পানছড়িতে অপারেশনের নামে তল্লাশি, লুটপাট, হয়রানি ও নির্যাতন বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভ

0


পানছড়ি প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫

খাগড়াছড়ির পানছড়িতে অপারেশনের নামে তল্লাশি, লুটপাট, হয়রানি ও নির্যাতন বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ হয়েছে।

ছাত্র-জনতার সংগ্রাম পরিষদের পানছড়ি শাখার উদ্যোগে এই বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়।

আজ সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫) সকাল সাড়ে ১০টার সময় পানছড়ির পুজগাঙ সারিবালা কলেজ থেকে মিছিল শুরু করা হয়। মিছিলটি “উপর পুজগাঙ বাজার” ঘুরে চেঙ্গী আইডিয়াল স্কুলের পাশে মিলিত হয়ে ধুধুকছড়া-পানছড়ি সদর রোড ব্লক করে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। এতে বিভিন্ন এলাকা থেকে ৪ শতাধিক নারী-পুরষ ও ছাত্র-ছাত্রী অংশগ্রহণ করেন।

মিছিলে তারা সেনাবাহিনীর নিপীড়ন-নির্যাতন, হয়রানির বিরুদ্ধে বিভিন্ন শ্লোগান দেন ও প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন।


সমাবেশে ছাত্র-জনতার সংগ্রাম পরিষদের পানছড়ি শাখার সদস্য চৈতী চাকমার সঞ্চালনায় লিখিত বক্তব্য দেন ছাত্র-জনতার সংগ্রাম পরিষদের পানছড়ি শাখার প্রতিনিধি জিনিম চাকমা।

লিখিত বক্তব্যে জিনিম চাকমা বলেন, “আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। দেশের অন্যান্য নাগরিকদের মতো আমাদেরও বাড়িতে নিরাপদে ও শান্তিতে বসবাস করার অধিকার আছে। কিন্তু সেনাবাহিনীর অপারেশনের কারণে আমরা শান্তিতে থাকতে পারছি না। রাতে-বিরাতে যখন তখন অনুমতি ছাড়া আমাদের বাড়িতে ঢুকে, তল্লাশির নাম করে বাড়ির সব জিনিসপত্র তছনছ দেওয়া হচ্ছে – এমনকি জনগণের জমানো টাকা ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র লুট করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়, নিরীহ লোকজনকে বিনা কারণে মারধর, জিজ্ঞাসাবাদের নামে মানসিকভাবে নির্যাতন চালানো হচ্ছে। সেনাবাহিনী যা করছে তা অত্যন্ত অন্যায় ও বেআইনী। আমরা এই সমাবেশ থেকে সেনাবাহিনীর এই অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।”

তিনি আরো বলেন, “অপারেশনের সময় সেনাবাহিনীর সদস্যরা আমাদের স্কুলগুলো দখল করে অবস্থান করার কারণে শিক্ষার্থীদের ক্লাশ বন্ধ হয়ে যায়। স্কুলের সকল কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে হয়। অপারেশন হলে এলাকার জনগণকে সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। অনেকে ভয়ে জঙ্গলে বা অন্য কোথাও পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এতে গ্রামের লোকজনের স্বাভাবিক কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটে।”

তিনি বলেন, “সেনারা সন্ত্রাসী খুঁজতে অপারেশন চালায়, তল্লাশি চালায় তারা নিজেরাই সন্ত্রাসী সংগঠনের জন্ম দেয়। তারাই সন্ত্রাসীদের পোষে, তারাই অপারেশনের সময় সন্ত্রাসীদেরকে সঙ্গে নিয়ে আসে। সন্ত্রাসীরা তাদের পাশে থাকে। সন্ত্রাসীদের সাথে তাদের দিনরাত উঠাবসা। কিন্তু তারা সেই সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার না করে, নিরীহ মানুষকে হয়রানি করে, আটক করে ও মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে দেয়।

সেনা অপারেশনের সময় গত ২০ সেপ্টেম্বর জগপাড়ায় সুপ্রভাত চাকমা, নিশান্ত চাকমা ও রিপেন চাকমাকে মারধরের ঘটনা উল্লেখ করে জিনিম চাকমা বলেন, “আমি প্রশ্ন করতে চাই – তাদের অপরাধ কী? কী কারণে তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে? যাদের বাড়িঘর তল্লাশি করা হয়েছে বা যাদেরকে বাড়ি ভেঙে ফেলে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তাদের অপরাধ কী? তারা পাহাড়ি বলেই কী তাদের অপরাধ? তারা চুরি-ডাকাতি করেনি, তারা সন্ত্রাস করেনি, চাঁদাবাজি করেনি, অন্যের খেত নষ্ট করেনি, কোন অপরাধ করেনি – তারপরও কেন তাদের ওপর অত্যাচার করা হবে? এ কেমন দেশ? এ দেশ কী তাদের নয়? এ দেশ কি পাহাড়িদের নয়?”


