মতামত

ধর্ষক আব্দুর রহিম, একটি রায়, অতপর জামিন; এর পর কী?

0

পার্থিব ত্রিপুরা


কয়েকদিন আগে আব্দুর রহিম নামে ধর্ষণ মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীর হাইকোর্টে জামিন লাভের সংবাদ পুরো পার্বত্যবাসীকে স্তম্ভিত করেছে। আব্দুর রহিম (৪৬) রাঙামাটি জেলাধীন লংগদুর করল্যাছড়ি আর এস উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি ২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর একই স্কুল থেকে তখন সদ্য এসএসসি পাশ করা এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছিলেন। আদালতে এই অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাকে ২০২২ সালের ২৯ নভেম্বর যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদ- এবং অতিরিক্ত ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ৯(১) ধারার অপরাধে রাঙামাটির জেলা ও দায়রা জজ এ. ই. এম. ইসমাইল হোসেন এই রায় দেন।

ছাত্রীকে ধর্ষণে অভিযুক্ত আব্দুর রহিম। যার যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিল।

রায়ে তিনি লেখেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষে(র) উপস্থাপিত সাক্ষীদের মৌখিক সাক্ষ্য, দালিলিক সাক্ষ্য ও ফরেনসিক সাক্ষ্য এবং পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য বা circumstantial evidence এর ভিত্তিতে আমার সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত এই যে, আসামি মোঃ আব্দুর রহিম, প্রধান শিক্ষক, করল্যাছড়ি আর. এস. উচ্চ বিদ্যালয়, গত ২৫/০৯/২০২০ খ্রিস্টাব্দ তারিখ সকাল অনুমান ১০.৩০ ঘটিকার সময় ….. তার ছাত্রী ভিকটিম (….. চাকমা)-কে ভয়ভীতি দেখিয়ে জোরপূর্বক ধর্ষণ করেছেন মর্মে রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। আসামি উক্তরূপ কার্য দ্বারা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ৯(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।’

রায় লিপিতে দেখা যায় বিবাদী আব্দুর রহিম মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে এবং নানা চাতুরী ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে আদালতের রায় তার পক্ষে নেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু আদালত এতে বিভ্রান্ত হননি, বরং সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন। এখানে খানিকটা দীর্ঘ হলেও প্রাসঙ্গিক কারণে আদালতের রায় থেকে নীচে উদ্ধৃতি দেয়া হল।

‘স্বীকৃত মতে আসামি যেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, ভিকটিম সেই বিদ্যালয়েরই ছাত্রী ছিলেন। ভিকটিম কিছুদিন পূর্বেই বিদ্যালয় ত্যাগ করেছেন। ফলে আসামি ও ভিকটিমের মধ্যে ছাত্রী-শিক্ষক সম্পর্ক বহাল ছিল। আসামী স্বীকৃত মতে বিবাহিত। তিনি একদিকে যেমন তার পরিবারের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন, অন্যদিকে তার নিজের ছাত্রীকে ধর্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকতার মহান পেশাকে কলঙ্কিত করেছেন। অধিকন্তু, তিনি ধর্ষণের ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য একে পাহাড়ি-বাঙ্গালী জাতিগত বিরোধের ফলাফল মর্মে দাবী করেছেন। তিনি পরবর্তী মামলা থেকে বাঁচার জন্য ভিকটিমকে ধর্মান্তরিত করে বিবাহ করেছেন মর্মে আদালতে কাগজ দাখিল করেছেন। তৎপরবর্তীতে আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণকালে আবার দাবী করেছেন যে, তিনি এজাহারকারীর ফাঁদে পড়ে ভিকটিমকে বাঁচানোর জন্য তাকে বিবাহ করেছেন। আসামীর উক্তরূপ কর্মকাণ্ড হতে প্রতীয়মান হচ্ছে, আসামী প্রকৃতপক্ষে একজন প্রতারক এবং বিকৃত যৌনাচারের ধারক ও বাহক। তাকে অনুকম্পা প্রদর্শনের সুযোগ নেই। অধিকন্তু, আসামিকে যথোপযুক্ত সাজা প্রদান করা হলে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় বসবাসরত পাহাড়ী, বাঙ্গালীসহ সকল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনগণের নিকট পুনরায় এই বার্তা যাবে যে, আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান এবং বিচার বিভাগ সকলের জন্যই উন্মুক্ত।’

পার্বত্য চট্টগ্রামে গত কয়েক দশকে অসংখ্য ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। মূলত: পাহাড়ি নারীরাই হলেন এই সব ঘটনার নির্মম শিকার। কিন্তু এসব জঘন্য অপরাধের বিচার ও শাস্তির দৃষ্টান্ত অত্যন্ত বিরল। তাই এই দিক দিয়ে নিম্ন আদালতে আব্দুর রহিমের কারাদণ্ডাদেশের রায়কে অনেকটা ব্যতিক্রম বললে অত্যুক্তি হবে না। আদালতের উক্ত রায় যে কোন ন্যায়বিচার প্রার্থীকে নিঃসন্দেহে আশান্বিত করবে। এভাবে যৌন অপরাধীদের বিচার ও শাস্তি হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা ক্রমে বন্ধ হয়ে আসতে বাধ্য।

