পার্বত্য চট্টগ্রামের অপর নাম ‘লোগাঙ’
রোনাল চাকমা

* ছবিটি চারুকলার শিক্ষার্থী ছদক চাকমা’র ফেসবুক থেকে নেওয়া হয়েছে।
পাহাড়ে ‘লোগাঙ’ এক বিশেষ প্রতীকী অর্থ বহন করে। ‘লোগাঙ’ চাকমা ভাষার শব্দ৷ সরাসরি বাংলা তর্জমা করলে এর অর্থ দাঁড়াবে ‘রক্তের ছড়া বা নদী’। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, ছড়ার পানি হালকা লালচে ছিল বলেই এর নাম হয়েছিল ‘লোগাঙ’। পাশের পুজগাঙ ছড়ার পানি ছিল হালকা ঘোলাটে। লোগাঙ আর পুজগাঙ ছড়া/ছোট নদী দুটো মিলেই উত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় চেঙ্গে নদী এবং উপত্যকা তৈরি হয়েছে। এই উপত্যকা হল পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে উর্বর। উর্বরতার কারণে এই অঞ্চলে আশির দশক থেকেই সেটলার পুনর্বাসন এবং রাষ্ট্রীয় জ্বালাও পোড়াও নীতি চলতে থাকে। তাছাড়া এটি ছিল সরকারের তরফ থেকে চিহ্নিত করা ‘রেড জোন বা শান্তিবাহিনী বিদ্রোহী অধ্যুষিত এলাকা।
‘লোগাঙ’ পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বউত্তরের পানছড়ি উপজেলার একটি ইউনিয়ন। পাশেই ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। ১৯৯২ সালে ১০ এপ্রিল পানছড়ি উপজেলার এই লোগাঙ ইউনিয়নে নিরাপত্তা বাহিনী-সেটেলারদের যৌথ আক্রমণে পাহাড়িদের গুচ্ছ গ্রামে এক বর্বরতম ও লোমহর্ষক গণহত্যা সংঘটিত হয়। এতে শত শত পাহাড়িকে হত্যা করা হয়। কয়েক হাজার পাহাড়ি ভারতে শরনার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। পাহাড়িদের রক্তে সেদিন স্থানীয় ছড়া/ছোট নদী ‘লোগাঙ’ রক্তে রঞ্জিত হয়। তখন থেকে লোকমুখে ছড়াটি ’রক্তের নদী’ বলে পরিচিতি পায়। গণহত্যার আগেও ছড়াটি ‘লোগাঙ’ পরিচিত ছিল। তখন থেকে ‘লোগাঙ’ পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে গণহত্যার প্রতীকী অর্থে পরিণত হয়েছে।
খাগড়াছড়িতে বৈ-সা-বি উদযাপন কমিটির আমন্ত্রণে চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে ১১ এপ্রিল’৯২ সালে ঢাকা থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আনু মুহাম্মদ, প্রয়াত উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট হাসান আরিফ ও বর্তমান উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান শুভ্রসহ ২৩ সদস্য বিশিষ্ট নাগরিক, বুদ্ধিজীবি, শিক্ষক, ছাত্রনেতা ও মানবাধিকার কর্মীরা পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর করেন। ঘটনাক্রমে তখন লোগাঙ গণহত্যা সংঘটিত হলে সফর টিম গণহত্যার জায়গায় যেতে চাইলে তৎকালীন পানছড়ি সেনা জোনের মেজর রেজা তাঁদের বাধা দেন। ঢাকায় ফিরে তাঁরা লোগাঙ গণহত্যা নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে একটি বিবৃতি দেয় যা সারা দেশজুড়ে আলোড়ন তৈরি করে। বৈ-সা-বি উদযাপন কমিটি উৎসব বয়কটের ডাক দেয়। রাগে-ক্ষোভে পাহাড়ি জনগণ প্রতিবাদে রান্না পাজন (চাকমাদের হরেকরকম সবজি দিয়ে তৈরি তরকারি) চেঙে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। সেই বছর শোকে-ক্ষোভে খাগড়ছড়ি-রাঙামাটির পাহাড়িরা কেউ উৎসব পালন করেনি।
লোগাঙ গণহত্যা দেশে-বিদেশে ব্যাপক চাঞ্চল্যে তৈরি করে৷ সরকারি তদন্তের প্রতিবেদনেও উঠে আসে গণহত্যার সত্যতা। চাপে পড়ে বিরোধী দলীয়নেত্রী সহ সরকারি দলের নেতৃবৃন্দরা ছুটে যায় লোগাঙ-এ। কিন্তু তাঁদের পৌছানোর আগে নিরাপত্তাবাহিনী ট্রাকে করে লাশ গুম করে গণকবর দেয়। শুধু লোগাঙ নয় এর আগেও ১৯৮০ সালের কাউখালির কলমপতি থেকে তাইন্দং, খাগড়াছড়ি, লংগদু, হীরাচর-সার্বোতলি, মাল্যসহ বহু স্থানে ডজনের অধিক গণহত্যা হয়। কিন্তু লোগাঙ গণহত্যার মতো করে সেগুলো বাইরে বেশি করে প্রকাশ কিংবা আলোচিত হয়নি।
লোগাঙ এখন বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী। একসময় শান্তিবাহিনীর প্রধান ঘাঁটি এলাকা ছিল। শান্তিবাহিনী নেতাদের সাথে যোগাযোগ ও সংলাপ চালিয়ে নেওয়ার জন্য রাষ্ট্রীয় নেতা ও সাংবাদিকরা ছুটে যেতেন দুর্গম এই এলাকায়। