নাইক্ষ্যংছড়িতে ভূমি বেদখল বিষয়ে সরেজমিন তদন্ত শেষে ৮ গণসংগঠনের কনভেনিং কমিটির সংবাদ সম্মেলন
সিএইচটিনিউজ.কম
পার্বত্য চট্টগ্রামের ৮গণসংগঠনের কনভেনিং কমিটির ৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারী ইউনিয়নের সাপমারা ঝিড়ি, বাদুর ঝিড়ি বড় পাড়া ও আংক্ষ্যং পাড়া মারমা ও চাক পরিবার উচ্ছেদের ঘটনা সরেজমিনে তদন্ত শেষে আজ ২৯ আগস্ট শুক্রবার বিকাল ৩.৩০ টায় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করে। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ৮ গণসংগঠনের প্রতিনিধি দলের সদস্য ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি থুইক্যচিং মারমা।

লিখিত বক্তব্যে তিনি নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা বাইশারী ইউনিয়নে সাপমারা ঝিড়ি, বাদুর ঝিড়ি বড় পাড়া থেকে সংখ্যালঘু মারমা ও চাক জাতিসত্তার পরিবারদের উচ্ছেদ ও তাদের দুঃখ-দুর্দশা চিত্র বিস্তারিত তুলে ধরে বলেন, বাইশারী ইউনিয়নে নব্য ভূমি দস্যুরা আংক্ষ্যং পাড়া ও সাপমারা ঝিড়ি বড় পাড়া এলাকায় যে হারে রাবার বাগান গড়ে তোলার কর্মযজ্ঞ চলছে, তাতে মারমা ও চাক জাতিসত্তার সম্প্রদায় নিজ বাস্তুভিটা থেকে শুধু যে উচ্ছেদ হবে তাই নয়, এ কর্মকাণ্ড পরিবেশের জন্যও মারাত্মক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দেখা দেবে। রাবার বাগানের মুনাফা মালিকরা ভোগ করলেও, তার চরম মাসুল দিতে হবে গোটা এলাকাবাসীকে, তথা সামগ্রীকভাবে এ অঞ্চলেরই ক্ষতি হবে, যা যে কোন সচেতন নাগরিককে উদ্বিগ্ন না করে পারে না।
তিনি আরো বলেন, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ও শিক্ষাগত পশ্চাদপদতার কারণে মারমা ও চাক সংখ্যালঘু জাতির লোকজন বাস্তবিকই অসহায়। নাগরিক হিসেবে নিজেদের বসতভিটা ও বংশপরম্পরার ভোগ দখলীয় জায়গা রক্ষার ব্যাপারে তারা প্রশাসনের ন্যুনতম সহযোগিতাও পায় না। আইনী লড়াইয়ে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ। তাদের এ দুর্বলতার সুযোগে এবং প্রশাসনের বিমাতাসুলভ আচরণের কারণে মারমা ও চাক জাতিসত্তার জায়গা-জমি বাস্তুভিটার প্রতি লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ভূমি দস্যুরা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, আংক্ষ্যং আফ্যা/সাপমারা ঝিড়ি আগা মুরুব্বী মংনুচিং মারমা আমাদের জানিয়েছেন, ‘অবৈধ অস্ত্র রাখার’ ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা অভিযোগে তাকে আটক করে বিজিবি ক্যাম্পে রাখা হয়েছিল। তাকে এক মাসের অধিক বিজিবি ক্যাম্পে আটকে রেখে তার পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের বসতভিটা জায়গা-জমি থেকে উচ্ছেদ করে আলম মাঝি ও জব্বর ফরাজী তা দখল করে নেয়। তাদের কারণে বৌদ্ধমন্দিরসহ এলাকার লোকজন উৎখাত হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, আংক্ষ্যং ওয়া সাপমারা ঝিড়িমুখপাড়া কার্বারী ফোঅং মারমা (৪৫) আমাদের প্রতিনিধি দলকে জানান, এলাকার লোকেরা ব্রিটিশ আমল থেকে বসবাস করে আসছে। আগে তারা জুমচাষ করে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করতেন। বর্তমানে জায়গাগুলো বেদখল হয়ে যাওয়ায় তারা জুম চাষ করতে পারছেন না। তাদেরকে উচ্ছেদ করে জায়গা দখল করার জন্য সরকার দলীয় ও কোম্পানীর লোকজন বিভিন্ন ডাকাত বাহিনীকে পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে। এর ম্যাধমে তারা পাহাড়ি ও সাধারণ বাঙালি জনগণের ওপর অন্যায় অত্যাচার চালায় এবং জায়গাগুলো ছেড়ে যেতে তাদের বাধ্য করে।
