দীঘিনালায় হাইর্কোটের নির্দেশ অমান্য করে বিজিবির সদর দপ্তর নির্মাণের কাজ চলছে

0

সিএইচটি নিউজ ডটকম
বিশেষ রিপোর্ট: মহামান্য হাইকোর্টের দেয়া স্থিতাবস্থার আদেশ অমান্য করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-এর ৫১ ব্যাটালিয়ন দীঘিনালায় তাদের বেদখলকৃত জমিতে ইমারত নির্মাণ ও বুলডোজার দিয়ে মাটি  কাটার ফলে পার্শ্ববর্তী ভূমি মালিকরা ক্ষতির শিকার হচ্ছে। এছাড়া বিজিবির পেশী শক্তির কাছে আইন পরাজিত হওয়ায় উচ্ছেদ হওয়া ২১ পরিবারের মধ্যেও হতাশা, ক্ষোভ ও অনিশ্চয়তা বেড়ে চলেছে।

হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করে তৈরি করা হচ্ছে স্থাীয় ইমারত
হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে তৈরি করা হচ্ছে স্থায়ী ইমারত।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকরা বিজিবির বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট আবেদন পেশ করলে মহামান্য আদালত ১৯ মে ২০০৫ বিজিবির ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর স্থাপনের উদ্দেশ্যে জমি অধিগ্রহণের জন্য জারিকৃত নোটিশ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এই মর্মে রুল জারি করেন এবং উক্ত রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত অধিগ্রহণ নোটিশের কার্যকারীতা স্থগিতের নির্দেশ দেন। কিন্তু এই নির্দেশ অমান্য করে জেলা প্রশাসক পুনরায় অধিগ্রহণ নোটিশ জারী করেন। ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকরা উক্ত দ্বিতীয় নোটিশের বিরুদ্ধেও রিট মামলা দায়ের করেন। এর প্রেক্ষিতে মহামান্য হাইকোর্ট উক্ত ভূমি অধিগ্রহণ নোটিশের কার্যকারীতাও স্থগিত করে রুল জারী করেন। বর্তমানে মামলাটি মহামান্য হাইকোর্টের বিচারাধীন রয়েছে।

কিন্তু হাইকোর্টের নির্দেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে বিজিবি ৫১ ব্যাটালিয়ন গত বছর (২০১৪) অক্টোবর থেকে বেদখলকৃত জমির কাঠামো পরিবর্তন করে স্থায়ী ইমারত নির্মাণ করছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের লোকজন ও নির্বাচিত সকল জনপ্রতিনিধিসহ দীঘিনালাবাসীর প্রতিবাদ বিক্ষোভও তারা আমলে নিচ্ছে না। বরং উল্টো স্থানীয় সেনাবাহিনী ও পুলিশ প্রশাসন বিজিবির পক্ষ হয়ে জনগণের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচীতে হামলা চালিয়েছে। শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা কর্মসূচী ভণ্ডুল করে দেয়ার পর সেনাবাহিনী প্রতিদিন পাহাড়িদের গ্রাম ঘেরাও করছে, লোকজনকে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে, ধরপাকড় বাড়িয়ে দিয়েছে, জনপ্রতিনিধিসহ শত শত ব্যক্তির নামে মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে। এতে জনগণের আন্দোলন কোনঠাসা হয়ে পড়ে। আর এর ফাঁকে বিজিবি তাদের ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরের জন্য বেদখলকৃত  জমিতে ইমারত ও রাস্তাঘাট নির্মাণ অব্যাহত রেখেছে।Dighinala BGB camp1

দালান নির্মাণ:
বিজিবি ২০১৪ সালের ১৪ মে গভীর রাতে মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে চুপিসারে দীঘিনালা মৌজাধীন শশী মোহন কার্বারী পাড়া ও যত্ন কুমার কার্বারী পাড়ায় তথাকথিত অধিগ্রহণকৃত জমিতে অবস্থান নেয়। পরে ১০ জুন তারা পুলিশ ও বাঙালী সেটলারদের সহায়তায় সেখান থেকে ২১ পরিবার পাহাড়িকে জোর করে  তাড়িয়ে দেয়। বর্তমানে তারা বাবুছড়া উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার পরিত্যক্ত কার্যালয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন।

বিজিবি গত বছর অক্টোবর থেকে স্থায়ী ইমারত নির্মাণ শুরু করে। সরেজমিন খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে বর্তমানে সেখানে ৬টি দালান নির্মাণের কাজ জোরেশোরে চলছে। ২টি দালানের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। বাঙালী শ্রমিক দিয়ে এসব নির্মাণের কাজ করা হচ্ছে।

বুলডোজার দিয়ে কাটা মাটি অন্যের জমিতে:
বিজিবি বুলডোজার দিয়ে প্রতিদিন মাটি কাটছে। এই মাটির কিছু অংশ অন্যের ধান্য জমিতে গিয়ে পড়ছে। এর ফলে ঐ জমিগুলোতে আর চাষ করা যাচ্ছে না।

বুলডোজার দিয়ে কাটা মাটির অংশ পড়ছে জমিতে
বুলডোজার দিয়ে কাটা মাটির অংশ পড়ছে জমিতে।

সেনাবাহিনীর বাবুছড়া সাব জোন ক্যাম্পের দক্ষিণ দিকে একটি কাঁচা রাস্তা রয়েছে। রাস্তাটি বর্তমানে বিজিবি কর্তৃক বেদখলকৃত শশী মোহন কার্বারী পাড়ার দিকে গেছে। বিজিবি এখন এই রাস্তাটি তাদের চলাচলের জন্য সংস্কার করছে। রাস্তাটি প্রশস্ত করতে দুই পার্শ্বে মাটি দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে। কিন্তু রাস্তার দুই পাশে ওয়াল না দিয়ে ভরাট করার কারণে মাটিগুলোর কিছু অংশ গিয়ে পড়ছে সন্তোষ কুমার কার্বারী ও বাঁচা রাম চাকমার ধান্য জমিতে। এতে করে ঐ জমি চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

