পাঁচ দাবিতে ‘পদযাত্রা ও সমাবেশ’ কর্মসূচির ডাক গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করে গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট।
ঢাকা প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত গণহত্যার বিচার, ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের পাঁয়তারা বন্ধ করা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রন করা, শ্রমিক আন্দোলনে পুলিশি হামলা বন্ধ কর ও পুনর্বাসন ছাড়া রিকশা শ্রমিকদের হয়রানি বন্ধের দাবিতে আগামী ২৭ নভেম্বর ২০২৪ ‘পদযাত্রা ও সমাবেশ’ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট।
আজ মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর ২০২৪) দুপুর সাড়ে ১২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ছাত্র জোটের নেতারা এ কর্মসূচির ঘোষণা দেন।
“জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত গণহত্যার বিচার, শহিদ পরিবারগুলোকে আর্থিক সহায়তা প্রদান, আহতদের চিকিৎসা ও পূনর্বাসন, ছাত্র সংসদ নির্বাচন চালু, গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি মেনে নেওয়া এবং রিকশাচালকদের ওপর সংঘটিত হয়রানি বন্ধের দাবিতে গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট উক্ত সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের সমন্বয়ক ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি সালমান সিদ্দিকী।
লিখত বক্তব্যে তিনি বলেন, সম্প্রতি ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের দীর্ঘ শোষণ-জুলুমের বিরুদ্ধে এদেশের ছাত্র-জনতা এক অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান গড়ে তোলে। গণআন্দোলন দমাতে এমন নৃশংস হামলা এবং বর্বরতা নজিরবিহীন। সরকারের হামলা-মামলা- নির্যাতন উপেক্ষা করে বন্দুকের গুলির সামনে দাঁড়িয়ে অকাতরে প্রাণ দিয়েছে অসংখ্য ছাত্র-জনতা। এ আন্দোলনে অন্ধত্ব ও পঙ্গুত্ব বরণ করেছে ২০ হাজারের অধিক মানুষ। শিক্ষার্থীরা ছাড়াও এ লড়াইয়ে অংশগ্রহন করেছে শ্রমিক, হকার, দোকান কর্মচারীসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। এ লড়াইয়ে নারীদের ভূমিকা ছিলো খুবই অগ্রণী এবং সাহসী।

এই গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে নিহিত ছিলো স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা। ফলে আন্দোলন পরবর্তী সময়ে অন্তঃবর্তীকালীন সরকারের প্রথম দায়িত্ব ছিলো দ্রুত সময়ে হতাহতের সুনির্দিষ্ট তালিকা তৈরী করে তাদের স্বজনদের পাশে দাঁড়ানো, শহিদ পরিবারগুলোকে আর্থিক সহযোগিতা করা এবং আহত আন্দোলনকারীদের সুচিকিৎসা সহ পুনর্বাসনের দায়িত্ব পালন করা। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক যে, এ বিষয়ে সরকারের পর্যাপ্ত উদ্যোগ আমরা দেখিনি। এই আন্দোলনের যৌক্তিক এবং নৈতিক ভিত্তি তৈরি করতে হলে গণহত্যার সাথে জড়িতদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। প্রায় সাড়ে ৩ মাস সময় অতিক্রান্ত হলেও সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে দৃশ্যমান কোন তৎপরতা চোখে পড়ছে না। এ গণহত্যার বিচার আদৌ হবে কি না তা নিয়ে জনমনে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ আশঙ্কা আরও পাকাপোক্ত হয় যখন আমরা দেখি, ৫ আগস্টের পর সরকার এবং সেনা হেফাজতে থাকা গণহত্যায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ নিরাপদে বিদেশে চলে যান। সরকার এবং সেনাবাহিনীর সহযোগিতা ছাড়া এসব ঘটনা ঘটা অসম্ভব। আহতদের চিকিৎসার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট অবহেলার ঘটনা ঘটেছে এবং এখনও ঘটছে।
দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি তুলে ধরে তিনি বলেন, গত কয়েক মাসে ভয়াবহভাবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ঘটেছে। বড় বড় ব্যবসায়ী এবং সিন্ডিকেট গ্রুপগুলো এখনো আগের মতোই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রন করছে। এ অবস্থায় শ্রমজীবী নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত মানুষ চূড়ান্ত দুরাবস্থার মধ্যে পড়েছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পাঁয়তারা বিষয়ে ছাত্র জোটের নেতা বলেন, ২০২৪ এর অভ্যুত্থানে সকল ছাত্র সংগঠন ছাত্র-জনতার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আওয়ামী বিরোধী লড়াইয়ে সর্বাত্মকভাবে অংশগ্রহণ করেছে বলেই সরকারকে উৎখাত করা সম্ভব হয়েছে। রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং মিছিল-সমাবেশের মধ্য দিয়েই এ লড়াইয়ে জনগণ সংগঠিত হয়েছে। আমরা চেয়েছিলাম, অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা পূর্বের তুলনায় অধিক নিশ্চিত হবে। অথচ বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অগণতান্ত্রিকভাবে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে মত প্রকাশের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করছে। এসব সিদ্ধান্ত বিরাজনীতিকরণের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীদের দিশাহীন করা এবং গণঅভ্যুত্থানের চেতনাকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা ছাড়া আর কী? দীর্ঘদিন ধরে ছাত্র সংসদ নির্বাচন না থাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের দখলদারিত্ব এবং প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্র জেঁকে বসেছিলো। ফলে শিক্ষার গণতান্ত্রিক পরিবেশ নানাভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে প্রশাসনের প্রতি আমাদের আহ্বান- ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের পাঁয়তারা বন্ধ করে অবিলম্বে ছাত্র সংসদ নির্বাচন চালু করুন!