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের জন্য ১ম বারের মতো এরশাদ সরকারের সাথে প্রথম বৈঠকটি হয় এই এলাকায়। বৈঠকে জেএসএস সর্বপ্রথম প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনসহ ৫দফা দাবি উত্থাপন করেছিল। সর্বশেষ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির স্বাক্ষরের আগে শেষ বৈঠকে (১২ মার্চ ১৯৯৭) জেএসএস নেতা সন্তু লারমা’রা ঢাকার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে গিয়েছিলেন লোগাঙ-এর ধুধুকছড়া থেকে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের অবিসংবাদিত নেতা এমএন লারমা নিহতও হয়েছিলেন লোগাঙ-এর অদূরে গহীন জঙ্গলে। সরকারের সাথে শান্তিবাহিনীর যুদ্ধ এবং জেএসএস-এর রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের মূল কেন্দ্রও ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরের এই অঞ্চল। কারণ এই অঞ্চলের জনগণ ছিল বেশিরভাগ কাপ্তাই বাঁধের উদ্বাস্তু। বাস্তুভিটে হারানোর বেদনা, ক্ষোভ ও অধিকার বঞ্চনাবোধ নিয়ে তাঁরা মধ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে উত্তরের দিকে চলে এসে বসতি গড়ে তোলে। উদ্বাস্তুদের মধ্যে ছিল এমএন লারমাদেরও পরিবার।
লোগাঙ এখনো অস্থিতিশীল। জনপদে শান্তি ফিরেনি। গত ২০২৩ সালের ১১ ডিসেম্বর বিপুল চাকমাসহ চার উদীয়মান তরুণ নেতাকে সেখানে হত্যা করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় বিশেষ মহলের পৃষ্ঠপোষকতায় সেখানে এখনো চলছে হত্যাকাণ্ডের আয়োজন। লোগাঙ গণহত্যার স্থানে এখনো পূনর্বাসিত সেটলারদের গুচ্ছগ্রাম রয়ে গেছে। রয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প। গণহত্যার সময়ে পাহাড়িরা যেসব জায়গা-জমি হারিয়েছে তাঁরা ভারতের শরণার্থী জীবন কাটিয়ে এসে কিছুই ফিরে পাইনি। পার্বত্য চট্টগ্রামের কোন গণহত্যার এযাবত সুষ্ঠু তদন্ত, সরকারি শ্বেতপত্র প্রকাশ এবং দোষীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসা হয়নি। পাহাড়ে বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদছে গত পাঁচ দশক ধরে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধানও আজো মেলেনি।
মূলত পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাটি রাজনৈতিক। রাজনৈতিক সমস্যাকে যখনি সামরিকায়ন বা বল প্রয়োগে সমাধান করার চেষ্টা চলে তখনই শান্তিপূর্ণ সমাধানের পরিবর্তে অশান্তির বীজ বপন হয় এবং সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী রূপ লাভ করে। পাহাড়ে বর্তমান জটিল অবস্থা তৈরি হওয়ার পিছনে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ দায়ী। জিয়া-এরশাদ-হাসিনা যেই ক্ষমতার গদিতে গেছে তাঁরা পার্বত্য চট্টগ্রামকে সেনাদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। চট্টগ্রাম ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি হলেন পাহাড়ের হর্তাকর্তা। অর্থাৎ পাহাড়ে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন চলে তাঁর নেতৃত্বে। ড. ইউনূসের সরকারও একই পথে হাঁটছে। গত কিছু দিন আগে এক সাক্ষাৎকারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সেটা স্পষ্ট করেছেন। সেনাবাহিনীই পার্বত্য উপদেষ্টা পদে সুপ্রদীপ চাকমা’কে বসিয়েছে। পাহাড়ে আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা পরিষদ, উন্নয়ন বোর্ডের মতো সরকারি অধিদপ্তরে কাদেরকে পদায়ন করা হবে সেটা সেনাবাহিনী ঠিক করে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ারে যাঁরাই বসে তাঁরাই সরকারের সবচেয়ে আজ্ঞাভাজন ও বিশ্বস্ত দাসে পরিণত হয়।
সেনাদের দিয়ে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হয় না। অতীতে তাঁরা লোগাঙ-এর মতো বহু গণহত্যা, গুম ও অপহরণসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনে অভিযুক্ত। বর্তমানেও গণহত্যা পরিচালনা করছে, তবে পদ্ধতি রদবদল করেছে। আগামী দিনে পাহাড়ের লড়াই-সংগ্রামে যাঁরাই নেতৃত্ব দিবে তাঁদেরকে বাছাই করে হত্যা করা হচ্ছে। পাহাড়ে লোগাঙ-এর মতো নৃশংস ঘটনা ততদিন ঘটবে যতদিন পাহাড়ে সেনা শাসন থাকবে। রাষ্ট্রীয় নীতি-নির্ধারকরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে সমাধান না চাইলে সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব নয়। রাষ্ট্র যদি বলপ্রয়োগ করে সমাধান করতে চায় জনগণের পাল্টা প্রতিরোধ-বিদ্রোহের তত ঝুঁকি বাড়বে, সমস্যা দীর্ঘায়িত হবে। আর কতদিন পাহাড়ের বুক চিরে ‘লোগাঙ’ বইবে? লোগাঙ যেন বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রামেরই অপর নাম।
* রোনাল চাকমা, সাংগঠনিক সম্পাদক, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, কেন্দ্রীয় কমিটি
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।