আংক্ষ্যং পাড়া(সাপমারা ঝিড়ি) থেকে ইতিমধ্যে বেশ কিছু মারমা ও চাক পরিবারকে ভূমি দস্যু কর্তৃক উচ্ছেদ এবং বিভিন্ন কোম্পানীর নামে রাবার বাগান করে পাহাড়িদের ভূমি বেদখলের বিস্তারিত চিত্র সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যে তুলে ধরা হয়।
এছাড়া লিখিত বক্তব্যে তিনি কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার ১৭ ব্যাটালিয়ন এর বিজিবি জওয়নাদের দ্বারা অন্যায়ভাবে রাঙামাটি ট্রাইবেল আদাম পারমী বৌদ্ধ বিহারের বিহারাধ্যক্ষ শাসন রক্ষিত ভিক্ষু ও সবিতা ভিক্ষুকে(আবাসিক ভিক্ষু) আটকের বিষয়ে তুলে ধরেন। সংবাদ সম্মেলনে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার চাকমা পল্লীতে ঘুরে এসে সেখানকার জনগণের বাস্তব অবস্থাও তুলে ধরা হয়।
সংবাদ সম্মেলন থেকে চাক ও মারমা জাতিসত্তাসহ নাক্ষ্যংছড়ি স্থায়ী বাসিন্দাদের বসতভিটা ও জায়গা-জমি রক্ষার্থে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করা; রাবার ও অন্যান্য বাণিজিক্য বাগান বাগিচা প্রকল্প বন্ধ করে অনাবাসী ভূমি মালিকদের জমি অধিগ্রহণপূর্বক তা প্রকৃত মালিকদের নিকট ফিরিয়ে দেয়া; ষড়যন্ত্রমূলকভাবে বরাদ্ধ দেয়া প্লট বাতিল করা হোক, ভূমি বেদখলকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া; বন ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর সকল ধরনের প্রকল্প বন্ধ করা; বিজিবি ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাহাড়ি বাঙালির সম্প্রীতি বিনষ্ট হয় এমন উস্কানিমূলক তৎপরতা বন্ধ করা; উখিয়ায় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের হয়রানি ও আটকের জন্য দায়ী বিজিবি কর্মকর্তা ও জওয়ানদের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে যথাযথ আইনী পদক্ষেপ নেয়া এবং টেকনাফ-উখিয়ায় চাকমাদের জায়গা-জমি রক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে অনবিলম্বে সরকারিভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করার দাবি জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন প্রতিনিধি দলের প্রধান ও সাজেক ভূমি রক্ষা কমিটির সভাপতি জ্ঞানেন্দু চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও কনভেনিং কমিটির সদস্য সচিব অংগ্য মারমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ও কনভেনিং কমিটির সদস্য মাদ্রী চাকমা, ঘিলাছড়ি নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটির নেত্রী ও কনভেনিং কমিটির সদস্য কাজলী ত্রিপুরা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক এসিংমং মারমা ও সদস্য শুভ চাক।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ৮ সংগঠনের কনভেনিং কমিটির প্রতিনিধি দলের নেতৃবৃন্দ সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।
উল্লেখ্য, গত ২৪ আগস্ট – ২৬ আগস্ট ২০১৪ ৮ গণসংগঠনের কনভেনিং কমিটির ৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও কক্সবাজারের উখিয়া সফর করে। প্রতিনিধি দলটি প্রথমে নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারী ইউনিয়নে মারমা ও চাক পরিবারদের উচ্ছেদের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ও পরে কক্সবাজারের উখিয়ায় চাকমা পল্লীতে সফর করে। উখিয়ায় সফরকালে প্রতিনিধি দলের নেতৃবৃন্দ গত ৯ জুলাই বিজিবি কর্তৃক আটক হওয়া দুই বৌদ্ধ ভিক্ষুর সাথেও সাক্ষাত করেন।
————–
সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।