মন্তব্য প্রতিবেদন
নিজ দেশের জনগণের সাথে শত্রুতা করে কি সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা যায়?

মন্তব্য প্রতিবেদন
গত ২৩ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে মারমা কিশোরী ছাত্রীকে গণধর্ষণের পর তার বিচারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি মহল ‘সার্বভৌমত্ব’ নিয়ে চিল্লাচিল্লি শুরু করে। অবস্থা যেন ‘গেল গেল, সব গেল, সার্বভৌমত্ব চলে গেল।’ তারা ওই ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করল। কিন্তু আশ্চায্যের বিষয় হলো, সেটলাররা যখন অপরাধী ধর্ষক ও হামলাকারীদের রক্ষার জন্য মিথ্যা অভিযোগ নিয়ে সভা-সমাবেশ, জঙ্গী মিছিল ও হরতাল করে, পাহাড়িদের ওপর সহিংস সাম্প্রদায়িক হামলা চালায়, তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়, লুটপাট করে, তখন তারা সেখানে পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীগুলোকে নির্মূলের ষড়যন্ত্র দেখতে পায় না। বরং যেন তারা মনে করে এসব হামলা দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য অপরিহায। সে কারণে এসব হামলার কোন বিচার হয় না এবং অপরাধীরাও শাস্তি পায় না; বরং পুরষ্কৃত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে এই প্যাটার্ণ যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে।
‘সার্বভৌমত্বের পাহারাদারদের’ কথা শুনে মনে হয় যেন পাহাড়িরা তাদের ন্যায়সঙ্গত কোন দাবি নিয়ে মিছিল-সমাবেশ বা আন্দোলন করলেই দেশের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হয়ে যাবে; সার্বভৌমত্ব যেন এত ভঙ্গুর! সেজন্য পাহাড়িদের দাবি মেনে নেয়া বহু দূরের কথা, পাহাড়িদের তারা দাবি তুলতেও দিতে চায় না। দাবি নিয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে দিতে চায় না। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করে তা দমন করে। যেমন, ২০২৪ সালের ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে এবং এ বছর ২৮ সেপ্টেম্বর গুইমারায় মারমা অধ্যুষিত রামেসু বাজারে সাম্প্রদায়িক হামলা চালানো হয়েছে। উভয় ক্ষেত্রে পাহাড়িরা তাদের ন্যায়সঙ্গত দাবি নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করছিলেন।
‘সার্বভৌমত্বের ধ্বজাধারীদের’ ধারণা হলো পাহাড়িরা সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি। তাই তারা পাহাড়ি রাজনৈতিক দলগুলোকে গণতান্ত্রিকভাবে কাজ করতে দিতে চায় না। তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিতে চায় না। দৈবাৎ যারা সাহস করে প্রকাশ্যে স্বাধীন মতামত প্রকাশ করে, সত্য উচ্চারণ করে, তাদের মুখ বন্ধ করে দেয়ার জন্য ক্যাঙ্গারু কোর্টে বিচারের নামে প্রহসন করে তাদের বিরুদ্ধে কারা দণ্ডাদেশ দেয়া হয়। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তাদের হুমকি ও ভয় প্রদর্শন করা হয়। তারা পাহাড়ের আনাচে-কানাচে সেনা ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প বসাতে চায়, পাহাড়কে ক্যাম্প দিয়ে ভরিয়ে দিতে চায়, পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামকে ক্যান্টনমেন্ট বানাতে চায়।
তারা সার্বভৌমত্ব রক্ষার কাজে পাহাড়ি জনগণকে আদৌ বিশ্বাস করে না। তাই তারা পাহাড়ে সর্বত্র বাঙালি মুসলমান পুনর্বাসন করতে চায়। পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাঙালি-মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করতে চায়। এ জন্য দরকার পড়ে পাহাড়িদের জমি জবরদখলের। এতে সংঘাত অনিবায হয়ে পড়ে। এ সময় পুরো রাষ্ট্র সেটলারদের পক্ষ নেয়।
সার্বভৌমত্ব ও পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে ‘সার্বভৌমত্বের রক্ষকদের’ ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি উগ্র বাঙালি মুসলমান জাতীয়তাবাদেরই উলঙ্গ বহিঃপ্রকাশ। মনের গভীরে তারা পাহাড়িদেরকে বাংলাদেশের নাগরিক মনে করে না; তাদেরকে শত্রুবৎ জ্ঞান করে। সার্বভৌমত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে বাধা মনে করে। সেজন্য পাহাড়িদেরকে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার দেয়া দূরের কথা, সংবিধানে স্বীকৃত ও প্রাপ্য মৌলিক নাগরিক অধিকারগুলোও দিতে চায় না।
নিঃসন্দেহে সার্বভৌমত্ব হলো একটি দেশের জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখানে কেবল সামরিক নয়, রাজনৈতিক প্রশ্নও জড়িত থাকে। তাই প্রশ্ন হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামে সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হলে এ অঞ্চলের মূল অধিবাসী পাহাড়ি জনগণকে বাদি দিয়ে, তাদেরকে আস্থার মধ্যে না নিয়ে বা তাদের সাথে শত্রুতা করে, কেবল সামরিক উপায়ে কি তা রক্ষা করা সম্ভব? যারা মনে করে সম্ভব, তাহলে সার্বভৌমত্ব কী এবং কীভাবে তা রক্ষা করতে হয়, সে বিষয়ে তাদের প্রকৃত কোন ধারণা নেই।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান অশান্ত পরিস্থিতির একটি বড় কারণ হলো একচেটিয়াভাবে এই ‘সার্বভৌমত্বের কারবারী’ অজ্ঞ জেনারেলদের কাছে এই অঞ্চলের ভাগ্যকে ছেড়ে দেয়া। আজ বাংলাদেশে এমন কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের দেখা পাওয়া যায় না, যিনি এসব জেনারেলদের ওপর নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার একটি যৌক্তিক রাজনৈতিক সমাধান দিতে সক্ষম হবেন।
মনে রাখা দরকার, চূড়ান্ত বিচারে সার্বভৌমত্ব রক্ষা, যুদ্ধ পরিচালনা এসব বিষয়গুলো হলো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়, যা কেবল জেনারেলদের ওপর ছেড়ে দেয়া যায় না। যদি ছেড়ে দেয়া হয়, তাহলে তার পরিণতি কোন দিন ভালো হয় না। তাই শেষে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কালের ফরাসী প্রধানমন্ত্রী Georges Clemenceau -এর বহুল উদ্ধৃত উক্তিতে war -এর স্থলে sovereignty শব্দটি বসিয়ে দিয়ে বলতে চাই, Sovereignty is too important a business to be left to the Generals. কথাটা বাংলাদেশের সামরিক জেনারেল ও রাজনৈতিক নেতা উভয়ের মনে রাখা দরকার।
(১ নভেম্বর ২০২৫)
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।