কিন্তু উচ্চ আদালতে আব্দুর রহিমের জামিন লাভ এই আশায় কিছুটা হলেও কালোছায়া পড়েছে। মিডিয়ায় এ সম্পর্কে যে রিপোর্ট বেরিয়েছে তা থেকে স্পষ্ট যে, আসামী পক্ষ মহামান্য উচ্চ আদালতকে মিথ্যা ও প্রমাণিত ভুল তথ্য সরবরাহ করে বিভ্রান্ত করেছে। আপিলকারী আব্দুর রহিমের আইনজীবী রেজাউল করিম আদালতে দাবি করেন যে, ‘আপিলকারী এরই মধ্যে মামলার ভিকটিমকে বিয়ে করেছেন। এ বিষয়ে ভুক্তভোগী ও তার মায়ের একটি হলফনামা আদালতে দাখিল করেন।’

তবে এই মামলা সংক্রান্ত দলিলপত্রে দেখা যায়, আব্দুর রহিম নিম্ন আদালতে রায় হওয়ার আগে জোর করে ভিকটিম ও তার মায়ের হলফনামা নিয়েছিলেন। এ বিষয়ে ভিকটিম পরিবারের সাথে আলাপে জানা যায়, আসামী আব্দুর রহিমের সাথে আপোষ করার জন্য তাদের ওপর বার বার চাপ ও হুমকি দেয়া হয়। কিন্তু এতে তারা রাজী না হলে কূটকৌশলে ভিকটিমের পিতা বিন্দু চাকমাকে জেলে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। এরপর মা ও মেয়ের ওপর চলে অকথ্য মানসিক নির্যাতন। তাদেরকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হয়। স্থানীয় আওয়ামী লীগ পন্থী পাহাড়ি চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা ভিকটিম পরিবারকে সহযোগিতা করা দূরের কথা, তারা উল্টো কুখ্যাত ধর্ষক আব্দুর রহিমের পক্ষ নেয়। সংস্কারবাদী জেএসএস ও সেনা-মদদপুষ্ট জুম্ম রাজাকাররাও অপরাধী ধর্ষককে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এদের মধ্য সংস্কারবাদীদের চীফ কালেক্টর সুমন বৈদ্য, অনঙ্গ লাল, শান্তি রঞ্জন ও মঙ্গল কান্তি চেয়ারম্যান অন্যতম। তারা ধর্ষক আব্দুর রহিমের পক্ষ নিয়ে ভিকটিম পরিবারকে বিভিন্ন হুমকি দেয় এবং বিন্দু চাকমা জেলে থাকা অবস্থায় ভিকটিম ও তার মাকে আপোষ করার জন্য আব্দুর রহিমের কাছে যেতে বাধ্য করে।

কিন্তু সত্য গোপন থাকে না এবং অন্যায়ও চিরস্থায়ী হয় না। আব্দুর রহিম অপকৌশলে পাহাড়ি রাজাকার ও নিমকহারামদের দিয়ে ভিকটিম ও তার মায়ের কাছ থেকে জোর করে মিথ্যা হলফনামা নিতে সক্ষম হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আদালত তা গ্রাহ্য করেনি। ভিকটিমের সাথে তার বিয়ে হয়েছে ও ভিকটিম ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তির হয়েছে বলে জোর করে নেয়া মিথ্যা হলফনামা আদালতের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। ফলে শেষ পর্যন্ত আব্দুর রহিম শাস্তি এড়াতে পারেনি।

কিন্তু উচ্চ আদালতের দৃষ্টিতে এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি কীভাবে এড়িয়ে গেল তা বোঝা মুশকিল। আমরা চাই শিক্ষক নামের কলঙ্ক আব্দুর রহিমের জামিন অবিলম্বে বাতিল এবং ন্যায়বিচারের স্বার্থে নিম্ন আদালতের দেয়া সাজা বহাল রাখা হোক। এছাড়া প্রতারণা ও আদালতে মিথ্যা বলার জন্য তার বিচার ও যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত হওয়া জরুরী।

এখানে আরও একটি কথা। ভিকটিমের পরিবার বর্তমানে নিজ ভিটেবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়ে অত্যন্ত কষ্টে মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। একমাত্র ন্যায়বিচার চাওয়ার কারণে তাকে জোরপূর্বক এলাকা ছাড়া করা হয়েছে। সংস্কারবাদী ও রাজাকাররা তার জমি বিক্রি করে দিয়েছে, তার ঘরবাড়ি ভেঙে দিয়েছে, পানি তোলার মোটর, টিভি, ডিশ সবই নিয়ে গেছে। বলতে গেলে ভিকটিমের পরিবার এখন সর্বস্বান্ত। কিন্তু তারপরও তারা আব্দুর রহিমের কাছ থেকে একটি পয়সাও নেয়নি এবং ভবিষ্যতেও নেবে না বলে জানিয়েছে।

যারা ভিকটিম পরিবারকে পথে বসিয়েছে তাদেরও বিচার ও শাস্তি হতে হবে। মানুষ নামের কলঙ্ক এই দুর্বৃত্তরা তাকে এখনো হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। এর কি কোন প্রতিকার নেই? সেনা-সৃষ্ট ও মদদপুষ্ট দুষ্কৃতিকারীদের জুলুম ও দৌরাত্ম্য আর কতদিন চলবে? [১৫ জুলাই ২০২৩]


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।


সিএইচটি নিউজের ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More