ফেসবুক থেকে

নাইক্ষ্যংছড়িতে যেভাবে দখল হয়ে গেলো চাকদের ‘লাংলেক প্রাইং’

0
প্রতীকী ছবি

জায়গাটার নাম ছিলো লাংলেক (langlauk) প্রাইং। লাংলেক প্রাইং এর শব্দানুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘বাদুরের দেশ’। চাকদের আদি গ্রামগুলোর মধ্যে একটি। নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারি ইউনিয়নে এর অবস্থান। আঈ (নানী)-র মুখ থেকে শুনেছি, সে যখন ঐ গ্রামে বড় হচ্ছিল, ওখানে বিশাল একটা গাছে অনেক বড় একটা ফোকর ছিল, যেটা দেখতে অনেকটা প্রাকৃতিক ছাতির মত। অসংখ্য বাদুড় থাকত ওটাতে। পুরো এলাকাটাতেই অনেক বাদুড় থাকলেও এটা ছিলো তাদের সবচে বড় আবাসস্থল। বৃষ্টির দিন আসা-যাওয়ার পথে অনায়াসে এর নিচে ১২-১৫ জন আশ্রয় নিতে পারতো। খুব স্বাভাবিকভাবে এলাকাটি লাংলেক (langlauk) প্রাইং বলেই দীর্ঘদিন চাকরা ডাকতো, চিনতো।

আমার অভিজ্ঞতা এমন ছিল না। ইতিমধ্যে ইতিহাস পাল্টে গেছে। আমি যখন বড় হয়েছি আঈর মতো বয়স্ক মানুষজন ছাড়া বাকিদেরকে বলতে শুনেছি বাদুড়ঝিরি।

বাদুরঝিরি এখনো আছে। চাকরা নেই ওখানে। নেই বাদুড়। নেই লাংলেক (langlauk) প্রাইং। আছে সারি সারি রাবারের গাছ। যারা ওখানে থাকতো তারা ২০০০ সালের দিকে দেখলো ধীরে ধীরে বাঙালি ব্যাবসায়িদের আসা-যাওয়া বাড়ছে। রাবার গাছের সারি দীর্ঘায়িত হতে হতে লাংলেক (langlauk) প্রাইং-এর দিকে এগোচ্ছে। যারা জঙ্গুলে লাংলেক (langlauk) প্রাইংকে চিনতো না, চেনার আগ্রহও ছিলো না, তারাও আস্তে আস্তে চেনে বাদুড়ঝিরি।

২০১০ সালের মধ্যে তারা দেখে লাংলেক (langlauk) প্রাইং-এর আশেপাশের সব বন কেটে ফেলা হয়েছে। রাবারের চাষ হবে। উন্নয়ন হবে, কর্মসংস্থান হবে, রাস্তা হবে। বন না থাকলে জুম কিভাবে হবে, বছরের খোরাক জুটাতে পারবে কি পারবে না -এইসব দুশ্চিন্তায় যারা ছিলো তারাও ভাবল – যাই হোক রাবার বাগানে কাজতো জুটবে। এরপর শুরু নতুন উপদ্রব – ডাকাতি। রাবারের সারি যত আগায় লাংলেক (langlauk) প্রাইং-এর দিকে, ডাকাতির উপদ্রবও তত বাড়ে। কিই বা আছে প্রান্তের এই গ্রামে ডাকাতি করার মতো! কিন্তু একটা মুরগী ডাকাতি মানেও যে এখানকার পরিবারগুলোর জন্য অনেক বড় ডাকাতি- এটা এই ডাকাতরা জানে। তারপর ২০১৩ সালের মার্চ মাসের এক রাতে ডাকাতের দল আসে, ঘন্টার পর ঘন্টা নারীপুরুষ সবাইকে পেটায়, বাড়ি ভাংচুর করে, মুরগীরা সব লাশ হয়ে ডাকাতদের ঝুলিতে ওঠে। ঘটনার ভয়াবহতায় লাংলেক (langlauk) প্রাইং-এর সবাই অদূরের তিনটি চাক গ্রামে (তুংবুক থিং/উপর চাক পাড়া, আনাং থিং/হ্যাডমেন পাড়া, আলেশ্যং/নতুন চাক পাড়া) আশ্রয় নেয়।

এরপর অনেকের চেষ্টায় পত্রিকার পাতায় প্রথম উঠে আসে লাংলেক (langlauk) প্রাইং, বাদুড়ঝিরি নামে। ঘটনা জেনে অনেকে অনেক ভরসা-আশ্বাস দিয়েছেন। স্থানীয় সংসদ সদস্য বলেছেন নির্ভয়ে ফিরে যেতে। কিন্তু তাদের ভয় কাটে নি। আশ্বাসে বিশ্বাস না করা এতদিনে প্রাক্তন লাংলেক (langlauk) প্রাইংবাসীরা শিখে গেছে। তারা আর ফেরত যাবার সাহস করেনি। ২০১৯-এ যারা সাহস করে দলবল নিয়ে নিজেদের ভাঙা ঘরবাড়ী দেখতে গেছে, তারা দেখেছে ধ্বংসস্তূপে নতুন প্রাণ – মানুষের চেয়ে উচু রাবার বাগান।