গার্মেন্টস শ্রমিক হত্যার ঘটনা তুলে ধরে তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনে পুলিশি হামলায় দুই জন শ্রমিক হত্যার ঘটনা ঘটেছে। আহত এবং হামলার শিকার হয়েছে অনেকে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এমন বর্বর হামলার ঘটনায় আমরা তীব্র নিন্দা জানাই। সারাদেশে শুধু গার্মেন্টস শ্রমিক রয়েছে ৫০ লক্ষের অধিক, যাদের শ্রমে ঘামে দেশের অর্থনীতি সচল রয়েছে। অথচ এই শ্রমিকদের গত ৩-৪ মাসের বকেয়া বেতন-বোনাস পরিশোধ করা হচ্ছে না। বিগত আওয়ামী সরকারের সময় আমরা শ্রমিকদের ওপর রাষ্ট্রীয় বাহিনীর এরকম নির্যাতন লক্ষ্য করেছি, এই সরকারের সময়ও তা অব্যাহত আছে। এই সময়ে আমরা আরও লক্ষ্য করছি, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়ন ক্রমাগত বেড়েই চলছে এবং তারা নির্বিচারে হত্যার শিকার হচ্ছেন। কিছু ঘটনায় রাষ্ট্র নির্বিকার আবার কিছু ঘটনা রাষ্ট্র নিজেই সংঘটিত করছে।
রিকশা চালকদের ওপর নিপীড়ননের বিষয়ে তুলে ধরে সালমান সিদ্দিকী লিখিত বক্তব্যে বলেন, বিগত সময়ে আমরা দেখেছি, ঢাকা শহরের রিকশাচালকদের ওপর কী নির্মম নিপীড়ন করা হয়েছে। প্রায় ২২ লক্ষ রিকশা চালক যাদের শ্রমের ওপর প্রায় ১ কোটি মানুষের জীবিকা নির্ভর করে— তাদের কোন দায়িত্ব পতিত আওয়ামীলীগ সরকার নেয়নি। অথচ নানা অজুহাতে অসংখ্য রুটে রিকশা চলাচল বন্ধ করে দেওয়া, রিকশা উচ্ছেদ করা, চাদা আদায় এবং পুলিশি হয়রানি ছিলো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এই গণঅভ্যুত্থানে রিকশাচালকসহ বিভিন্ন সেক্টরের বহু শ্রমিক শহিদি আত্মদান করেছেন, আহত হয়েছেন হাজার হাজার শ্রমজীবী মানুষ। অথচ তাদের ওপর অত্যাচার এখনও জারি আছে। অভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তবর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব হলো- বিভিন্ন সেক্টরের শ্রমজীবী মানুষের দাবি পূরণে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহন করা এবং সকল ন্যায়সঙ্গত গণতান্ত্রিক আন্দোলনে পুলিশি হামলা- নির্যাতন বন্ধ করা।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি ৫ দফা দাবিতে আগামী ২৭ নভেম্বর ২০২৪ ‘পদযাত্রা ও সমাবেশ’ কর্মসূচির ঘোষণা দেন। ঐদিন বেলা ১২ টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাহাদুর শাহ পার্ক পর্যন্ত ‘পদযাত্রা ও সমাবেশ’ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হবে জানিয়ে তিনি কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মানের সংগ্রামকে এগিয়ে নেয়ার আহ্বান জানান।
সংবাদ সম্মেলনে উত্থাপিত দাবিগুলো হলো:
১. অবিলম্বে গণহত্যায় জড়িতদের বিচার কর। শহিদ পরিবারগুলোকে আর্থিক সহযোগিতা, আহতদের সুচিকিৎসা এবং পূনর্বাসনের ব্যবস্থা কর ।
২. ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের পাঁয়তারা বন্ধ কর। অবিলম্বে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দাও।
৩. দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রন করো। নিম্নআয়ের মানুষদের জন্য আর্মি রেটে রেশন দাও। সিন্ডিকেট এবং বড় বড় ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য চালু কর।
৪. শ্রমিক আন্দোলনে পুলিশি হামলা বন্ধ কর, গার্মেন্টস শ্রমিকদের বকেয়া বেতন-বোনাস পরিশোধ কর। গার্মেন্টস শ্রমিক হত্যার বিচার করো।
৫. পুনর্বাসন ছাড়া রিকশা শ্রমিকদের হয়রানি করা বন্ধ কর।
সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন, তানজিম হায়দার চঞ্চল, সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন; দিলীপ রায়, সভাপতি, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী; ছায়েদুল হক নিশান–সভাপতি, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল; অঙ্কন চাকমা, সভাপতি, বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও তাওফিকা প্রিয়া, সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত), বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলন প্রমুখ।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।