পার্বত্য চট্টগ্রামে অব্যাহত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় এইচপিএফের উদ্বেগ প্রকাশ, কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান

0

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, সিএইচটি নিউজ
শনিবার, ১৯ জুলাই ২০২৫

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে অঘোষিত সেনাশাসন ‘উত্তরণের’ আবহে অব্যাহত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ত্রিপুরা-ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যানিটি প্রটেকশন ফোরাম (এইচপিএফ)। সংগঠনটি অবিলম্বে ঐ অঞ্চলের আদিবাসী পাহাড়ি জনগণের মৌলিক মানবাধিকার রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

গতকাল (১৮ জুলাই ২০২৫) সংগঠনটির চেয়ারম্যান ড. গৌতম চাকমা এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ সরকারের সমালোচনা করে আরও বলেন, ড. ইউনূস সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার প্রতি চরম উদাসীনতা প্রদর্শন করে চলেছে এবং সশস্ত্র বিদ্রোহের অনুপস্থিতি সত্বেও সেখানে বিশাল সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি অব্যাহত রেখেছে, যার ফলশ্রুতিতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো ঘটছে।

বিবৃতিতে তিনি গত কয়েক দিনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তুলে ধরেন। যেমন:

হেফাজতী মৃত্য: গত ১৭ জুলাই কারা হেফাজতে তৃতীয় মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এদিন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক অবস্থায় ভান লাল রোয়াল বম (৩৫) নামে এক ব্যক্তি মারা যান। তাকে গত বছর এপ্রিল মাসে বান্দরবানের রুমা ও থানছিতে সংঘটিত ব্যাংক ডাকাতি ও অস্ত্র লুটের মামলায় মিথ্যাভাবে জড়িত করে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ইতিপূর্বে ১৫ মে লাল ত্লেং কিম বম (৩০) ও ১ জুন লালসাং ময় বম (৫৫) কর্তৃপক্ষের অবহেলায় সুচিকিৎসার অভাবে চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন।

যৌন সহিংসতা: গত ২৭ জুন ১৪ বছর বয়সী এক কিশোরী স্কুল ছাত্রী খাগড়াছড়ি জেলার ভাইবোনছড়ায় একটি জাতীয় রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত ছয় জন অনুপ্রবেশকারী সেটেলার কর্তৃক দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন। উক্ত ঘটনার পর চরম মানসিক বৈকল্যে ১২ জুলাই কিশোরীটি আত্মহত্যার চেষ্টা করলে তবেই ঘটনাটি জানাজানি হয়। মামলার পর পুলিশ চার জনকে গ্রেফতার করেছে, তবে অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে এক্ষেত্রে সুবিচার নিশ্চিত হবে কীনা সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

অপহরণ: গত ২৮ জুন ২ ব্যক্তিকে ও ১ জুলাই অপর ৬ গ্রামবাসীকে ইউপিডিএফের সমর্থক সন্দেহে বাংলাদেশ সরকারের ক্ষমতায় থাকা একটি রাজনৈতিক দলের সশস্ত্র সদস্যরা রাঙ্গামাটি জেলার সাজেকের রাঙ্গাপানিছড়া থেকে অপহরণ করে। প্রথম দুই ব্যক্তি বন্দিদশা থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও বাকি ৬ গ্রামবাসীকে এখনও জিম্মি করে রাখা হয়েছে এবং তাদের মুক্তির জন্য ৬ লক্ষ টাকা দাবি করা হয়েছে। সরকার তাদের উদ্ধারে আজ পর্যন্ত কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বলে জানা যায়নি।

সামরিক অপারেশন: এছাড়া প্রায় প্রতিদিন পাহাড়ি অধ্যুষিত এলাকায় পরিচালিত সামরিক অভিযানে সাধারণ জনগণকে হয়রানি, গ্রেফতার, শারীরিকভাবে নির্যাতন ও তাদের বাড়িঘরে তল্লাশি করা হচ্ছে। গত ১৫ জুলাই খাগড়াছড়ির গুইমারায় এক সামরিক অভিযানে সেনাবাহিনীর সদস্যরা কলি মোহন ত্রিপুরা (৩০) নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে তল্লাশি চালায় এবং রণ বিকাশ ত্রিপুরা নামে অপর এক গ্রামবাসীকে সাময়িকভাবে আটক করে হয়রানিমূলক জিজ্ঞাসাবাদ করে। ইতিপূর্বে গত জুন মাসের শেধার্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামের ১০টি উপজেলার ৬৮টি গ্রামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ব্যাপক অপারেশন চালায়। এ সময় কমপক্ষে ২৩ জন আদিবাসীকে গ্রেফতার করা হয়, স্কুল দখল করে শিশুদের পাঠদানে বিঘ্ন ঘটানো হয় এবং নারীদের যৌন হেনস্তা করা হয়।

গৌতম চাকমা অবিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা অপারেশন বন্ধ, অপহৃত ৬ গ্রামবাসীকে উদ্ধার এবং ভাইবোনছড়ায় কিশোরী শিক্ষার্থীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের সাথে জড়িতদের গ্রেফতার ও শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানান।

এছাড়া তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জনগণের মানবাধিকারের সুরক্ষার জন্য কতিপয় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ড. ইউনূস সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। এই পদক্ষেপগুলো হলো সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণ, অপহরণ, হেফাজতী মৃত্যুসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত প্রতিটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার বিচারের জন্য একটি বিশেষ ট্রাইবুনালা গঠন করা, সেনাবাহিনীর অপারেশনের নামে নিরীহ জনগণকে হয়রানি, ধরপাকড় ও ভয়ভীতি প্রদর্শন বন্ধ করা, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করা, স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজনৈতিক সংলাপ শুরু করা, অনুপ্রবেশকারী সেটেলারদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সরিয়ে সমতলে বিশেষত শিল্পাঞ্চলে পুনর্বাসন করা, ভূমি সমস্যা সমাধানের জন্য পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনকে সক্রিয় করা এবং সরকারী ক্ষমতায় থেকে কোন রাজনৈতিক দল বা সংগঠন যাতে সশস্ত্র সংগঠন পুষতে ও সশস্ত্র তৎপরতা চালাতে না পারে তার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধানের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া ড. ইউনূস সরকারের সমীচিন নয় মন্তব্য করে এইচপিএফ চেয়াম্যান বলেন, যেখানে তার সরকার বিভিন্ন মহলের সমালোচনা ও উদ্বেগ উপেক্ষা করে রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডোর ও চট্টগ্রাম বন্দরের নিয়ন্ত্রণ বিদেশী কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের উদ্যোগ নিতে পারেন, সেখানে যুগের পর যুগ ঝুলে থাকা পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাগুলোর সমাধানের দায়িত্ব পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের ওপর ছেড়ে দিয়ে নির্বিকার থাকার মানসিকতা আদৌ সুবিবেচনাপ্রসূত নয়।



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More