দীঘিনালায় শহীদ ধন রঞ্জন, জুনান, রুবেল ও অনিক-এর স্মরণসভা

সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত শহীদ ধন রঞ্জন চাকমা, জুনান চাকমা, রুবেল ত্রিপুরা ও অনিক চাকমার স্মরণে দীঘিনালায় স্মরণসভার আয়োজন করা হয়।
দীঘিনালা প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
শুক্রবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪
সম্প্রতি গত ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি সদর ও রাঙামাটিতে সেনা-সেটলারদের হামলায় ও সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত শহীদ ধন রঞ্জন চাকমা, জুনান চাকমা, রুবেল ত্রিপুরা ও অনিক চাকমার স্মরণে খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় স্মরণসভা করেছে দীঘিনালা এলাকাবাসী।
আজ ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, শুক্রবার সকাল ১০:৩০টার সময় দীঘিনালা উপজেলার উদাল বাগানের এক খোলা মাঠে এই স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়।
স্মরণসভার ব্যানার শ্লোগান ছিল “তোমরা মৃত্যুঞ্জয়ী, খুনীদের রেহাই নেই, শহীদের রক্তে সিক্ত ঐক্য সংহতি হবে সুদৃঢ়।”
স্মরণসভা মঞ্চের পাশে চার শহীদ ধন রঞ্জন চাকমা, জুনান চাকমা, রুবেল ত্রিপুরা ও অনিক চাকমার প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে রাখা ছিল।

দীঘিনালা এলাকাবাসীর উদ্যোগে আয়োজিত স্মরণসভায় সভাপতিত্ব করেন দীঘিনালা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান চন্দ্র রঞ্জন চাকমা ও সভা সঞ্চালনা করেন কৃপা রঞ্জন চাকমা।
এতে আরো মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন দীঘিনালা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ধর্ম জ্যোতি চাকমা, ইউপিডিএফের দীঘিনালা ইউনিটের সমন্বয়ক মিল্টন চাকমা, দীঘিনালা যুব সমাজের প্রতিনিধি রাহুল চাকমা ও সংঘাত ও বৈষম্যবিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন-এর কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক কৃপায়ন ত্রিপুরা।
স্মরণসভা শুরুতে শহীদদের স্মরণে দাঁড়িয়ে ১ মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।

রাহুল চাকমা শহীদদের স্মরণ করে বলেন, গত ১৯ তারিখ সেটলাররা যখন হামলা করছিল তখন এক বোন ফেসবুক লাইভে যখন তাদেরকে বাঁচানোর আকুতি জানাচ্ছিল তখন আমাদের বুক কেঁপে ওঠে। আমরাও বিভিন্ন এলাকার জনগণও তাদের রক্ষার জন্য গিয়েছিল।
তিনি সকলকে ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমরা দলগত আর বিভেদ চাই না। আমাদের কোন ভাই যদি আক্রান্ত হয় তাহলে আমাদের বসে থাকলে হবে না। আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকতে চাই।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, গত ১৯ তারিখ হামলায় বাঙালিরা বেছে বেছে আমাদের পাহাড়িদের দোকানগুলো আগুন লাগিয়ে দিয়েছে, লুটপাট চালিয়েছে। সেদিন আমরা মাইনি ব্রিজে গিয়ে রাস্তায় না নামলে তারা আরো অনেক গ্রাম জ্বালিয়ে দিতো। তাহলে হামলা আরো বেশি ভয়াবহ আকার ধারণ করতো।

তিনি বলেন আগের শাসকগোষ্ঠিও আমাদের ভালেভাবে থাকতে দেয় নাই, বর্তমান শাসকগোষ্ঠিও দিচ্ছে না।
তিনি বলেন, বর্তমানে দেশ-বিদেশে আমাদের পাহাড়িদের উপর হামলা, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে মিছিল-মিটিং করছে। আমাদেরকে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মাধ্যমে টিকে থাকতে হবে। আমরা এদেশে থাকতে চাই। পার্বত্য চট্টগ্রাম আমাদের জন্মভূমি। এখানে অধিকার নিয়েই আমরা বেঁচে থাকতে চাই, বেঁচে থাকবো।
ধর্ম জ্যোতি চাকমা বলেন, দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। তিনি পাহাড়ি ছাত্রদের চলমান আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেন, ছাত্ররা যে সংগঠিত হয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে আমি তাদের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাই। তাদের এ আন্দোলন যাতে আরো সামনে এগিয়ে যেতে সেজন্য তিনি শুভ কামনা করেন।
মিলটন চাকমা বলেন, শহীদদের স্মরণ করে বলেন, মানুষের প্রয়োজনে মানুষ। দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি সদর ও রাঙামাটিতে নিজেদের জাতিকে রক্ষার জন্য ধন রঞ্জন, জুনান, রুবেল, অনিক জীবন দিয়েছেন। তারাতো নিজেদের বাড়িতে বসে থাকতে পারতেন। আমরা পত্রিকার মাধ্যমে জুনান চাকমার মায়ের কথা শুনেছি, কিভাবে জুনান তার মাকে বলে স্বজাতি রক্ষার জন্য গিয়েছিল। একইভাবে অনিকের বিষয়েও জানতে পেরেছি।
তিনি আরো বলেন, গত ১৯ তারিখ যে দীঘিনালায় পাহাড়িদের ওপর হামলা ও দোকানপাট-ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে এর মূল কারণ হচ্ছে ছাত্রদের যে আন্দোলন চলছে তা ব্যাঘাত সৃষ্টি করার জন্য।
তিনি বলেন, দলগুলোর মধ্যে যে গ্যাপ রয়েছে তা দূর করতে ছাত্ররা যে দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে আমি আশা করি তারা নিশ্চয় এতে সফল হবেন।
সবাইকে ছাত্র-যুবকদের সাথে থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, শেখ হাসিনার পতন আন্দোলনে যেভাবে অভিভাবকরা ছাত্র-ছাত্রীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, আমাদের বাপ-ভাই, মা-বোনদের কাছ থেকেও আমরা সেটা আশা করি।
তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের ওপর যে হামলা তার প্রতিবাদে বর্তমানে দেশ-বিদেশে আন্দোলন হচ্ছে, বিক্ষোভ হচ্ছে। আমাদের ছাত্র সমাজ, যুব সমাজকেও বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
কৃপায়ন ত্রিপুরা শহীদদের স্মরণ করে শহীদ পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান।
তিনি বলেন, বিগত ১৫-১৬ বছর ধরে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকার যখান নাগরিকদের বাকস্বাধীনতা হরণ করে রেখেছিল তারই প্রতিবাদে যখন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন সারা বাংলাদেশ আন্দোলন গড়ে তুলেছিল এবং ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ রাষ্ট্রর যাত্রা হয়।