প্রথমে ডাকাতি হলো লাংলেক (langlauk) প্রাইং-এর নাম, এর পর ডাকাতি হলো লাংলেক (langlauk) প্রাইং বাসিন্দা চাকদের আবাস স্থল। একই ভাবে ডাকাতি হয় শোং নাম হুং (নীলগিরি) , তেংপ্লং চূট (চন্দ্রপাহাড়) এবং আরো অজস্র নাম। সাথে সাথে ডাকাতি হয় পাহাড়ি মানুষের বাড়ি, ইতিহাস। ডাকাতের পরিচয় ভিন্ন (কখনো রাবারবাগান, কখনো পর্যটন কেন্দ্র, কখনো রাস্তা)। কিন্তু ডাকাতির পদ্ধতি এক।

নামে কি আসে যায়? লাংলেক (langlauk) প্রাইং আর বাদুড়ঝিরি কাছাকাছি শব্দানুবাদ। আপাত দৃষ্টিতে নিরীহ এই নামকরণের পেছনে আছে ভয়াবহ রাজনীতি। ভাষা ডাকাতির সাথেই ঘটে ভূমি ডাকাতি।

একটি জনপদের নাম শুধুমাত্র যেকোন একটি নাম না, এর সাথে গভীরভাবে যুক্ত থাকে জায়গাটির সাথে মানুষের সম্পর্ক, পরিচয় আর স্মৃতিব্যবস্থা। যাদেরকে সাধারণ ইতিহাসে জায়গা দেয়া হয়না এবং যাদের নিজেদের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে রাখার ক্ষমতা ও সংস্থান নেই, অর্থাৎ প্রান্তিক মানুষ, বিশেষত আদিবাসীদের কাছে, এটা ঐ এলাকার ইতিহাস থেকে উচ্ছেদ হবার/বিস্থাপিত হবার শেষ দলীল।

তাই নামে অনেক কিছুই আসে যায়। নামকরণের রাজনীতি অর্থাৎ কার দেয়া নাম কাগজে কলমে প্রচারিত হবে আর কার দেয়া নাম মুছে ফেলা হবে তার সাথে জড়িয়ে আছে শক্তি-সম্পর্ক, জাতীয়তাবাদ আর সংখ্যাগরিষ্ঠতার বাহুবল। এই নামকরণের রাজনীতি মূলত কোন একটা এলাকার মানুষের, সংস্কৃতির, মালিকানার, প্রানব্যবস্থার আর ইতিহাস মুছে দেয়ার রাজনীতি। আর এই নতুন নামকরণ যদি হয় চাক বা ম্রো-দের মত প্রান্তিক পাহাড়ি জনপদের, তাহলে তো কোন জবাবদিহিতার প্রয়োজন পড়ে না। যে মানুষগুলো তাদের জায়গার নাম হারিয়েছে (সাথে ভূমিও) তাদের এবং তাদের পরবর্তী বংশধরেরা খালি শারীরিকভাবে না, নিজেদের ইতিহাস ও পরিচয় থেকেও তারা মানসিকভাবে বিস্থাপিত হয়। যারা নতুন নামে জায়গাগুলোকে চেনে তাদেরো প্রশ্ন করার অবকাশ থাকেনা – ‘কারা ছিলো এখানে? তারা এখন কোথায় গেলো?’। আদিবাসী ভাষার নামগুলো থাকলে অন্তত যাদের সাথে বাস্তুভিটা থেকে উৎখাত করার মতো অন্যায় হয়েছে তার একধরণের স্বীকৃতি থাকে।

আমরা বহুজাতি-বহুধর্মের-বহুভাষার বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি। কিন্তু এটা বাস্তবতায় রূপ দিতে হলে যে দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন দরকার তার সদিচ্ছা কি আমাদের আছে? যাদেরকে অপর ভাবেন তাদের মনোবেদনা জানতে না চাইলে কেন তারা আপন হবে? বেড়াতে গিয়ে জানতে চেয়েছেন কখনো ‘নীলগিরি’ কেম্নে ‘নীলগিরি’ হলো? আদিবাসী সহপাঠীর কাছে জানতে চেয়েছেন কখনো তার নামের ঠিক উচ্চারণ কি? না ভালোবেসে নিজেই একখানা নাম চাপিয়ে দিয়েছেন?

  • লেখাটি Uchacha-A Chak-এর ফেসবুক টাইমলাইন থেকে নেওয়া।

 


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত/প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More