লিখিত বক্তব্যে জিনিম চাকমা জনগণের উদ্দেশ্যে বলেন, ‍‍“আমাদেরকে আর ভয় পেলে চলবে না। আমরা ভয়ে যতই কাবু হয়ে থাকবো, ততই অত্যাচার বেড়ে যাবে। আর আমরা কেন ভয় পাবো? আমরাতো কোন অন্যায় করিনি, অপরাধ করিনি। যারা নিরীহ লোকজনকে নির্যাতন করছে, অত্যাচার জুলুম করছে, তারাই অন্যায় ও অপরাধ করছে। তাদেরই ভয় পাওয়া উচিত।

“জনগণ একসাথে জেগে উঠলে তারা সত্যি সত্যিই ভয় পায়। তারা যতই শক্তিশালী হোক, তারা অন্যায়কারী, তাই তারা ভীতু, কাপুরুষ। তারা জনগণকে ভয় পায় বলেই জনগণকে ভয় দেখায়। কিন্তু জনগণ ভয়কে জয় করে এক হয়ে উঠে দাঁড়ালে, প্রতিরোধ করলে তারা পালিয়ে যায়। গত বছর ৫ আগস্ট জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে জেগে উঠেছে বলে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। পতনের আগে তাকেও অনেক শক্তিশালী, ক্ষমতাশালী মনে হয়েছে। আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণও যদি একসাথে জেগে উঠি, প্রতিরোধ গড়ে তুলি, তাহলে অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠী পালানোর পথ পাবে না।”

তিনি শাসকগোষ্ঠির অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে বলেন, সেনাবাহিনী এসব অন্যায় অত্যাচার করছে আমাদেরকে ধ্বংস করার জন্য, জাতি হিসেবে আমাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য। তাই আমাদের আর চুপ করে থাকতে পারি না। আমাদেরকে ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য প্রতিবাদ করতে হবে, লড়াই করতে হবে। বাঁচার জন্য লড়াই সংগ্রাম করা ছাড়া আমাদের সামনে আর কোন পথ খোলা নেই।

তিনি সরকার ও শাসকগোষ্ঠীকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, “জনতার চাইতে বেশি শক্তিশালী দুনিয়ায় আর কেউ নেই। আপনারা ক্ষমতার দম্ভ দেখাবেন না। মনে রাখবেন ভবিষ্যতে এমনও দিন আসতে পারে, যখন সেই ক্ষমতা তছনছ হতে বেশি সময় লাগবে না।”

সমাবেশ থেকে ৬ দফা দাবি জানানো হয়। দাবিগুলো হলো:

১) অবিলম্বে অপারেশনের নামে নিরীহ লোকজনকে হয়রানি, নির্যাতন, আটক এবং স্কুলঘর দখল করে শিক্ষা কার্যক্রমে ব্যাঘাত সৃষ্টি বন্ধ করতে হবে।

২) বিনা অনুমতিতে কারো বাড়িতে ঢুকে তল্লাশি চালানো বন্ধ করতে হবে।

৩) সেনা ক্যাম্পের পাশে থাকা সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করতে হবে।

৪) ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী ভেঙে দিতে হবে ও তাদেরকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

৫) অপারেশনের সময় যাদের টাকাপয়সা ও অন্যান্য জিনিসপত্র লুট করা হয়েছে, সেইসব লুণ্ঠিত অর্থ ও জিনিসপত্র ফেরত দিতে হবে। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদেরকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

৬) অপারেশন উত্তরণ নামে জারী রাখা সেনাশাসন তুলে নিতে হবে।

মিছিল ও সমাবেশে “সেনা অপারেশনের নামে নির্যাতন বন্ধ কর; বাড়িঘরে তল্লাশি, হয়রানি বন্ধ কর; তল্লাশির নামে লুটপাট বন্ধ কর; সেনাবাহিনীর গুণ্ডামি বন্ধ কর; অপারেশন উত্তরণের নামে সেনাশাসন বন্ধ কর; সেনাবাহিনীই সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষক; জুলুমবাজ সেনাবাহিনী চাই না; সেনা-ঠ্যাঙাড়ে সন্ত্রাস বন্ধ কর; আমার স্কুল সেনা ক্যাম্প বানাতে দেব না; স্কুলে সেনাবাহিনী নয়, শিক্ষক চাই” ইত্যাদি শ্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড-ব্যানার প্রদর্শন করা হয়।

এদিকে, সমাবেশ বানচাল করে দেয়ার লক্ষ্যে খুব সকাল থেকে সেনাবাহিনীর ৩০ জনের একটি দল ফাতেমা নগর হয়ে পুজগাঙ উচ্চ বিদ্যালয়ের পশ্চিমে বীরেন্দ্র পাড়ায় অবস্থান নেয় এবং ড্রোন উড়িয়ে ৪-৫ মিনিট মিছিল-সমাবেশে নজরদারি করে বলে জানা গেছে। 



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More