এছাড়া বিজিবি কর্তৃক বেদখলকৃত এলাকার ভেতরে শশী মোহন কার্বারী পাড়া থেকে যতœ কুমার কার্বারী পাড়ায় যেতে একটি রাস্তা রয়েছে। বিজিবি সেই রাস্তাটিও সংস্কার করছে। এর জন্য বুলডোজার দিয়ে কাটা হচ্ছে যত্ন কুমার কার্বারী পাড়ার বাসিন্দা সুরজয় চাকমার বস্তুভিটা। আর এই মাটি দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে লাম্বা শিরা চাকমার ধান্য জমি। রাস্তার দক্ষিণ দিকে বাড়তি জায়গা না থাকায় ভরাটকৃত কাচা মাটি বৃষ্টির পানিতে ভেসে গিয়ে লাম্বা শিরা চাকমার ধানের জমিতে পড়ছে এবং তাতে জমি নষ্ট হচ্ছে।

শান্তিপদ চাকমার জমিতে আর্বজনা ফেলা:
বিজিবি সদস্যদের রান্নাঘরটি হচ্ছে শান্তিপদ চাকমার ১ম শ্রেণীর ধান্য জমির পাশে। তার এই জমিটি বিজিবি কর্তৃক বেদখলকৃত শশী মোহন কার্বারী পাড়া ও যত্ন কুমার কার্বারী পাড়ার মধ্যবর্তী স্থানে — অর্থাৎ তার জমির উত্তর পাশে যত্ন কুমার কার্বারী পাড়া এবং দক্ষিণ পাশে শশী মোহন কার্বারী পাড়া। এই দুটি পাড়ার জমি ‘অধিগ্রহণ’ করা হলেও শান্তিপদ চাকমার উক্ত রেকর্ডভূক্ত ৩.১১ একর জমি অধিগ্রহণের বাইরে।

কিন্তু কাগজে কলমে অধিগ্রহণ করা না হলেও তিনি তার জমি ঠিকমতো চাষ করতে পারছেন না। প্রথমত, জমিতে চাষ করতে তাকে বিজিবির অনুমতি নিতে হয়। দ্বিতীয়ত, বিজিবি সদস্যরা তাদের রান্নাঘরের  সকল আবর্জনা  তার জমিতে ফেলে দেয়। বাসী ভাত, তরকারীসহ যাবতীয় আবর্জনা, অব্যবহৃত  ভাঙা বোতল, শিশি, গ্লাস ইত্যাদিতে তার জমির একাংশ এখন ভরে গেছে। তাছাড়া বিজিবির  প্রস্রাবখানাও শান্তিপদ চাকমার জমির পাশে। প্রতিদিন প্রতিনিয়ত শত শত বিজিবি সদস্যের প্রস্রাবের পানি গড়িয়ে পড়ছে তার জমিতে। প্রস্রাবের দুর্গন্ধে জমির আশে পাশে থাকা যায় না। এসব কারণে শান্তিপদ চাকমা এ বছর তার জমির এক তৃতীয়াংশ চাষ করতে পারেন নি। অধিকন্তু জমিতে চাষ করতে গিয়ে বিজিবি সদস্যদের ফেলে দেয়া কাঁচে কাটা পড়ে আহত হন শান্তিপদ চাকমার ছোট ভাই গৌরপদ চাকমার ছেলে সুগঠন চাকমা ও প্রভাত চন্দ্র চাকমার স্ত্রী সুন্দরী চাকমাসহ বেশ কয়েকজন।Dighinala BGB camp3

যেভাবে প্রতিদিন বিজিবি সদস্যদের ফেলা আবর্জনা জমছে তাতে আগামী দু’ তিন বছরের মধ্যে তার পুরো জমি চাষের অযোগ্য হয়ে পড়বে। মনে হচ্ছে বিজিবি এভাবে তার জমিও এক সময় বেদখল করে নেয়ার কৌশল নিয়েছে। কারণ জমি চাষ করতে না পারলে তার সেখানে যাওয়া-আসাও বন্ধ হয়ে যাবে এবং আবর্জনায় ভরে গিয়ে একসময় তার জমিটি বিজিবির “অধিগ্রহণ” করা জমির সাথে একাকার হয়ে যাবে। আর তখন তার জমিটা বেদখল করে নেয়া সহজ হয়ে যাবে।

দেশের প্রতিষ্ঠিত শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী হয়েও বিজিবির এসব কর্মকান্ড ও প্রযুক্ত অপকৌশল অত্যন্ত ঘৃন্য ও নিন্দনীয়। এভাবে নিরীহ মানুষের জীবন জীবিকা ধ্বংস করে দেয়া চরম অন্যায়। শান্তিপদ চাকমার এই জমি ছাড়া জীবিকার আর অন্য কোন অবলম্বন নেই। তার এই জমি এভাবে নষ্ট ও বেহাত হয়ে গেলে তার ও তার পরবর্তী বংশাধরদের কী অবস্থা হবে? দেশের সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী বিজিবির তাতে কি কোন মাথা ব্যাথা আছে? হায়, বিজিবির মতো জনগণের কল্যাণে নিয়োজিত ক্ষমতাধর বাহিনীর কাছে শান্তিপদ, সন্তোষ ও বাঁচারামরা কত অসহায়! তারা কি এদেশে সুবিচার পাবেন?
————————

সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More