দীঘিনালায় সেনা অপারেশনের নামে ঘরবাড়ি তল্লাশি-হয়রানি-ধর্মীয় পরিহানির প্রতিবাদে বিক্ষোভ

দীঘিনালা প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
শুক্রবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৫
‘সেনা অপারেশনের নামে নির্বিচারে ঘরবাড়ি তল্লাশি, হয়রানি, জোরজবরদস্তি, খেতের ফসলের ক্ষতিসাধন, বৌদ্ধ বিহার অপবিত্রকরণ ও ধর্মীয় পরিহানির’ প্রতিবাদে দীঘিনালায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আজ শুক্রবার (১৪ নভেম্বর ২০২৫) সকাল ১০টায় “দীঘিনালার সচেতন ছাত্র-যুব-নারী সমাজ” এর ব্যানারে দীঘিনালা উপজেলার পুকুরঘাট হতে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি উদাল বাগান স্কুল হয়ে সুপারি বাগান চৌমুহনী মোড়ে গিয়ে সমাবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হয়।

সমাবেশে ছাত্র নেতা রিটন চাকমা সভাপতিত্বে ও যুবনেতা সুজন চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক দীপুলাক্ষ চাকমা, বাবুছড়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য প্রতিভা চাকমা ও কলেজ ছাত্রী মেনাকী চাকমা।
সমাবেশে দীপুলাক্ষ চাকমা বলেন, ১৯৪৭ থেকে ’৭১ পর্যন্ত এদেশের বাঙালি জাতি পাকিস্তানীদের অত্যাচার-নিপীড়নের শিকার হয়েছিল। যার কারণে তারা স্বাধীনতার সংগ্রাম করতে বাধ্য হয়েছিল। একটি জাতি যখন অন্য একটি জাতির কাছে অত্যাচার নিপীড়নের শিকার হয় তখন সে জাতির মানুষ আত্মনিয়ন্ত্রাধিকার নিয়ে সচেতন হয়ে ওঠে।
যে বাঙালি জাতি অন্য জাতির কাছে অত্যাচার-উৎপীড়নের শিকার হয়ে সংগ্রাম করে স্বাধীনতা লাভ করেছে, সেই জাতি এখন পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ছোট ছোট জাতিগুলোর ওপর পাকিস্তানীদের কায়দায় নিপীড়ন চালাচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর আমরাও মনে করেছিলাম, স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে শান্তিতে বসবাস করতে পারবো, সুন্দরভাবে জীবন-যাপন করতে পারবো। কিন্তু দুঃখের বিষয় তারা সেই পাকিস্তানীদের অত্যাচারের কথা ভুলে গিয়ে উল্টো তাদের মতো করে আমাদের ওপর নিপীড়ন চালাচ্ছে। আমাদের ভূমি বেদখল করছে, ধর্মীয় আগ্রাসন, সাংস্কৃতিক আগ্রাস চালাচ্ছে। কাজেই আমাদের বেঁচে থাকার জন্য, সুন্দরভাবে বসবাসের জন্য, আমাদের অধিকার আদায়ের জন্য, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জাতিসত্তাগুলোর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য, জাতিগত পরিচয়ের স্বীকৃতির জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করতে হবে। আমরা সুন্দরভাবে বসবাস করতে চাই।’
তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্যে বলেন, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শান্তরক্ষী হিসেবে সুনাম অর্জন করেছে। কিন্তু সেই সেনাবাহিনী কেন নিজের দেশে অন্য একটি সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার-নিপীড়ন চালাচ্ছে। ফলে তাদের শান্তি রক্ষার কথাটিও এখন ‘লজ্জাজনক’ মনে হয়।’

অবসরপ্রাপ্ত এই শিক্ষক বলেন, ‘আমরা অব্যশই সকলে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চাই, শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে চাই। সরকারের উচ্চ নেতৃত্ব এবং সেনাবাহিনীও এই কথা বলে থাকেন। কিন্তু শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করতে গেলে যে জিনিসটি দরকার সেটি হচ্ছে একে অপরের প্রতি সহমর্মিতা ও অধিকারের ব্যাপারে সচেতনতা। যদি আমার জমি দখল করা হয়, আমার বাগান কেটে দেওয়া হয়, আমার বাড়ি তল্লাশি করতে গিয়ে হয়রানি করা হয়, আমার জাতিগত পরিচয় মুছে দেয়ার চেষ্টা করা হয় তাহলে সেখানে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জায়গা কোথায়? শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান তখনই হয়, যখন একটি বৃহৎ জাতি সংখ্যালঘু জাতিগুলোর অধিকারের প্রতি সচেতন হয়, সহমর্মিতা প্রদর্শন করে। অন্যথায় সে যতই ক্ষুদ্র জাতি হোক না কেন তার বেঁচে থাকার জন্য এবং বৃহৎ জাতির অত্যাচরের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে বাধ্য হয়। ঠিক একইভাবে আমরাও আজকে রাজপথে নেমে প্রতিবাদ করতে, এসব কথা বলতে বাধ্য হয়েছি। না হলে আমাদের রাস্তায় নেমে এভাবে চিৎকার করে প্রতিবাদ করার প্রয়োজন হতো না।
‘আজকে কেন আমাদের এই প্রতিবাদের জন্য রাস্তায় নামতে হলো, কারণ আমাদের অধিকার থাকছে না, আমাদের জায়গা ঠিক থাকছে না, ধর্ম ঠিক থাকছে না, আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব বিলুপ্ত হচ্ছে। আমাদের মাটি, আমরা যে বাড়িতে বসবাস করি, যে ঘরের ভিটা আমার রয়েছে, সে ঘরের ভিটা দখল হচ্ছে। কাজেই, সেই কারণে আমাদের আজকে প্রতিবাদ করে এসব কথা বলতে হচ্ছে। যতদিন পর্যন্ত এসব বিষয় শান্তপূর্ণভাবে নিরসন হবে না, ততদিন পর্যন্ত আমাদের এভাবে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।’
তিনি বলেন, তরুণ প্রজন্মকে জাতীয় চেতনা লালন করতে হবে, জাতীয় অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।
জনগণের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, প্রতিটি আঘাত, প্রতিটি অন্যায়, অত্যাচারের ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিবাদ করতে হবে।
তিনি চলমান অন্যায়, অত্যাচার বন্ধ করার দাবি জানান এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনধিসহ প্রথাগত মুরুব্বী হেডম্যান, কার্বারীদের প্রতি আন্দোলন সংগ্রামে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান।

