দীঘিনালার বাবুছড়ায় বিজিবি কর্তৃক উচ্ছেদ হওয়া ২১ পরিবার ও দীঘিনালা ভূমি রক্ষা কমিটির যৌথ সংবাদ সম্মেলন
সিএইচটিনিউজ.কম
দীঘিনালা: দীঘিনালার বাবুছড়ায় বিজিবি কর্তৃক উচ্ছেদ হওয়া ২১ পরিবার ও দীঘিনালা ভূমি রক্ষা কমিটি এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে যত্ন মোহন কার্বারী পাড়া থেকে বিজিবির ৫১ নং ব্যাটালিয়নের সদস্যদের প্রত্যাহার ও এই ব্যাটালিয়নের জন্য জমি অধিগ্রহণ বাতিল করাসহ ৫ দফা দাবি জানিয়েছে।
আজ ১ জুলাই মঙ্গলবার বেলা ২:৩০টায় বাবুছড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে আহূত সংবাদ সম্মেলনে উচ্ছেদ হওয়া পরিবারগুলোর মধ্য থেকে রিপন চাকমা লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান।
“আমরা নিজ বাড়িঘরে ফিরে যেতে চাই” শিরোনামে লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, “হামলা ও উচ্ছেদের পর আমরা ২১ পরিবারের ৮৪ জন এই বাবুছড়া হাইস্কুলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছি। এখানে আমরা স্কুলের দুইটি কক্ষে গাদাগাদি করে মানবেতর জীবন যাপন করছি বললেও কম বলা হয়। এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অনেকে এর মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এই ৮৪ জনের মধ্যে রয়েছে ৪ জন কলেজ পড়ুয়া ছাত্রী, ৯ জন হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রী ও ৭ জন প্রাইমারী লেভেলের ছাত্রছাত্রী। তাদের সবার পরাশুনা এখন বন্ধ হয়ে গেছে।”
তাদের বর্তমান অবস্থার চিত্র তুলে ধরে তিনি আরো বলেন, “বিজিবির বাধার কারণে আমরা আমাদের বাড়িতে যেতে পারছি না। হামলার পর থেকে তারা আমাদের বাড়িতে ঢুকতে দিচ্ছে না। আমাদের বাড়িগুলোও তাদের দেয়া কাঁটাতারের বেড়ার বাউন্ডারীর মধ্যে ঢোকানো হয়েছে। বাড়িতে আমাদের গরু-ছাগল, হাস-মুরগী, শুকর ও ধান-চাল রয়েছে। পরণের কাপড় চোপড় পর্যন্ত আনতে দেয়া হয়নি।
“ত্রাণ দেয়া দূরের কথা, আজ পর্যন্ত সরকার বা প্রশাসনের কেউ আমাদের দেখতে আসেনি। আমরা যেন এই দেশের নাগরিক নই। যেন আমরা না খেয়ে মারা গেলেই তারা খুশী হন। আমাদের প্রতি তাদের এই উপেক্ষা দেখে আমাদের তাই মনে জাগে।
“এলাকার সহৃদয় লোকজন আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করছেন। কিন্তু তাদেরও তো আমাদের মতো পরিবার, সংসার রয়েছে। তারাও আমাদের মতো গরীব; তাদের অঢেল সম্পত্তি নেই যে, তারা দীর্ঘদিন আমাদের এভাবে খাওয়াতে পারবেন।
“উচ্ছেদ হওয়ার পর থেকে আমাদের চাষবাস সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। অথচ এখন চাষের ভরা মৌসুম। চাষাবাদ না হলে কিভাবে জীবন চলবে, আমরা কোথায় যাবো, কবে নিজ বাড়িতে ফিরতে পারবো – এক চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে আমাদের ফেলে দেয়া হয়েছে। আমাদের ভবিষ্যত এখন অন্ধকার।
“মামলার কারণে গ্রামের অনেকে পালিয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। তাদের খোঁজে ও লোকজনের মনে ভয়ভীতি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বিজিবি ও আর্মিরা নিয়মিত গ্রামে গ্রামে হানা দিচ্ছে। ফলে আমাদের ছাড়াও অনেকের স্বাভাবিক জীবন যাপন ও চাষবাস বন্ধ হয়েছে।