বক্তব্য রাখছেন ছাত্র আন্দোলনের নেতা কৃপায়ন ত্রিপুরা
শেখ হাসিনার সময়ে আমরা পাহাড়িরা নিপীড়ন-নির্যাতনের মধ্যে ছিলাম। কল্পনা চাকমাকে কীভাবে অপহরণ করা হয়েছে সে ইতিহাস আমাদের সবার জানা। গত ৫ আগস্টের সরকার পরিবর্তনের পর আমরা ছাত্ররা যখন খাগড়াছড়িতে কল্পনা চাকমার গ্রাফিতি আঁকতে যাই, তখন সেনাবাহিনী আমাদের ওপর অতর্কিতে হামলা চালায়, একজনকে ধরে নিয়ে যায়। এর পরবর্তীতে পাহাড়ি ছাত্ররা রাস্তায় নামতে বাধ্য হয় এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে।
তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে নানা কূটকৌশলে আমাদেরকে দলগত ও জাতিগত সংঘাত জিইয়ে রেখে ভাগ করে রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা ছাত্র-জনতারত মাধ্যমে সকলের ঐক্যের মাধ্যমে আমাদের দাবি আদায় করতে চাই। তাই এতে ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণ দরকার।
তিনি বলেন, আমাদেরকে দমিয়ে রাখার পাঁয়তারার অংশ হিসেবে দীঘিনালায় একটি মিছিলের মাধ্যমে সেটলাররা পাহাড়িদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট জ্বালিয়ে দেয়াসহ লুটপাট করা হয়েছে। এ ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে সেনাবাহিনী বাধা হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিরোধ করতে যাওয়া ধন রঞ্জন চাকমাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার বিরুদ্ধে খাগড়াছড়ি সদরে এলাকার ছাত্র-জনতা যখন প্রতিবাদ করতে যায় তখন অতর্কিতে সেনাবাহিনী সেখানে হামলা করে এবং এর প্রতিবাদে স্বনির্ভরে যখন ছাত্র-জনতা মিছিল বের করলে সেনাবাহিনী ওই মিছিলের গুলি চালায়। এত শহীদ হয় জুনান চাকমা ও রুবেল ত্রিপুরা। আর আহত হয় অনেকে, যারা এখনো চিকিৎসাধীন রয়েছে।
অপরদিকে খাগড়াছড়িতে রাতের হত্যাকাণ্ড ও দীঘিনালা হামলার প্রতিবাদে ২০ সেপ্টেম্বর যখন রাঙামাটিতে ছাত্ররা যখন শান্তিপূর্ণ মিছিল করছিল তখন সেই মিছিলে সেটলাররা অতর্কিতে হামলা চালিয়ে অনিক চাকমাকে জঘণ্যভাবে পিটিয়ে হত্যা করে।
তিনি বলেন, ছাত্ররা নিজেদের জন্য মিছিলে যাইনি, জাতির জন্যই তারা মিছিলে গিয়েছিল। আমরা আমাদের অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। আমরা নিজ নিজ জাতিগত পরিচয়ে বেঁচে থাকতে পাই।
তিনি সবাইকে অধিকার প্রতিষ্ঠা জন্য ছাত্রদের পাশে থাকার আহ্বান জানান এবং বলেন, যতদিন অধিকার প্রতিষ্ঠা না হয় ততদিন ছাত্ররা রাজপথে থাকবে। এ সময় তিনি অধিকার আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাজপথে থাকতে ছাত্র জনতাকে শপথ বাক্য পাঠ করান।
শহীদ ধন রঞ্জন চাকমার ছেলে বড় চোগা চাকমা বলেন, আজকে আমার পিতা শহীদ হওয়ার ফলে অনেক মানুষ সম্মান জানাচ্ছেন। এজন্য আমি সকলকে সকলকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

বক্তব্য রাখছেন দীঘিনালা ইউপি চেয়ারম্যান চন্দ্র রঞ্জন চাকমা
সভার সভাপতি ও চেয়ারম্যান চন্দ্র রঞ্জন চাকমা সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান। তিনি ছাত্রদের আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে সঠিক আন্দোলনে মৃত্যু পর্যন্ত থাকবেন বলে আশ্বস্ত করেন।
এদিকে, আজ শহীদ ধন রঞ্জন চাকমার সাপ্তাহিক শ্রাদ্ধক্রিয়া অনুষ্ঠানও আয়োজন করা হয়েছে।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।