ইউপি সদস্য প্রতিভা চাকমা বলেন, আমাদের অস্তিত্ব রক্ষা হচ্ছে না, সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে জীবন-যাপন করার মতো পরিবেশ আর আমাদের নেই। তাই সেনা ক্যাম্প স্থাপনের নামে যে সমস্ত বিহার ও গ্রামবাসীদের বাস্তুভিটা দখল করার চেষ্টা চলছে তা ঐক্যবদ্ধভাবে রোধ করতে হবে।
তিনি বলেন, আজকে হয়তো একজনের জায়গা দখল করা হবে, কালকে আরেকজনের জায়গা বা আমার জায়গা দখল করা হবে- এভাবে আমরা কোথায় যাবো। আমাদের আর যাবার জায়গা নেই। বাঁচতে হলে এই জায়গায় বাঁচতে হবে, মরতে হলে এখানে মরতে হবে।
তিনি অস্তিত্ব ও ভূমি রক্ষায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনে শরীক হওয়ার আহ্বান জানান।
ছাত্রনেতা রিটন চাকমা বলেন, বক্তারা বলেন, গুলি করে, হত্যা করে সেনাবাহিনী আমাদের দমিয়ে রাখতে পারবে না। জাতির অস্তিত্ব, ভূমি ও মা-বোনের ইজ্জত রক্ষার্থে আমাদের রাজপথে নামতে হবে।
তিনি বাবুছড়া ইউনিয়নে অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প স্থাপনে যে সকল সেনা সদস্যদের নিয়োজিত করা হয়েছে তাদেরকে অবিলম্বে সরিয়ে নেয়ার জন্য সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান।
কলেজ ছাত্রী মেনাকী চাকমা চাকমা বলেন, বাড়িঘরে তল্লাশির নামে নারীদের, বৃদ্ধদের, ছাত্রদের যেভাবে হয়রানি করা হচ্ছে, তা কোনো সভ্য রাষ্ট্রে কাম্য নয়। আমাদের ঘর আমাদের নিরাপদ আশ্রয়-সেটাকে আতঙ্কের জায়গা বানানো বন্ধ করতে
সেনা অপারেশনের নামে জনগণকে হয়রানি অবিলম্বে বন্ধের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, গ্রাম থেকে গ্রাম ঘেরাও, রাতের অন্ধকারে হানা-এসব শান্তিপ্রিয় জনগণের জীবনে অন্তহীন আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। আমাদের স্কুলঘর দখল করে সামরিক অবস্থান নেওয়া সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভেতরে বন্দুকের ছায়া নয়, বইয়ের আলো থাকা উচিত। শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করে কোনো উন্নয়ন হয় না। সেনা অপারেশনের নামে ধর্মীয় পরিহানি বন্ধ করতে হবে। বৌদ্ধ বিহার অপবিত্র করা, পূজাস্থলে তল্লাশির নামে অবমাননা-এসব বন্ধ করতে হবে।
তিনি সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, পাহাড় militarize করে শান্তি আনা যায় না। শান্তি আসে ন্যায়বিচার, সম্মান ও বিশ্বাস থেকে।
তিনি তার বক্তব্যে স্পষ্টভাবে বলেন, “ইউপিডিএফ নয়, জনগণের চোখে আসল সন্ত্রাসী আজ সেই বাহিনী, যারা জনগণের ঘরবাড়ি তছনছ করছে, ক্ষেতের ফসল নষ্ট করছে, কাউকে কাউকে অকারণে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।”
তিনি এসব ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত ও দায়ীদের বিচারের দাবি জানান।
মিছিল ও সমাবেশে অংশগ্রহণকারীরা “অবিলম্বে সেনা অপারেশনের নামে হয়রানি বন্ধ কর, সেনা অপারেশনে স্কুলঘর দখল করা চলবে না, সেনা অপারেশনে ধর্মীয় পরিহানি বন্ধ কর, সেনা কর্তৃক বিহার অপরিত্রকরণ বন্ধ কর, বাড়িঘরে তল্লাশির নামে হয়রানি বন্ধ কর, সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরে যাও, ইউপিডিএফ নয়, সেনাবাহিনীই আসল সন্ত্রাসী, অবিলম্বে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বন্ধ কর, জনগণকে হয়রানি নিপীড়ন বন্ধ কর, পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্তশাসন দাও, সেনা কর্তৃক নষ্ট করা ফসলের ক্ষতিপূরণ দাও” ইত্যাদি শ্লোগান সম্বলিত প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।