“বিজিবি হামলার পর ২ নং বাঘাইছড়ি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়টি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। স্কুলটিও বিজিবি তাদের কাঁটা তারের বাউন্ডারীর ভিতরে ঢুকিয়েছে। ফলে স্কুলের ১০৫ জন ছাত্রছাত্রীর শিক্ষা জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।”
১০ জুন বিজিবির উপর হামলার অভিযোগ খণ্ডন করে তিনি বলেন, “বিজিবির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, গ্রামবাসীরা তাদের উপর হামলা করেছে। এর চাইতে চরম মিথ্যা আর থাকতে পারে না। বিজিবি হলো একটি সশস্ত্র বাহিনী। আর এই অস্ত্রধারী বাহিনীর কয়েক শ’ সদস্যের উপর “হামলা” করতে গেছে পঞ্চাশ ও ষাট বছর বয়স্কা কয়েকজন নারী! তাদের এই বক্তব্য কল্প কাহিনীকেও হারা মানায়। আসল সত্য ঘটনা উপরে ইতিমধ্যে বলা হয়েছে। এখানে যা আরো যোগ করতে হবে তা হলো, বিজিবির সদস্যরা বন্দুকের বাট দিয়ে এমন নির্দয়ভাবে মারধর করে যে, এতে তাদের বন্দুক পর্যন্ত ভেঙে যায়। আমরা হামলার পর বিজিবির বিরুদ্ধে থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি। এক কথায় যারা অন্যায়ের প্রতিবাদকারী, যারা হামলার শিকার ও আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধ্য হলাম, তারা হয়ে গেলাম অপরাধী, অপরদিকে যারা আসল হামলাকারী তারা হয়ে গেলেন ভিকটিম।”
তিনি বলেন, গত ১৪ মে রাতের অন্ধকারে বিজিবির ৫১ নং ব্যাটালিয়নের সদস্যরা যত্ন মোহন কার্বারী পাড়া ও শশী মোহন কার্বারী পাড়ায় আমাদের জমি জোরপূর্বক দখল করে নেয়। এরপর গত ১০ জুন সকাল ১০টায় বিজিবির ৫১ নং ব্যাটালিয়নের কমান্ডার লে: ক: আবুল কালাম আজাদ দীঘিনালার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় মুরুব্বীদেরকে চা চক্রে আমন্ত্রণ জানান। এতে দীঘিনালা উপজেলা চেয়ারম্যান নব কমল চাকমা, বাবুছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুগতপ্রিয় চাকমা ও সাবেক চেয়ারম্যান পরিতোষ চাকমাসহ ২০ – ২৫ জন মুরুব্বী যোগ দেন। উক্ত চা চক্রে বিজিবি কর্তৃক ভূমি দখলকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা হয় এবং লে: ক: আবুল কালাম আজাদ সমস্যা সমাধানের জন্য তাদেরকে অনুরোধ জানান। নব কমল চাকমাসহ উপস্থিত মুরুব্বীরা উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের জন্য এক সপ্তাহ সময় নেন।”
“কিন্তু বিকেল ৪টার দিকে গ্রামের কয়েকজন নারী তাদের জমিতে কলা গাছের চারা রোপন করতে গেলে বিজিবি সদস্যরা বাধা দেয়। নারীরা এর প্রতিবাদ করলে বিজিবি সদস্যরা তাদেরকে মারধর করে। পরে গ্রামের লোকজন জড়ো হয়ে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালে বিজিবি, পুলিশ ও বাঙালি শ্রমিকরা তাদের উপর রাবার বুলেট, টিয়ার গ্যাস, বন্দুকের বাট ও লাঠি দিয়ে আক্রমণ করে। এতে ১৮ জন গ্রামবাসী আহত হয়, যাদের বেশীর ভাগ নারী ও বয়স্ক মহিলা। গুরুতর আহত চার নারীকে খাগড়াছড়ি হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়।
এই ঘটনার পরদিন বিজিবি ১১১ জনের নাম উল্লেখ করে ১৫০ জন গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে দীঘিনালা থানায় মামলা দায়ের করে। এই মামলায় ৫১ নং দীঘিনালা মৌজার হেডম্যান প্রান্তর চাকমা, বাবুছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুগত প্রিয় চাকমা ও সাবেক চেয়ারম্যান পরিতোষ চাকমাসহ এলাকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, মুরুব্বী ও বৃদ্ধ পুরুষ-মহিলাকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যাদের অনেকের নাম ও পরিচয় বিজিবির জানার কথা নয়। পুলিশ এই বানোয়াট মামলার সূত্র ধরে গুরুতর ৪ নারীকে খাগড়াছড়ি হাসপাতাল থেকে ও অন্য ৬ জন বৃদ্ধকে গ্রেফতার করে। এদের মধ্যে তিন জন জামিন পেলেও, একজন নাবালিকাসহ বাকিদেরকে এখনো জেলে আটক রাখা হয়েছে।”
