মীদের বৃহৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের চরিত্রের মধ্যে যে আদৌ কোন পরিবর্তন (ইতিবাচক অর্থে) হয়নি তা গত দেড় বছরে সবার কাছে স্পষ্ট হয়েছে। ক্ষমতায় না যেতেই তারা চাঁদাবাজি ও দখলবাজির মহোৎসব শুরু করে দিয়েছে। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দলটির অভ্যন্তরীণ সংঘাতে ৪৩ জন নিহত হয়েছে বলে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানিয়েছে। (https://www.dw.com/bn) দলের এইসব বেপরোয়া নেতাকর্মীদের দিয়ে তারেক সাহেব দেশকে কীভাবে ধ্বংসের কিনারা থেকে উদ্ধার করবেন সেটা এক বিরাট প্রশ্ন।

এটা ঠিক, হাসিনার পতনের পরও ড. ইউনূসের দ্বিতীয় স্বাধীনতার কালেও পাহাড় ও সমতলের মানুষ এবং বিশেষ করে পাহাড়ি জনগণ মোটেই ভালো নেই। নিরাপত্তাহীনতা পাহাড় – সমতলে সর্বত্র। ল-লেসনেস, মব ভায়োলেন্স ইউনূসের ভাবমূর্তিকে ম্লান করে দিয়েছে এবং তার ও হাসিনা জমানার পার্থক্য প্রায় ঘুচিয়ে দিয়েছে। সে কারণে নিরাপদ বাংলাদেশের জন্য তারেক রহমানের “আই হ্যাভ অ্যা প্ল্যান” বক্তব্যে অনেকে আশ্বস্ত হতে চাইবে। কিন্তু তার সেই প্ল্যান কী তা তিনি স্পষ্ট করে বলেননি।

আমরা তার কাছে কিছু প্রশ্ন রাখতে চাই। তার প্ল্যানের মধ্যে কি পাহাড় এবং পাহাড়ি মানুষও আছে? গত ৫০ বছর ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে অলিখিত সামরিক শাসন চলছে। এখানে এখনও সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর বিশাল উপস্থিতি রয়েছে। প্রতিদিন সামরিক টহল ও তল্লাশি অভিযানের কারণে পাহাড়ি জনগণ চরম নিরাপত্তাহীন জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। হাসিনার পতনের পর গত দেড় বছরে তিনটি বড় ধরনের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ৭ জন পাহাড়ি নিহত, বেশ কয়েকজন আহত ও শত শত ঘরবাড়ি-দোকান ভষ্মীভূত হয়েছে। নিজ মাতৃভূমিতে পাহাড়িরা আজ কেবল সংখ্যালঘু নয়, তারা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। এই অবস্থা থেকে তাদের মুক্ত করতে আপনার “প্ল্যানে” কী আছে? অপারেশন উত্তরণ বা অলিখিত সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে পাহাড়ে প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসন কায়েম করার প্ল্যান আপনার আছে কি?

ফ্যাসিস্ট হাসিনার দুঃশাসনে অনেক পাহাড়ি আপনার মতো দেশান্তরী হতে বাধ্য হয়েছেন। এমনকি তার পতনের পর ড. ইউনূসের আমলেও অনেকে নিরাপত্তাহীনতার কারণে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। এখনও তারা দেশে ফিরতে পারেননি। তাদের স্বদেশ ভূমিতে ফেরার জন্য আপনার “প্ল্যানে” কী আছে?

১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের ২৮ বছর পরও পাহাড়ে শান্তি এখনও অধরা। পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে দীর্ঘ কয়েক দশকের পুঞ্জিভূত সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান খোঁজার প্ল্যান কি আছে আপনার?

সর্বোপরি আপনার “প্ল্যানে” পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার, সেটলারদের সমতলে পুনর্বাসন, পাহাড়ি জাতিগুলোর সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও ভূমি অধিকারসহ পাহাড়ে স্বশাসন ব্যবস্থা কায়েম এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ ও সকল হত্যাকান্ডের বিচারের মতো বিষয়গুলো আছে কি?

তারেক রহমান সম্বর্ধনা সভায় বলেছেন আমেরিকার সিভিল রাইটস একটিভিস্ট মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের “আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম” এর মতো তার “আই হ্যাভ অ্যা প্ল্যান” আছে। মার্টিন লুথার কিং ১৯৬৩ সালে “মার্চ অন ওয়াশিংটন”-এ দেয়া I have a dream বক্তব্যে বলেছিলেন, ১৮৬৩ সালের ১ জানুয়ারি আব্রাহাম লিংকন কর্তৃক এমানসিপেশন প্রোক্লেমেশন (Emancipation Proclamation) স্বাক্ষরের ১০০ বছর পরও “নিগ্রোরা এখনও আমেরিকান সমাজের কোনায় ধুঁকে ধুঁকে মরছে এবং নিজ দেশে নির্বাসিত জীবন যাপন করছে।”

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের অবস্থাকেও আজ ১৯৬৩ সালের আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গদের চাইতে ভালো বলা যাবে না। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর ৫৪ বছর পরও পাহাড়ি জনগণ আজও সকল মানদণ্ডে পরাধীন – এখনও তারা অন্যায়-অবিচার ও নিপীড়ন-নির্যাতনের শৃঙ্খলে বন্দী। এই বন্দীদশা থেকে তারেক রহমান কি তাদেরকে মুক্তি দিতে পারবেন?

(২৮ ডিসেম্বর ২০২৫)



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More