সরকার, স্থানীয় প্রশাসন ও বিজিবির কাছে প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, “কেন আমাদেরকে বার বার নিজ জায়গা জমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে? আমরা কাপ্তাই বাঁধের কারণে গত শতকের ৬০ দশকে অর্থাৎ পাকিস্তান আমলে একবার উচ্ছেদ হয়েছিলাম। তার পর আমরা বা আমাদের পূর্বপুরুষরা দীঘিনালার এই জায়গায় এসে বসতি গড়ে তুলি। তখন এই এলাকা ছিল ঘন বনজঙ্গলে আচ্ছাদিত। ছিল বাঘ ভালুকসহ বিভিন্ন হিংস্র প্রাণীর আবাস। আমরা এই ধরনের বৈরী পরিবেশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এলাকাটি বাসযোগ্য করে গড়ে তুলি। বহু কঠিন পরিশ্রম করে চাষের জমি সৃষ্টি করি। কিন্তু এখানেও আমরা সুখে থাকতে পারছি না। ৮০র দশকে ঘরবাড়ি ছেড়ে ভারতে শরণার্থী হতে হলো। ১৯৯৮ সালে সেখান থেকে ফিরে এসে নতুনভাবে জীবন শুরু করি। কিন্তু কয়েক বছর যেতে না যেতে আবার আমাদের জমি কেড়ে নেয়ার ষড়যন্ত্র হলো এবং অবশেষে গত ১৪ মে বিজিবি জোর করে আমাদের জমি কেড়ে নিলো। আর আমরা আবার পথের ভিখেরী হয়ে গেলাম। আমাদের জীবন কি এভাবে উচ্ছেদ হতে হতে শেষ হয়ে যাবে? আমরা কি এদেশের নাগরিক নই? কেন আমাদেরকে একটুও শান্তিতে থাকতে দেয়া হচ্ছে না? আমরা তো আপনার সরকারের কাছ থেকে একটু শান্তি ছাড়া অন্য কিছু চাইছি না।”
তিনি উচ্ছেদ হওয়া ২১ পরিবার ও দীঘিনালা ভূমি রক্ষা কমিটির পক্ষে পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরেন। এগুলো হলো: ১। আমাদের জমির বেদখলদার বিজিবির ৫১ নং ব্যাটালিয়নের সদস্যদের অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে এবং জেলা প্রশাসনের অবৈধ জমি অধিগ্রহণ বাতিল করে আমাদের জমি ফিরিয়ে দিতে হবে। ২। গত ১০ জুনের হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিজিবির দেয়া মিথ্যা মামলা তুলে নিতে হবে; হামলার সাথে জড়িত বিজিবি, পুলিশ ও সেটলারদের গ্রেফতার করে আইন অনুযায়ী দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে; এবং হামলায় আহতদের যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ৩। বিজিবির দেয়া উক্ত মামলায় গ্রেফতারকৃতদের অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। ৪। গ্রামে গ্রামে সেনা ও বিজিবির টহলের নামে জনগণের মধ্যে ভীতি ও আতঙ্ক ছড়ানো বন্ধ করতে হবে। ৫। বিজিবি কর্তৃক উচ্ছেদ হওয়ার কারণে আমরা যারা আর্থিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে ক্ষতির শিকার হয়েছি, তাদেরকে যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন ৪ নং দীঘিনালা ইউপি চেয়ারম্যান চন্দ্র রঞ্জন চাকমা, ৫ নং বাবুছড়া ইউপি চেয়ারম্যান সুগতপ্রিয় চাকমা, উচ্ছেদ হওয়া পরিবারের সদস্য সুদর্শনা চাকমা, গোপা চাকমা এবং বাবুছড়া ইউপির মেম্বারবৃন্দ।
এ সময় চন্দ্র রঞ্জন চাকমা, সুগতপ্রিয় চাকমা, ১০ জুন বিজিবির হামলায় আহত গোপা চাকমা ও সুদর্শনা চাকমা সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।
————–
সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।